বৃহস্পতিবার, ৫ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা
লেখকের অন্য চোখ

‘দাদা’ থেকে ‘কাকা’ হওয়াতে বিস্মিত হইনি

সমরেশ মজুমদার

এককালে যখন নিয়মিত বাজারে যেতাম তখন সবজির দোকানদার অথবা মাছের দোকানদার দেখতে পেলেই চেঁচিয়ে ডাকত, ‘আসুন দাদা, একদম টাটকা মাল পাবেন।’ তরুণ বা যুবক বয়সে ‘দাদা’ ডাকটা শুনতে ভালোই লাগত, যদিও যারা ডাকত তাদের কেউ কেউ আমার থেকে বয়সে অনেক বড় ছিল। এর বছর কুড়ি বাদে এক সকালে বাজারে গেলাম। মাঝখানের সময়টা আমার বদলে অন্য কেউ কাজটা করেছে। যাওয়ামাত্র শুনতে পেলাম, ‘আসুন কাকা, অনেক দিন পরে এলেন, একদম টাটকা মাল পাবেন।’ ‘দাদা’ থেকে ‘কাকা’ হওয়াতে বিস্মিত হইনি। দেখলাম লোকগুলোর বয়সও বেড়েছে। আবার পাঁচ বছরের ব্যবধানে বাজারে যেতেই ডাক শুনলাম, ‘আসুন জ্যেঠু, অনেক দিন পরে এলেন, একদম টাটকা মাল পাবেন।’ অর্থাৎ আমি ‘দাদা’ থেকে ‘কাকা’ হয়ে ‘জ্যেঠু’তে পৌঁছে গেছি, দোকানদারদেরও চুল উঠে গেছে অথবা সাদা হয়েছে। কারও জায়গায় তার ছেলে বসেছে। মাছ বিক্রি করত শিবু, জিজ্ঞাসা করতে ছেলেটি বলল, ‘বাবা তো তিন বছর আগে মরে গেছে।’ একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছি, কেউ আমাকে ‘মামা’ অথবা ‘মেসো’ বলে ডাকেনি। ‘মামা’ বা ‘মামু’ ডাকলে যে অন্তরঙ্গতা প্রকাশ পায়, তা বোধহয় ওরা আমার সঙ্গে চাইত না। এবার অনেক দিন বাজারে যাইনি। আমার বাড়ির তিন পাশে তিনটে বাজার। হাতিবাগান, শোভাবাজার এবং শ্যামবাজার। প্রথমটাতেই যাওয়া-আসা ছিল। কিন্তু মনে হলো, এবার বাজার পাল্টাতে হবে। মন বলছে, হাতিবাগানে গেলে নির্ঘাৎ হাঁক শুনব, ‘আসুন দাদু, অনেক দিন পরে এলেন, একদম টাটকা মাল পাবেন।’ ‘দাদা’ থেকে ‘কাকা’ ‘জ্যেঠু’ হয়ে ওরা আমাকে ‘দাদু’তে পৌঁছে দেবেই। যদিও যা বিক্রি করছে সেই মালগুলোর বয়স বাড়ছে না, একদম টাটকাই থেকে যাচ্ছে। আর ‘দাদু’ হচ্ছে এমন একটা অবস্থা যা অনেকটা মোহনায় পৌঁছে যাওয়া নদীর চেহারায় দেখা যায়। মুশকিল হলো, বয়স যে হচ্ছে এটা অনেকেই অনুভব করেন না। আমাদের ছেলেবেলায় দেখেছি, পঞ্চাশ পার হতে না হতেই বেশির ভাগ মানুষের হাতে লাঠি পৌঁছে যেত। ভোরে বা বিকালে, পাকা চুল বা টাকমাথার যে মানুষগুলো পার্কে বসে পুত্র বা পুত্রবধূর গুণগান করতেন, তাদের বয়স ষাট বা তার আশপাশে। সকালে বাজারে যেতেন। ফিরে এসে জলখাবার এবং খবরের কাগজ পড়ে সময় কাটিয়ে দুপুরের স্নান-খাওয়া শেষ করে লম্বা ঘুম। চা খেয়ে বিকালে একটু হাঁটতে যাওয়ার অসিলায় অন্যদের সঙ্গে আড্ডা মেরে সন্ধ্যের আগেই বাড়ি ফিরে রেডিও, পরে টিভির সামনে বসে খবর শোনার পর রাতের খাওয়া শেষ করে আবার বিছানায়। ছয়ের দশক পর্যন্ত এরা কেউ প্রেসারের ট্যাবলেটের কথা জানতেন না। সাতের দশকেও নিয়মিত প্রেসার বা সুগারের ওষুধ খাচ্ছেন এমন মানুষকে দেখছি বলে মনে পড়ছে না। স্মৃতি বলছে, ষাট থেকে সত্তরের মধ্যে বেশির ভাগ মানুষ গত হতেন। যারা আশি পেরিয়েও বেঁচে থাকতেন তাদের কথা লোকে বলাবলি করত। রিটায়ার করার পরে, মেয়ের বিয়ে দিয়েই নড়বড়ে হয়ে যেতেন অনেকেই। জীবন থেকে আর কিছু পাওয়ার কথা ভাবতেন না তারা।

