শুক্রবার, ৩০ অক্টোবর, ২০১৫ ০০:০০ টা
সাক্ষাৎকার : নুরুল ইসলাম নাহিদ

শিক্ষায় ছেলে-মেয়ে সমতা অর্জন বিশ্বে রোল মডেল

আকতারুজ্জামান

শিক্ষায় ছেলে-মেয়ে সমতা অর্জন বিশ্বে রোল মডেল

প্রাথমিক, মাধ্যমিক, এবতেদায়ি ও মাদ্রাসায় ২০১০ সাল থেকে বিনামূল্যে বই বিতরণ করা হচ্ছে শিক্ষার্থীদের মধ্যে। পৃথিবীতে কোথাও বিনামূল্যে এত বিপুলসংখ্যক বই বিতরণ করা হয় না। এ ছাড়া বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর শিক্ষাব্যবস্থায় অভূতপূর্ব উন্নয়ন হয়েছে। ছেলে ও মেয়ে শিক্ষার সমতা অর্জনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে রোল মডেল। এ ছাড়া কারিগরি শিক্ষায় বৈপ্লবিক উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। গতকাল শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে বাংলাদেশ প্রতিদিন-এর সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ এসব কথা বলেন।

শিক্ষামন্ত্রী আরও বলেন, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পরই জাতীয় লক্ষ্যের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে শিক্ষার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। শিক্ষাবিদ এবং সব রাজনৈতিক দলের মতামত নিয়ে জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ প্রণয়ন করা হয়েছে। আমরা এটি ধাপে ধাপে বাস্তবায়ন করছি। আমাদের মূল লক্ষ্য- নতুন প্রজন্মকে প্রস্তুত করে তোলা, যাতে তারা আধুনিক বাংলাদেশের নির্মাতা হিসেবে কাজ করতে পারে। সেজন্য আমাদের প্রয়োজন প্রচলিত গতানুগতিক শিক্ষার গুণগত মৌলিক পরিবর্তন। আমরা চাই নতুন প্রজন্ম বর্তমান যুগের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ বিশ্বমানের শিক্ষায় শিক্ষিত হবে। নতুন প্রজন্মের মধ্যে মূল্যবোধ সৃষ্টি করতে হবে। সততা, নিষ্ঠা, দায়িত্বশীলতা, দায়বদ্ধতা তাদের ভিতর জাগিয়ে তুলতে হবে। জনগণের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ এক পরিপূর্ণ মানুষ তৈরিই আমাদের লক্ষ্য।

শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ২০০৯ সালে আমি যখন দায়িত্ব নেই তখন একাডেমিক কারিকুলাম ছিল ১৭ বছর আগের লেখা। ১৭ বছর আগে যেসব শিক্ষক এই কারিকুলাম প্রণয়ন করেছিলেন তারা আধুনিক প্রযুক্তি এমনকি আধুনিকতার কোনো ছোঁয়াই পাননি। হয়তো মোবাইল ফোনও দেখেননি তারা। শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর দ্রুত সময়ের মধ্যে ৫৫০ জন শিক্ষক, শিক্ষাবিদ, বিশেষজ্ঞ নিয়ে একটি কারিকুলাম প্রণয়ন করেছি। নতুন কারিকুলাম অনুযায়ী ১১১টি বই শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। আইসিটি, কম্পিউটার শিক্ষা, জলবায়ু পরিবর্তনসহ মেয়েদের শারীরিক বিভিন্ন সমস্যা পাঠ্যবইয়ে বাধ্যতামূলক করে দিয়েছি। এসব আগে কেউ চিন্তাও করেনি। এ ছাড়া চারুকলা, খেলাধুলাসহ বিভিন্ন বিষয়ে জোর দিয়েছি আমরা। আগে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা করত শুধু পাস করার জন্য, জ্ঞান অর্জনের জন্য নয়। গতানুগতিক প্রক্রিয়ার শিক্ষায় শিক্ষার্থীরা এ জ্ঞান কাজে লাগাতে পারত না। সৃজনশীল পদ্ধতি বর্তমানে চালু করায় এ জ্ঞান তারা কর্মক্ষেত্রে প্রয়োগ করছে। শিক্ষার্থীরা এখন মুখস্থ না করে বুঝে পড়ছে। আমরা শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। টিআইকিউ প্রকল্পের মাধ্যমে বিদেশ থেকে এক্সপার্ট এনে প্রায় ৫০ হাজার শিক্ষককে সৃজনশীলের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। সেকায়েপ প্রকল্পের মাধ্যমে তুলনামূলক পশ্চাদপদ স্কুল বাছাই করে ইংরেজি, গণিত ও বিজ্ঞানের ১১ লাখ অতিরিক্ত ক্লাস নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া তথ্য-প্রযুক্তিতে দক্ষ করে তুলতে আমরা আইসিটি এডুকেশন চালু করেছি। এর অংশ হিসেবে ২৩ হাজার ৩৩১টি বিদ্যালয়ে মাল্টিমিডিয়া ক্লাস-রুম চালু করা হয়েছে। মন্ত্রী বলেন, কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষায় বর্তমান সরকার গুরুত্ব দেওয়ায় এ সেক্টরে গুণগত পরিবর্তন এসেছে। ২০০৯ সালে ১ শতাংশেরও কম শিক্ষার্থী কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত হতো। বর্তমানে মোট শিক্ষার্থীর ১০ শতাংশের বেশি কারিগরি প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা নিচ্ছে। ২০২০ সালের মধ্যে আশা করছি, আমরা এ হার ২০ শতাংশে উন্নীত করতে পারব। মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক, পলিটেকনিক, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজসহ বর্তমানে সাত হাজারের বেশি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদান চলছে। কারিগরি শিক্ষায় মেয়েদের শিক্ষিত করতে ২০ শতাংশ কোটা পদ্ধতি চালু করেছে বর্তমান সরকার। এ ছাড়া মেয়েদের জন্য সাতটি বিভাগে সাতটি সরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট করা হয়েছে। এর মধ্যে চারটিতে পাঠদান চালু হয়েছে। বাকি তিনটিতে প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় জ্ঞান বিতরণে বিশ্বের মধ্যে কারিগরি শিক্ষায় শ্রেষ্ঠ সিঙ্গাপুরের নানিয়ান পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেতে ৪২০ শিক্ষককে প্রশিক্ষণ করানো হয়েছে। শিগগিরই আমরা আরও দ্বিগুণ পরিমাণ শিক্ষককে কারিগরি শিক্ষার প্রশিক্ষণে পাঠানোর পরিকল্পনা করছি। কারখানার সঙ্গে সামঞ্জস্য করে কারিকুলামও প্রণয়ন করা হয়েছে। এতে চাকরির চাহিদা অনুযায়ী শিক্ষার্থীরা পাঠ নিতে পারবেন। নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, আগে পরিবারগুলো ভাবত, মাঠে কাজ করলে টাকা পাওয়া যায়, পক্ষান্তরে বই কিনতে গেলে টাকা খরচ হচ্ছে। আমরা ক্ষমতায় আসার পর বিনামূল্যে বই বিতরণের উদ্যোগ নেই। এত বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীর বিনামূল্যে বই দেওয়ার ঘটনা পুরো বিশ্বে বিরল। বিশ্বে কোথাও এমন নজির নেই। ২০১০ শিক্ষাবর্ষে ১৯ কোটি ২২ লাখ এবং ২০১২ সালে ২২ কোটি ১৪ লাখ, ২০১৩ সালে ২৬ কোটির বেশি বই শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। গত বছর ৩৩ কোটি বই বিনামূল্যে বিতরণ হয়েছে। ২০১৬ সালে ৪ কোটি ৪৪ লাখ শিক্ষার্থীর হাতে ৩৩ কোটি ৩৯ লাখ বই বিতরণ করা হবে। শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার ব্যাপারে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ২০০৯ সালে দেশের ৯ শতাংশ শিশু বিদ্যালয়ে যেত না। যারা যেত তাদের ৪৮ শতাংশ শিক্ষার্থী পঞ্চম শ্রেণিতে যাওয়ার আগেই ঝরে পড়ত। আর নবম শ্রেণির আগে ৪২ শতাংশ ঝরে পড়ত। আমরা এর কারণ অনুসন্ধান করে সব শিশুকে বিদ্যালয়ে নিয়ে আসার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছি। ২০১১ সালের মধ্যে প্রাথমিক স্তরে ৯৯ দশমিক ৪৭ শতাংশ শিশুকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। প্রাথমিকে ঝরে পড়ার হার ৪৮ শতাংশ থেকে কমে ২১ শতাংশে এসেছে। শিক্ষামন্ত্রী বলেন, আগে কমসংখ্যক মেয়ে শিশু বিদ্যালয়ে আসত। প্রাথমিক পাঠ শেষ হওয়ার আগেই অনেকের বিয়ে হয়ে যেত। এমডিজির লক্ষ্য হিসেবে ২০১৫ সালের মধ্যে বিদ্যালয়ে ছেলে ও মেয়ের সমতা অর্জন করার কথা ছিল। কিন্তু এক্ষেত্রে সরকারের আন্তরিকতা আর সংশ্লিষ্টদের সহযোগিতায় ২০১২ সালের মধ্যে প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত ছেলে ও মেয়ের সমতা অর্জন করা সম্ভব হয়েছে। অনেক বিদ্যালয়ে ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের সংখ্যাই বেশি। উচ্চ শিক্ষায়ও ছেলেদের সঙ্গে তাল মেলাচ্ছে মেয়েরা। শিগগিরই এ পর্যায়ে মেয়েরা ছেলেদের সমান এনরোল করবে। শিক্ষায় ছেলে-মেয়ের সমতা অর্জনে বাংলাদেশ বিশ্বের রোল মডেল বলে তিনি উল্লেখ করেন। শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে ধরে রাখার কৌশল হিসেবে নাহিদ বলেন, সবাইকে স্কুলগামী করাই ছিল চ্যালেঞ্জিং। শিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধ করতে বিনামূল্যে বই বিতরণের পাশাপাশি ৪০ শতাংশ প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি দেওয়া হচ্ছে। এদের মধ্যে ৩০ শতাংশই মেয়ে। এ ছাড়া উচ্চ মাধ্যমিকে প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ট্রাস্ট থেকে আড়াই লাখ ছাত্র ও ছাত্রীকে উপবৃত্তি দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া ভালো ফলাফলের জন্য বৃত্তি তো পাচ্ছেই। এখন আমাদের প্রচেষ্টা চলছে যাতে আমরা দুপুরে একবেলা শিক্ষার্থীদের খাবার দিতে পারি। শিক্ষার্থীদের ধরে রাখার কৌশল হিসেবে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা (পিএসসি) ও জুনিয়র সার্টিফিকেট পরীক্ষা (জেএসসি) চালু করা হয়েছে। কোনো শিক্ষার্থী পড়াশোনা ছেড়ে দিতে চাইলেও অন্তত একটি জাতীয় সার্টিফিকেট পেতে পঞ্চম অথবা অষ্টম শ্রেণির পাঠ সম্পন্ন করছে। নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, আমরা শিক্ষাব্যবস্থায় শৃঙ্খলা এনেছি। আগে এসএসসি, এইচএসসি পরীক্ষা, কলেজে ভর্তি ও ক্লাস শুরুর নির্ধারিত কোনো সময় ছিল না। পরীক্ষার ফল বের হতে তিন-চার মাস সময় লাগত। এভাবে আমাদের অজ্ঞাতেই একটি বছর নষ্ট হয়ে যেত। আমরা এটি শৃঙ্খলার ভিতর নিয়ে এসেছি। এখন ১ ফেব্রুয়ারি এসএসসি, ১লা এপ্রিল এইচএসসি পরীক্ষা, ৬০ দিনের মধ্যে এসব পরীক্ষার ফলাফল দেওয়া হচ্ছে। প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত ১ জানুয়ারিতেই ক্লাস শুরু হচ্ছে। ১ জুলাই কলেজে ভর্তি শুরু হচ্ছে। আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর একবারও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। তিনি বলেন, সরকারের সহযোগিতায় প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষায় ব্যাপকভাবে অবকাঠামোর উন্নয়ন হয়েছে। প্রাথমিকে ৪১ হাজারের বেশি ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। মাধ্যমিক, মাদ্রাসা, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ৮ হাজার নতুন ভবনের কাজ চলছে। প্রাথমিকে ৬০ হাজারের বেশি সহকারী শিক্ষক, ৫ হাজার প্রধান শিক্ষক ও ১৫ হাজার শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়া চলছে। সব পাঠ্যপুস্তক ই-বুকে রূপান্তর করে ওয়েবসাইটে আপলোড করা হয়েছে। বিদ্যালয়হীন গ্রামে ১ হাজার ৫০০ নতুন প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন কাজের অধিকাংশই সম্পন্ন হয়েছে। শিক্ষামন্ত্রী বলেন, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দেন স্থানীয় পরিচালনা কমিটি। এক্ষেত্রে স্বচ্ছতার অভাব ও দুর্নীতি হয় বলে অভিযোগ আসে। এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নির্বাচনের লক্ষ্যে শূন্য পদের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ মেধা তালিকা প্রকাশের বিধান রেখে বেসরকারি শিক্ষক নির্বাচন কমিশন (এনটিএসসি) গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এর মাধ্যমে উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা ও জেলা শিক্ষা কর্মকর্তার মাধ্যমে সারা দেশ থেকে প্রাপ্ত শূন্য পদের ভিত্তিতে নিবন্ধন পরীক্ষার প্রিলিমিনারি, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রার্থীদের উপজেলা, জেলা ও জাতীয়ভিত্তিক মেধা তালিকা প্রকাশ করা হবে। এ তালিকা থেকে পিএসসির আদলে শিক্ষকরা নিয়োগ পাবেন। এতে শিক্ষক নিয়োগে স্বচ্ছতা নিশ্চিত হবে।

সর্বশেষ খবর