বুধবার, ৪ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা
৩ নভেম্বরের অজানা অধ্যায়

খন্দকার মোশতাকের সেই জবানবন্দি কোথায়

কর্নেল অব. জাফর ইমাম, বীরবিক্রম

শফিকুল ইসলাম সোহাগ

জেলহত্যার স্বীকারোক্তি দিয়ে মোশতাক জবানবন্দি দিয়েছিলেন। তা রেকর্ড করা হয়েছিল। সেই ক্যাসেটটি আর্মির ৪৬ ব্রিগেড (বিএম)-এর কক্ষে সংরক্ষিত ছিল। বিএনপির বর্তমান ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন এ বিষয়ে পুরো তথ্য জানা থাকার কথা। অনুসন্ধান করে এই ক্যাসেটটি যদি জাতির সামনে প্রকাশ করা হয় তাহলে জেলহত্যার বিচার সম্পন্ন করার পথ আরও প্রশস্ত হবে। ১৯৭৫-এর ৩ নভেম্বর জেলহত্যা ঘটনার স্বীকারোক্তি দিয়ে মোশতাক জবানবন্দি দিয়েছিল ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারীদের কাছে।

প্রতি বছর আমরা ৩ নভেম্বর জেলহত্যা দিবস পালন করি। যে নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিচারের বাণী আজও নিভৃতে কাঁদে। অথচ ৩ নভেম্বর খালেদ মোশারফের নেতৃত্বে যে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটল তার সঠিক ধারাবাহিকতার ইতিহাস এবং এর মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য জাতি যদি না জানে তা হবে প্রকৃত ইতিহাস বিকৃতির শামিল। ৩ নভেম্বর খালেদের নেতৃত্বে এই সামরিক অভ্যুত্থানকে হালকাভাবে দেখার কোনো সুযোগ নেই। কারণ ৩ নভেম্বরের এই অভ্যুত্থান ছিল ওই সময়কার রাজনীতির টার্নিং পয়েন্ট। এ জন্য যে এই অভ্যুত্থান যদি সেদিন না হতো তাহলে এক. খন্দকার মোশতাক যে মন্ত্রিপরিষদ নিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করছিলেন মোশতাকের সেই টুপির রাজনীতি অব্যাহত থাকত। দুই. মোশতাক যদি আর দুই থেকে তিন মাস সময় পেতেন তাহলে আওয়ামী লীগের অবশিষ্ট নেতা-কর্মীরাও তার সঙ্গে একীভূত হয়ে যেত। এতে করে আওয়ামী লীগের আবার পুনরুজ্জীবিত হওয়ার শক্তি হারিয়ে যেত এবং দলটি কঠিন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হতো। তিন. মোশতাককে অপসারণ করে খালেদ নিজে সেনাপ্রধান হয়ে সায়েমকে নতুন করে প্রেসিডেন্ট পদে অধিষ্ঠিত করলেন। এতে করে আওয়ামী লীগ আবার পুরো শক্তি উদ্যম নিয়ে সব ধরনের ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে দল পুনর্গঠনে একটি বিরাট সুযোগ পেল। যদি এই সুযোগ না পেত তাহলে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ আজকের এই দলে পরিণত হতে পারত না। তাই বলব খালেদ যদিও মোশতাককে অপসারণ করে সায়েমকে বসিয়ে পরে নিজেই জাসদের হঠকারী অভ্যুত্থানের কারণে নিহত হলেন কিন্তু এর আগ মুহূর্তে মোশতাককে সরিয়ে সায়েমকে বসিয়ে তৎকালীন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তনে বিরাট সফলতা দেখিয়েছেন। ৭ নভেম্বর জাসদের হঠকারী ভূমিকার ও সিদ্ধান্তের কারণে বন্দী জিয়া রাজনীতিতে নতুনভাবে আবিভর্‚ত হয়েছিলেন এবং পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন। এর কৃতিত্ব তৎকালীন জাসদের। আমি তখন ক্যান্টনমেন্টে ১৫ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করছিলাম। সেখানে কমান্ডার ছিলেন কর্নেল হুদা। তিনি যুদ্ধ চলাকালে সেনাবাহিনীর চাকরিতে ছিলেন না। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় তিনি আসামি ছিলেন। যুদ্ধে অংশগ্রহণের কারণে স্বাধীনতার পর তাকে চাকরিতে পুনর্বহাল করা হয়েছিল। ৩ নভেম্বরের আগে ঢাকায় খালেদ মোশাররফ ও কয়েকজন অফিসারের সঙ্গে দেশের মধ্যেও সেনাবাহিনীতে বিরাজমান বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি ও করণীয় সম্পর্কে কর্নেল হুদা ও আমার আলাপ হয়েছিল। ২ নভেম্বর রাতে খালেদ মোশাররফ রংপুরে কর্নেল হুদার বাসায় টেলিফোন করেন। আমি সেই বাসায় আগে থেকেই কর্নেল হুদার আমন্ত্রণে অপেক্ষা করছিলাম এ জন্য যে, যে কেনো মুহূর্তে অপারেশন প্যানথারের নির্দেশ আসবে। খালেদ মোশাররফ কর্নেল হুদার সঙ্গে আলাপ রেখে আমাকে টেলিফোন দিতে বললেন, আমার সঙ্গে আলাপকালে তিনি শুধু কৌশল বিনিময় করলেন এবং বললেন, ‘কর্নেল হুদা থেকে তোমার ইউনিটের অনেক সুনাম শুনলাম। কিপ ইট আপ।’ তিনি আরও বললেন, হুদা তার যুদ্ধের অভিজ্ঞতার ওপর একটি বই লিখবে। আমাদের ২ নম্বর সেক্টরে তোমার বিলোনিয়া যুদ্ধের কাহিনীও হুদাকে শোনাবে এবং তার বইতে উল্লেখ করতে বলবে। টেলিফোনে যেহেতু এ সম্পর্কে আলাপ করা নিরাপদ নয় সে কারণে খালেদ ওই কৌশল বিনিময়ের মাধ্যমে আমাকে পূর্বের সিদ্ধান্ত কার্যকর হতে যাচ্ছে এই মেসেজটি পরোক্ষভাবে দিলেন।