অবস্থাটা বদলে গেল গত তিরিশ কি পঁয়ত্রিশ বছরে। শরীর ঠিকঠাক রাখতে হবে এরকম মানসিকতা তৈরি হয়ে গেল। বিশেষ করে সুগার এবং প্রেসার পরীক্ষা করে গলদ ধরা পড়লেই ডাক্তারের নির্দেশমতো ওষুধ খাওয়াটা বাধ্যতামূলক হয়ে গেল। ফলে সত্তর আর শেষ সীমা নয়, আশি পেরিয়েও দিব্যি আছেন অনেকে। জীবনযাপনের একটুও পরিবর্তন হয়নি অনেকের। এখনো এই মধ্যসত্তরে অনেকেই দুপুরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে রাত ১টার পরে বাড়ি ফেরেন। অবসরে আছেন এমন মানুষ সপ্তাহে তিন দিন বন্ধের পরে ক্লাবে গিয়ে রাত ১০টা পর্যন্ত আড্ডা মারতে ক্লান্ত হন না। সিএবির সভাপতি জগমোহন ডালমিয়া পঁচাত্তর বছরে চলে গেলেন শুনে আমাদের হাবুলদা মাথা নাড়লেন, ‘আচ্ছা। এত অল্প বয়সে চলে গেল ?’ হাবুলদা এখন অষ্টআশিতে, রোজ দুই কিলোমিটার স্বচ্ছন্দে হাঁটেন।

বয়স এখন কোনো সমস্যা নয়। আমার সঙ্গে যারা নিয়মিত আড্ডা মারেন তাদের অনেকেই ১০ বছর বা ১৫ বছরের ছোট। তারা যা পারেন, দেখেছি তা পারতে আমার অসুবিধে হচ্ছে না। গালুডি স্টেশনের একদিকে কোনো প্ল্যাটফর্ম নেই। যুবকরা তরতরিয়ে নামতে পারে। আমার মনে এসেছিল, পারব তো? পেরেও গেলাম কিন্তু পড়ে যাওয়ার ভয়টাকেও টের পেলাম। এই ভয়ের কথা সঙ্গীদের বলিনি।

নিত্য আয়নায় মুখ দেখি। দেখতে-দেখতে এতই অভ্যস্ত যে, পরিবর্তনটা তেমনভাবে চোখে পড়ে না। চুল পাতলা হয়েছে, সাদাটে হয়েছে, তবু। কিন্তু দিনসাতেক বিছানায় শুয়ে থাকতে বাধ্য হলে আয়নার দিকে তাকিয়ে ধাক্কা খেতেই হয়। কিন্তু চোখের তলায় চামড়া ঈষৎ ফুলে উঠল অথবা গলায় হাঁসের পায়ের ছাপ ফুটল, কিন্তু মন পাল্টাল কই? এখনো হাইওয়ে দিয়ে গাড়িতে যেতে যেতে শেষ বিকালের সূর্যের দিকে তাকালে ড্রাইভারকে বলি গাড়ি থামাতে। নিচে নেমে দেখি আকাশে সেই রঙের বাহার যা তরুণ বয়সে বা যৌবনেও দেখেছি অনেকবার। একটুও বদলায়নি। রঙের ওই খেলা যেমন বদলায়নি তেমনই তা দেখে মনে যে আবেগের ঢেউ ওঠে, তারও বদল হয়নি। আমি চেটেপুটে ওই সূর্য ডোবার পালা উপভোগ করলাম, আগে যেমন করতাম। ভালো কবিতা একইভাবে আমাকে আপ্লুত করে। বইমেলায় কোনো তরুণী পাঠিকা যখন এসে অটোগ্রাফ চায় তখন তার নাম জিজ্ঞাসা করি। কেউ-কেউ এমনভাবে তাকিয়ে নিজের নাম বলে যে নদীর ধারে ঢেউ এসে ছলাৎ ছলাৎ শব্দ তোলে। এগুলো বলে না... তোমার বয়স হয়েছে, নিজেকে গুটিয়ে ফেলো, চোখ বন্ধ করে ভাব তুমি এখন মরুভূমির মধ্যে এক ভরদুপুরে বসে আছ।

সর্বশেষ খবর