রবিবার, ১ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

এবার প্রকাশককে গলা কেটে হত্যা

দিনদুপুরে অফিসে ঢুকে একই কায়দায় দুটি হামলা আহত আরও ৩, দায় স্বীকার আনসার-আল-ইসলামের

নিজস্ব প্রতিবেদক

এবার প্রকাশককে গলা কেটে হত্যা

হামলার পর ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে আসা হয় জাগৃতি প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী ফয়সাল আরেফিন দীপনকে -বাংলাদেশ প্রতিদিন

এবার একযোগে হামলার শিকার হলেন লেখক অভিজিৎ রায়ের বইয়ের দুই প্রকাশক জাগৃতি প্রকাশনীর কর্ণধার ফয়সল আরেফিন দীপন ও শুদ্ধস্বরের কর্ণধার আহমেদুর রশীদ চৌধুরী টুটুল। গতকাল দুপুরের পর দুর্বৃত্তরা রাজধানীর আজিজ সুপার মার্কেটের তৃতীয় তলার জাগৃতি প্রকাশনীর কার্যালয়ে ঢুকে গলা কেটে হত্যা করে ফয়সল আরেফিন দীপনকে। হত্যার পর দুর্বৃত্তরা কার্যালয়ের গেটে বাইরে থেকে তালা মেরে চলে যায়। পুলিশ তালা ভেঙে দীপনের রক্তাক্ত লাশ উদ্ধার করে। প্রায় একই সময়ে একই কায়দায় অস্ত্রধারীরা হামলা চালায় রাজধানীর লালমাটিয়ার সি ব্লকের শুদ্ধস্বরের কার্যালয়ে। হামলার শিকার হন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান শুদ্ধস্বরের কর্ণধার আহমেদুর রশীদ চৌধুরী টুটুল। একই ঘটনায় টুটুলের সঙ্গে থাকা দুই ব্লগারও মারাÍক আহত হয়েছেন। তারা হলেন ব্লগার তারেক রহিম ও রণদীপম বসু। দুর্বৃত্তরা গুলি ছুড়ে ও কুপিয়ে তাদের আহত করে বেরিয়ে যায়। যাওয়ার আগে তারা ওই কার্যালয়ের দরজায় তালা মেরে দেয়। পরে পুলিশ সংবাদ পেয়ে এসে দরজা ভেঙে তাদের উদ্ধার করে।

হামলায় মারাÍক আহত টুটুল, ব্লগার তারেক রহিম ও রণদীপম বসুকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। অস্ত্রোপচারের পর ঢাকা মেডিকেলের ক্যাজুয়ালটি বিভাগের সার্জন কে এম রিয়াজ বিকাল ৫টার দিকে সাংবাদিকদের বলেন, টুটুল ও তারেকের অবস্থা ক্রিটিকাল। রণদীপম আশঙ্কামুক্ত।’ রাতে এ ঘটনার দায় স্বীকার করেছেন আনসার-আল-ইসলাম নামের একটি সংগঠন। গত ফেব্রুয়ারিতে অভিজিৎ রায় নিহত হওয়ার পর ফেসবুকে হত্যার হুমকি পাওয়ার কথা জানিয়ে টুটুল মোহাম্মদপুর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছিলেন। সন্ত্রাসী হামলায় নিহত বিজ্ঞান লেখক অভিজিৎ রায়ের বিশ্বাসের ভাইরাস’ বইটি প্রকাশ করেছিল জাগৃতি প্রকাশনী এব অবিশ্বাসের দর্শন’সহ কয়েকটি বই বের করে শুদ্ধস্বর। ঘটনার পর পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা আজিজ সুপার মার্কেট ও লালমাটিয়ার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। সিআইডির বিশেষজ্ঞরা আলামত সংরক্ষণ করেন। ফেব্রুয়ারিতে বইমেলার বাইরে প্রবাসী লেখক অভিজিৎ রায়কে কুপিয়ে হত্যার সঙ্গে জঙ্গিরা সংশ্লিষ্ট বলে পুলিশের তদন্তে উঠে আসে। গতকালের ঘটনা দুটিও একই ধরনের বলে পুলিশ জানিয়েছে। একের পর এক ব্লগার খুনের পর এবার প্রকাশক খুনের ঘটনা ঘটল। আর কঠোর নিরাপত্তাব্যবস্থার মধ্যেই একযোগে হামলা চালিয়ে খুনের মতো ঘটনা ঘটায় গোয়েন্দারাও হতবাক। পুলিশ জানিয়েছে, খুনের ধরন দেখে মনে হচ্ছে অতীতের ব্লগার খুনের ঘটনায় যারা জড়িত, তারাই এ দুটি ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে। জানা গেছে, বেলা দেড়টা পর্যন্ত দীপন তার বাসায় ছিলেন। পরে শাহবাগে তার প্রকাশনী প্রতিষ্ঠানে যান। তার বাবা খোঁজ নেওয়ার জন্য কয়েকবার ছেলেকে ফোন করেন। কিন্তু ছেলে ফোন ধরেননি। বিকাল ৪টার দিকে তিনি আজিজ সুপার মার্কেটে গিয়ে ছেলের কার্যালয়টি ভিতর থেকে বন্ধ অবস্থায় দেখেন। তখন তিনি ছেলে বাইরে গেছে ভেবে সেখান থেকে চলে যান। পরে জানতে পারেন, লালমাটি? য়ায় শুদ্ধস্বর প্রকাশনীর মালিক আহমেদুর রশীদ টুটুলসহ তিনজনকে কুপিয়ে জখম করা হয়েছে। এ কথা শুনে তিনি লোকজন নিয়ে ছেলের কার্যালয়ে গিয়ে দরজা ভেঙে দেখেন, রক্তাক্ত অবস্থায় তার ছেলে পড়ে আছেন। ওই অবস্থায় দীপনকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সন্ধ্যা ৭টার দিকে হাসপাতালের আবাসিক সার্জন রিয়াজ মোর্শেদ তার মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেন।

