শনিবার, ৩১ অক্টোবর, ২০১৫ ০০:০০ টা

কঠিন দুঃসময়ে বিএনপি

সিনিয়র নেতাদের হতাশা, হামলা-মামলায় অগোছালো সংগঠন দুই বিদেশি হত্যাকাণ্ডে অভিযোগ, দিকনির্দেশনার অভাব

মাহমুদ আজহার

কঠিন  দুঃসময়ে বিএনপি

দেড় মাস ধরে দেশের বাইরে অবস্থান করছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। এরই মধ্যে দুই বিদেশি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় অভিযোগের তীর এসে বিদ্ধ দলের নেতাদের দিকে। বিএনপি-প্রধানের অনুপস্থিতিতে বঞ্চনা আর অভিমানে বুধবার আকস্মিকভাবে দল থেকে পদত্যাগ করলেন ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরী। সরকারবিরোধী আন্দোলনে ব্যর্থতাসহ নানা কারণে সিনিয়র নেতাদের মধ্যেও হতাশার সুর। আবার পেছনের আন্দোলন-সংগ্রামে নেতিবাচক ভ‚মিকাসহ বিভিন্ন ইস্যুতে নেতাদের বড় একটি অংশের ওপর ক্ষুব্ধ খালেদা জিয়া। হামলা-মামলা আর অগোছালো সংগঠনে নিষ্প্রভ তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা। নিত্যনতুন মামলা আর গ্রেফতারে দলের সর্বত্রই আতঙ্ক। সব মিলিয়ে কঠিন দুঃসময় অতিক্রম করছে বিএনপি। এ অবস্থায় দিকনির্দেশনা পেতে বেগম জিয়ার দেশে ফেরা জরুরি বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

বিএনপি নেতারা বলছেন, দল প্রতিষ্ঠার পর এত ‘কঠিন’ সময় আর আসেনি বিএনপিতে। সৈনিক-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে জিয়াউর রহমানের ক্ষমতা গ্রহণের পর অন্তত ১৭ বার সেনাবাহিনীতে ক্যু হয়েছিল। ঠাণ্ডা মাথায় পরিস্থিতি সামাল দেন জিয়াউর রহমান। অবশ্য ১৮ বারের মাথায় চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে তিনি শাহাদাতবরণ করেন। তার মৃত্যুর পর বিপুল ভোটে জয়ী হওয়া বিচারপতি আবদুস সাত্তারের কাছ থেকে ক্ষমতা কেড়ে নেন স্বৈরাচার এরশাদ। এরপর গৃহবধূ খালেদা জিয়া দলের হাল ধরেন চেয়ারপারসন হিসেবে। ওই দুঃসময়েও দল ভেঙে বেরিয়ে যান হুদা, মতিন, ব্যারিস্টার মওদুদ ও জাফর ইমামের মতো প্রভাবশালী নেতারা। কিন্তু হাল ছাড়েননি বেগম জিয়া। নেতাদের মতে, দীর্ঘ নয় বছর স্বৈরাচার এরশাদের বিরুদ্ধে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপির তরুণ নেতৃত্ব আন্দোলন-সংগ্রাম করে