আমি ও কর্নেল হুদা ৩ নভেম্বর খালেদ মোশাররফের সঙ্গে টেলিফোনে আলাপ করি এবং তাকে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী জানানো হয় যে, ১০ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে ইতিমধ্যেই ঢাকার উদ্দেশে রওনা হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ ইউনিট যুদ্ধের সময় আমার অধীনেই অধিষ্ঠিত হয়েছিল। এবং এর প্রতিষ্ঠাতা অধিনায়ক হিসেবে আমি এর দায়িত্ব পালন করেছিলাম। এবং যুদ্ধের সময় এই রেজিমেন্টকে ‘কে’ ফোর্স অর্থাৎ খালেদ মোশাররফ ফোর্সের অধীনে একটি ইউনিট ছিল বিধায় তার প্রতি আনুগত্য থাকবে। কর্নেল হুদা উপরোল্লিখিত কথাগুলো খালেদকে স্মরণ করিয়ে দিলেন এবং ১০ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে প্রথম ঢাকা পাঠানোর যৌক্তিকতা তুলে ধরলেন। এবং আরও বললেন, প্রয়োজনে জাফর ইমামের বর্তমান ইউনিট ১৫ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকেও ঢাকায় পাঠানো হবে। এ ছাড়া খালেদের পক্ষ থেকে কর্নেল হুদা আর আমার ওপর আরেকটি বাড়তি দায়িত্ব ছিল যশোর সেনানিবাস থেকে খালেদের বিরুদ্ধে যেন কোনো ইউনিট ঢাকার দিকে রওনা না হয় সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা। ব্রিগেডিয়ার শওকত যশোর ফেরিঘাট পর্যন্ত কড়া সতর্কতা ও নজর রাখতে বলেছিলেন, এই ব্যাপারে প্রস্তুতির কারণে আমরা খালেদের সঙ্গে একমত হলাম যে ৩ নভেম্বর আমরা উল্লিখিত দায়িত্ব পালনে ব্যস্ত থাকব এবং সব ঠিকঠাক করে ৪ তারিখ ভোরে ফ্লাই ক্লাবের ‘সেসনা’ উড়োজাহাজ নিয়ে আমরা ঢাকায় আসব। এমনিতে আমরা ঢাকার সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করছিলাম। ২ নভেম্বর মধ্যরাত থেকে ৩ নভেম্বর ভোররাত পর্যন্ত অপারেশন সফল করার জন্য ঢাকায় অবস্থানরত ইউনিটগুলো পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী বিভিন্ন পয়েন্টে এ অবস্থান গ্রহণ করে। অনুলিখন : শফিকুল ইসলাম সোহাগ।

সর্বশেষ খবর