টুটুলকে মারতে এসেছি : রাজধানীর লালমাটিয়ায় শুদ্ধস্বর প্রকাশনীর প্রকাশক আহমেদুর রশীদ টুটুল, কবি তারেক রহিম ও লেখক-গবেষক রণদীপম বসুকে কুপিয়েছে দুর্বৃত্তরা। দুপুরে এ ঘটনা ঘটে। লালমাটিয়ায় শুদ্ধস্বর প্রকাশনীর অফিসে তিন-চার জন যুবক এসে তিনজনকে এলোপাতাড়ি কোপায়। পরে তারা ওই কার্যালয়ে তালা মেরে চলে যায়। ভিতর থেকে অক্ষত অবস্থায় থাকা এক তরুণ পুলিশের কাছে ফোন করে। পুলিশ এসে তালা ভেঙে তাদের উদ্ধার করে। আহত তিনজনকেই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়।

জানা গেছে, দুপুরে প্রকাশক টুটুলসহ কয়েকজন ছিলেন ওই কার্যালয়ে। বেলা আড়াইটার দিকে সেখানে হানা দেয় কয়েকজন দুর্বৃত্ত। বিকাল সোয়া ৩টার দিকে লেখক রণদীপম বসু ফেসবুকে লেখেন : কুবাইছে (কুপিয়েছে), আমি টুটুল ভাই আর তারেক।

অভিজিৎ রায়ের বইয়ের প্রকাশক আহমেদুর রশীদ চৌধুরী টুটুলকে মারতেই হামলাকারীরা এসেছিল বলে তার কার্যালয়ে উপস্থিত একজন জানিয়েছেন। গতকাল দুপুরে লালমাটিয়ার সি ব্লকে টুটুলের প্রতিষ্ঠান শুদ্ধস্বর কার্যালয়ে যখন হামলা হয়, তখন কয়েকজনের সঙ্গে এই তরুণও সেখানে ছিলেন। তিনি জানান, দুর্বৃত্তরা কুপিয়ে অফিসকক্ষে তালা লাগিয়ে চলে যায়। পুলিশ এসে তালা ভেঙে ভিতরে ঢোকে। ভিতরে আটকা পড়া ওই তরুণ নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “তারা (হামলাকারী) ছিল তিনজন। তারা ঢুকেই বলেছিল, ‘আমরা টুটুলকে মারতে এসেছি’। তিনি বলেন, বাইরে থেকে দরজায় নক করা হলে পিয়ন রাসেল দরজা খুলে দেয়। এ সময় এক ব্যক্তি বই বের করবে বলে জানায়। ওই সময় আরও একজন দরজায় নক করে। তখন ওই ব্যক্তি বলেন, তার ভাই বাইরে অপেক্ষায় রয়েছে। দরজা খুলে দিলে আরও দুই যুবক ভিতরে প্রবেশ করে। ভিতরে ঢুকেই আমাকে ও পিয়নকে পাশের ঘরে পিস্তলের মুখে জিম্মি করে ফেলে। প্রথমে যে ঢুকেছিল তার কাছে কালো ব্যাগ ছিল। সেখান থেকে চাপাতি বের করে। তাদের অন্য ঘরে জিম্মি করে রাখে। পরে তারা পাশের ঘরে যায়। দুজন মিলে টুটুলসহ তিনজনকে কোপাতে থাকে। আগে টুটুলকে লক্ষ্য করে একজন গুলি চালায়। ৫-৬ মিনিটে তারা কাজ শেষ করে তালা লাগিয়ে চলে যায়। যাওয়ার সময় আরও এক রাউন্ড গুলির শব্দ শুনি। শুদ্ধস্বরের কার্যালয় ভবনের সামনের একটি দরজি দোকানের কর্মচারী বলেন,  চিৎকার শুনে আমরা ওইদিকে খেয়াল করে দেখি একটি মোটরসাইকেলে করে তিনজন দ্রুত বের হয়ে যাচ্ছে।’ শুদ্ধস্বরের কার্যালয়ের পাশের ফ্ল্যাটের বাসিন্দা এক শিক্ষক বলেন আমি বাথরুমে ছিলাম। চিৎকার শুনে বাইরে বেরিয়ে দেখি পাশের ফ্ল্যাটের তালা ভেঙে পুলিশ তিনজনকে উদ্ধার করছে। টুটুলের এক বন্ধু বলেন, “টুটুলের ফোন থেকে আড়াইটার দিকে কল আসে। আমি রিসিভ করি। তার কর্মচারী রাসেল আমাকে বলে, আমাদের রক্ষা করেন। আমাদের কুপিয়ে তালা মেরে চলে গেছে’। তখন আমি পুলিশকে জানাই। ওই ভবনের দ্বিতীয় তলায় একটি কোচিং সেন্টার রয়েছে। ওই কোচিংয়ের এক ছাত্র বলেন, নিচের কলাপসিবল গেটটিতেও তালা মেরে দিয়েছিল হামলাকারীরা। পুলিশ এসে ওই তালা খোলে। পুলিশ গিয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় টুটুল, তারেক ও রণদীপমকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠায় বলে মোহাম্মদপুর থানার ওসি জামাল উদ্দিন মীর জানান। ৩টার দিকে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, চতুর্থ তলায় শুদ্ধস্বরের কার্যালয়ে ছোপ ছোপ রক্ত। সিঁড়িতেও রক্তের দাগ। পুরো কার্যালয় উলট পালট।