রাজপথে। এরপর ১৯৯১ সালে দেশ শাসনের দায়িত্ব পায় বিএনপি। ওয়ান-ইলেভেনের মতো দুঃসময়ও বিএনপি অতিক্রম করেছে। মন্ত্রী-এমপিদের বড় একটা অংশ খালেদা জিয়ার নেতৃত্বের বাইরে গিয়ে আলাদা বিএনপি গঠন করে। কিন্তু তাতেও মূল বিএনপি ধ্বংস হয়নি। বর্তমানে দীর্ঘ নয় বছর ধরে বিএনপি ক্ষমতার বাইরে। তবে চলমান যে দুঃসময় চলছে, তা অতীতের সব কঠিন মুহূর্তকেই ছাড়িয়ে গেছে বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। এ প্রসঙ্গে বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘নদীর পাড়ে যাদের বাড়ি, তারা কখনই ঢেউয়ে ভয় পায় না। বিএনপি প্রতিষ্ঠা থেকেই দুঃসময় অতিক্রম করে এসেছে, এখনো করছে। এ নিয়ে চিন্তিত নন নেতা-কর্মীরা। সামনে যত বড় বাধাই আসুক না কেন, বিএনপি তা মোকাবিলায় প্রস্তুত। দু-এক জন দল থেকে চলে গেলে কিংবা গ্রেফতার, হামলা-মামলার খড়গে বিএনপির হয়তো সাময়িক ক্ষতি হবে। কিন্তু বিএনপি তার আপন শক্তিতে উঠে দাঁড়াবে। ওয়ান-ইলেভেনেও তো কিছু নেতা চলে যান দল ছেড়ে। ক্ষতিগ্রস্ত তারাই হয়েছেন।’ জানা গেছে, পাশাপাশি সময়ে দুই বিদেশি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ও শমসের মবিনের পদত্যাগে চরম অস্বস্তিতে পড়েছে বিএনপি। এ ছাড়া প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ভাই আহমেদ কামালের মিলাদ অনুষ্ঠান নিয়েও কম-বেশি দুশ্চিন্তায় দলটি। এত বছর পর হঠাৎ এ সময়ে কেন জিয়া পরিবারের মরহুম সদস্যদের নিয়ে মিলাদ মাহফিলের আয়োজন, তা নিয়েও দলের ভিতরে-বাইরে আলোচনার ঝড় বইছে। বিশেষ করে শমসের মবিনের দল থেকে পদত্যাগে দেশে বিদেশে ক‚টনৈতিক মহলে জোর আলোচনা চলছে। দলে তেমন কোনো প্রভাব না পড়লেও এ সময়ে তার পদত্যাগে সব মহলেই নানা গুঞ্জন চলছে। বিএনপির বেশ কয়েকজন সিনিয়র নেতাও তাদের ঘনিষ্ঠজনদের কাছে অবসরে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। শমসের মবিনের পদত্যাগের পর এখন তারা কী করবেন, তা স্পষ্ট নয়। তবে দলের নানা কর্মকাণ্ডের ঘোরতর সমালোচক এক নেতা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেছেন, দল ছাড়ার ইচ্ছা তার নেই। যতদিন বেঁচে থাকবেন, ততদিনই বিএনপির সঙ্গে থাকবেন। যত দুর্যোগই আসুক না কেন।