এদিকে টুটুলসহ তিনজনকে হাসপাতালে নেওয়ার পর সেখানে ভিড় জমে। প্রকাশক হত্যা ও জখম করার প্রতিবাদে ইমরান এইচ সরকারের নেতৃত্বে গণজাগরণ মঞ্চ শাহবাগে প্রজš§ চত্বরে বিক্ষোভ মিছিল করেছে। পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার বিপ্লবকুমার সরকার বলেন, ‘ঘটনা কারা ঘটিয়েছে, এখনো চিহ্নিত করা যায়নি। তবে তিনজনের জড়িত থাকার বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে। আমরা ঘটনাস্থলে তদন্ত করে দেখছি। ঘটনাস্থল থেকে একটি তাজা গুলি ও খোসা উদ্ধার করা হয়েছে বলে জানান তিনি। ফেব্রুয়ারিতে টুটুলের জিডির পর কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিলÑ জানতে চাইলে পুলিশ কর্মকর্তা বিপ্লব বলেন, ‘জিডি করেছিল কিনা, মনে নেই। তারা যখনই পুলিশের সাহায্য চেয়েছে, তা দেওয়া হয়েছে।’ নিহত দীপনের বাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সাবেক শিক্ষক আবুল কাসেম ফজলুল হক এবং মা একই বিভাগের সাবেক শিক্ষক ফরিদা প্রধান। নিহতের একমাত্র বোন ঢাবির ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষক সুচিতা শারমিন। দীপনের স্ত্রী ডা. রাজিয়া রহমান ঢাবির সুফিয়া কামাল হলের সিনিয়র চিকিৎসক। ওই দম্পতির ষষ্ঠ শ্রেণি পড়–য়া ছেলে রিদাত ফারহান এবং অষ্টম শ্রেণি পড়–য়া মেয়ে রিদমা আদনান উদয়ন স্কুলে পড়ছে। দীপন পরিবার নিয়ে ঢাবির সুফিয়া কামাল হলের কোয়ার্টারে থাকতেন। ৫ নভেম্বর শাহবাগ পাবলিক লাইব্রেরি চত্বরে অনুষ্ঠেয় হেমন্তের বইমেলার আহ্বায়ক ছিলেন দীপন। কো-অপারেটিভ দোকান মালিক ও ব্যবসায়ী সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক মোরসালিন আহমেদ জানান, আজিজ মার্কেটের প্রতিটি প্রবেশপথে সিসিটিভি রয়েছে। ২৪ ঘণ্টা-ই তা সক্রিয় থাকে।

ইইউ ও যুক্তরাজ্যের নিন্দা: ব্লগারদের ওপর ফের আক্রমণের তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন ঢাকাস্থ ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত পিয়ারে মায়দু ও ব্রিটিশ হাইকমিশনার রবার্ট গিবসন। গতকাল পৃথক বার্তায় তারা এই নিন্দা প্রকাশ করে ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বিচার দাবি করেন। গিবসন তার টুইট বার্তায় বলেন, আমি ব্লগারদের ওপর ফের আক্রমণের নিন্দা জানাচ্ছি। সহিংসতা কোনো জবাব হতে পারে না। কোনো অবস্থাতেই এটি গ্রহণযোগ্য নয়। এখানে মত প্রকাশের অধিকার সুরক্ষা জরুরি। পিয়েরে মায়দু তার বার্তায় ঘৃণ্য এই অপরাধের দ্রুত বিচার দাবি করেন।

 

সর্বশেষ খবর