জানা গেছে, দেড় মাস ধরে লন্ডনে চিকিৎসাধীন থাকা বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার দেশে ফেরার অপেক্ষায় দলের নেতা-কর্মীরা। দলের এ দুঃসময়ে দিকনির্দেশনা চান দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারাও। আগামী ৭ নভেম্বরের আগেই দেশে ফিরতে পারেন বেগম জিয়া। ২ নভেম্বর তার বাংলাদেশে ফেরার টিকিট বুকিং দেওয়া হয়েছে। আশা করা যাচ্ছে ৩ নভেম্বর ঢাকায় থাকবেন বিএনপি-প্রধান। দেশে ফিরেই দলের চেইন অব কমান্ড ফিরিয়ে আনবেন তিনি। এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এস এম এ ফায়েজ বলেন, ‘বিএনপিকে এখন ঠাণ্ডা মাথায় চলমান সংকট মোকাবিলা করতে হবে। সতর্কভাবে সামনে পা ফেলতে হবে। আইনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে এগোতে হবে। আমি মনে করি, বিএনপি একটি পরীক্ষিত রাজনৈতিক দল। তাই চলমান ক্রাইসিসকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। থেমে থাকলে চলবে না। অতীতের ভুলত্র“টি থেকেও শিক্ষা নিতে হবে। জনগণ ও দেশের ভবিষ্যৎ মাথায় রেখে ইতিবাচক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে হবে। যদি জনগণ বিএনপির ওপর আস্থা রাখতে পারে, তাহলে ভবিষ্যতে পথ চলতে বিএনপির কোনো বাধা থাকার কথা নয়।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বলেন, ‘বিএনপি দীর্ঘদিন ধরেই একটি ক্রাইসিসের মধ্যে সময় পার করছে। দুই বিদেশি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় বিএনপি কঠিন দুর্যোগে পড়তে পারত। কিন্তু এখন মনে হয়, তা সম্ভব নয়। কারণ, ঘটনার তদন্ত, গ্রেফতার কিংবা ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহের আগেই খোদ সরকার-প্রধান বলে দিলেন, এটা বিএনপি-জামায়াত ঘটিয়েছে। ঘটনা সত্য হলেও এটা কারও কাছে এখন আর বিশ্বাসযোগ্য হবে না। বিএনপির কাউকে গ্রেফতারের আগেই বলা হচ্ছে, টাকা লন্ডন থেকে এসেছে। এটা কীভাবে বলা সম্ভব? এত কাঁচাভাবে তাভেলা হত্যাকাণ্ড উপস্থাপন করা হয়েছে, যা বিশ্বাসযোগ্য নয়। এখন যে ক্রাইসিস চলছে, এটা শুধু বিএনপিরই নয়, দেশ ও গণতন্ত্রের। রানা প্লাজা ধসে পড়ার সময়ও বলা হয়েছিল, বিএনপি-জামায়াতের নাড়াচাড়ার কারণেই এ ঘটনা ঘটেছে।’ শমসের মবিনের পদত্যাগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বিএনপির এই নেতাকে নিয়ে দলের মধ্যে অনেক প্রশ্ন ছিল। তাকে বিএনপি বাদ দিতে চেয়েছে, না উনি নিজে থেকেই পদত্যাগ করেছেন তা জানতে হবে। তার পদত্যাগ কি স্বতঃস্ফূর্ত না বিএনপিই চাচ্ছিল উনি সম্মানজনকভাবে বিদায় নিন এটা অনুসন্ধান করে দেখতে হবে। ব্যাপারটা খুব সহজ নয়। উনি দলে অনেক দিন ধরেই নিষ্ক্রিয় আছেন। খুবই লক্ষণীয় যে, উনি জেল থেকে বের হওয়ার পর বিএনপি চেয়ারপারসনের সঙ্গেও দেখা করেননি। আর শমসের মবিনের বিদেশি ক‚টনীতিকদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল, কিন্তু দলের সংগঠক হিসেবে তার তেমন কোনো অবদান ছিল না।’ আপাতদৃষ্টিতে বিএনপির দুঃসময় বলে মন্তব্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান অধ্যাপক নূরুল আমিন ব্যাপারী বলেন, ‘এটা শুধু বিএনপিই নয়, দেশ ও গণতন্ত্রের জন্যও ক্ষতি। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের জন্যও কোনো সুখবর নয়। উন্নয়নের জন্য গণতন্ত্র থাকতে হবে। সংসদে শক্তিশালী বিরোধী দল থাকতে হবে, যা আজ অনুপস্থিত। কর্তৃত্ববাদী সরকার দেশ চালাচ্ছে। রাজপথে বিএনপি দাঁড়াতেই পারছে না।’ তার মতে, ‘বিএনপির বড় ভুল ছিল বিগত ৫ জানুয়ারি সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে সহিংস আন্দোলনে যাওয়া। গণতান্ত্রিক আন্দোলনে থাকলে বিএনপিকে আজ এ পরিণতি ভোগ করতে হতো না। জনসম্পৃক্ত গণতান্ত্রিক আন্দোলন করতে পারেনি দলটি। তা ছাড়া আন্দোলনে জাতীয় ইস্যুকে কম গুরুত্ব দিয়ে দলীয় ইস্যুগুলোকে প্রাধান্য দেওয়াও ভুল ছিল। এ ছাড়া জামায়াতকে দূরে রেখে যুগপৎ আন্দোলন করা উচিত ছিল। আজ বিএনপিকে দুর্বল করে সরকার চলমান সমস্যা মোকাবিলা করতে চাচ্ছে। কিন্তু এটাও কোনো ভালো লক্ষণ নয়।’ তিনি বলেন, ‘আজ বিএনপির নেতাদের মধ্যে নেই সৃষ্টিশীলতা। মেধাবী তেমন কোনো নেতা নেই বিএনপিতে। অথচ জিয়াউর রহমানের আমলে মেধাবীরাই দল ও সরকার পরিচালনায় অংশ নিয়েছিলেন। বিএনপিকে সেদিকেই মনোযোগ দেওয়া উচিত।’

 

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর