শিরোনাম
রবিবার, ৮ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

এমপির বেপরোয়া ভাতিজারা

শেখ সফিউদ্দিন জিন্নাহ্, ভালুকা (ময়মনসিংহ) থেকে ফিরে

এমপির বেপরোয়া ভাতিজারা

ভালুকা উপজেলায় তিন ভাতিজার নাম মানুষের মুখে মুখে। বেপরোয়া কাজকর্ম চালান বলে এরা এলাকায় ‘বিখ্যাত’। রসিকজনের মতে, ভালুকা সংসদীয় আসনে এমপি চারজন। একজন ঘোষিত আর তিনজন অঘোষিত। ঘোষিত এমপি হলেন অধ্যাপক ডা. এম আমান উল্লাহ। তিনি ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। এমপি আমানের তিন ভাতিজা এখন চালান সরকারি-বেসরকারি সব দফতর। রিকশাচালকের ওপর থেকে শুরু করে সকল পর্যায়ের ব্যবসা-বাণিজ্যে চলছে এমপির ভাতিজাদের খবরদারি। এ তিন ভাতিজা হলেন- ভালুকা উপজেলা আওয়ামী যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক রওনাক জাহান রব্বানী খাজা, যুবলীগ নেতা রিদুয়ান সারোয়ার রব্বানী, আরেক ভাতিজা লুৎফে ওয়ালী রব্বানী ওলি। আর এ তিন ভাতিজাই সকল কাজের ওস্তাদ। অভিযোগ আছে, আদরের তিন ভাতিজা দিনকে রাত, রাতকে দিন বললে এমপি তা-ই মেনে নেন। এমপি আমানের ভাতিজাদের অত্যাচারে যেমন সাধারণ মানুষ অতিষ্ঠ, তেমনি অতিষ্ঠ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। ভাতিজাদের বিরুদ্ধাচরণ করলেই ওই ব্যক্তির ওপর নামে নির্যাতনের খড়গ। নিজেদের একটি গোপন টর্চার সেলও রয়েছে। এ টর্চার সেলে একবার কেউ ঢুকলে আর অক্ষত ফেরে না। এমপি আমানের ভাতিজাদের অত্যাচারে উপজেলায় দাফতরিক কাজ করতে অস্বীকৃতি জানান বিভিন্ন কর্মকর্তা। ভাতিজাদের কবল থেকে রেহাই পাননি দলীয় নেতা-কর্মীরাও। আর বিরোধী দলের নেতারা তো অনেক আগে থেকেই এলাকাছাড়া। উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় অন্তত শতাধিক ছোট-বড় শিল্পকারখানা গড়ে উঠেছে। আর এসব শিল্পকারখানার মালিকদের প্রতি মাসে মোটা অঙ্কের চাঁদা দিতে হয়। না দিলে কারখানা বন্ধ করে দেওয়া হয়। ঈদ, পূজাসহ বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে এ তিন ভাতিজাকে নজরানা দিতে হয়।

ইজারা না নিয়েই এক ভাতিজার মর্জিতে দীর্ঘ তিন বছর ধরে বিরুনিয়া বাজার থেকে টোল আদায় করা হচ্ছে। এমপির ভাতিজা রিদুয়ান সারোয়ার রব্বানীর হুমকিতে প্রতি বছর ইজারার দরপত্রে কেউ অংশগ্রহণ করে না। ফলে সরকার মোটা অঙ্কের রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। অভিযোগ উঠেছে, পেছনে চাচা এমপির কেনা জমি থাকায় সামনে সড়ক ও জনপথ বিভাগের সরকারি খালি জায়গার লোভ সামলাতে পারলেন না ভাতিজা। জয়দেবপুর-ময়মনসিংহ চার লেন মহাসড়কের ভালুকা বাসস্ট্যান্ডের মতো জনবহুল এলাকায় প্রকাশ্যে স্থানীয় এমপির ভাতিজা লুৎফে ওয়ালী রব্বানী ওলি সওজের জায়গা দখল করে স্থাপনা নির্মাণ করেছেন। দখলকারী ভাতিজা ওলি ভালুকা আঞ্চলিক শ্রমিক লীগের কার্যকরী সভাপতি। সাইনবোর্ডবিহীন এ ঘরটি শ্রমিক লীগের অফিস বলে দাবি করা হলেও আঞ্চলিক শ্রমিক লীগ ভালুকা শাখার সভাপতি নজরুল ইসলাম সরকার ও সাধারণ সম্পাদক ইব্রাহিম খলিল জানান, তাদের অফিস অন্যত্র। বাসস্ট্যান্ড এলাকায় সওজের জায়গায় ঘরটি এমপির ভাতিজা ওলির ব্যক্তিগত অফিস। মাস ছয়েক আগে সড়ক ও জনপথ বিভাগের অধীনে জয়দেবপুর-ময়মনসিংহ মহাসড়ক চার লেন উন্নয়ন প্রকল্পের বাস্তবায়নের সময় ভালুকা বাসস্ট্যান্ড এলাকায় সওজের খালি জায়গার মধ্যে প্রথমে বাঁশ দিয়ে জায়গা দখল করা হয়। পরে এক সপ্তাহের মধ্যেই সেখানে ইট দিয়ে ওলির স্থাপনা নির্মাণ করা হয়। ভালুকা উপজেলা নির্বাহী অফিসার ‘দখলদারি রুখে দাও’ মর্মে ময়মনসিংহ সওজ বিভাগকে কয়েক দফা চিঠি দিলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ভালুকা পৌরসভার মেয়র ডা. এ কে এম মেজবাহ উদ্দিনের ধারণা, সওজের সঙ্গে আলোচনা করেই সম্ভবত এ জায়গায় স্থায়ী স্থাপনা গড়ে তোলা হয়েছে। তবে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফা বলেন, এমপির ভাতিজা সড়ক ও জনপথের জমি দখল করে ঘর তুলেছেন। সওজের ভালুকা অফিসের উপসহকারী প্রকৌশলী মো. মহসিন মোল্লা বলেন, নির্বাহী প্রকৌশলী স্যার ওই জমি দখলমুক্ত করতে অচিরেই ম্যাজিস্ট্রেট নিয়ে উচ্ছেদ অভিযান চালাবেন। এ ব্যাপারে সওজের ময়মনসিংহের নির্বাহী প্রকৌশলী শামীম আল মামুন বলেন, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের পাশে খালি জায়গা এখন চার লেন উন্নয়ন প্রকল্পের অধীনে। কাজ শেষে তাদের বুঝিয়ে দিলে দখলকারীদের উচ্ছেদ করা হবে। তিনি দখলকাজে তার অফিসের সঙ্গে সমঝোতার কথা অস্বীকার করে বলেন, সার্ভেয়ারকে পাঠিয়ে বিষয়টির খোঁজ নেওয়া হবে। জয়দেবপুর-ময়মনসিংহ মহাসড়ক চার লেন উন্নয়ন প্রকল্পের প্রকল্প ব্যবস্থাপক আবু সাঈদ মো. নাজমুল হুদা জানান, কাজ হওয়ার সময় ভালুকা বাসস্ট্যান্ড এলাকায় জায়গা দখলের বিষয়টি জানতে পেরে কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়। বর্তমানে কী অবস্থা তা তিনি জানেন না। এমপির ভাতিজা উপজেলা যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক রওনাক জাহান রব্বানী খাজা তার নামকরণে রাস্তা পাকাকরণের কথা স্বীকার করে বলেন, এলাকাবাসী তার নামে রাস্তা করে। আরেক ভাতিজা আঞ্চলিক শ্রমিক লীগের ভালুকা শাখার কার্যকরী সভাপতি লুৎফে ওয়ালী রব্বানী ওলি বলেন, সওজের জায়গা ছেড়ে দিতে বললে তিনি নির্মিত ঘর তুলে নিয়ে যাবেন। বিরুনিয়া বাজারের বিনা টেন্ডারে টোল আদায়ের বিষয়ে এমপির ভাতিজা রিদুয়ান সারোয়ার রব্বানী জানান, এর সঙ্গে তিনি সংশ্লিষ্ট নন। এসব বিষয়ে জানতে ফোন করা হলে এমপি ফোন রিসিভ করেননি। ভালুকা উপজেলা যুবলীগের আহ্বায়ক ও উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম পিন্টু বলেন, ‘আমি যুবলীগের আহ্বায়ক হলেও যুগ্ম আহ্বায়ক রওনাক জাহান রব্বানী খাজার ক্ষমতাই বেশি। কারণ তিনি এমপির ভাতিজা।’ স্থানীয়দের অভিযোগ, এমপি ডা. এম আমান উল্লাহ ভাতিজাদের অতিরিক্ত প্রশ্রয় দেন। তার এ দুর্বলতাকে এলাকার উন্নয়ন স্বার্থে ব্যবহার করেছে ধীতপুর ইউনিয়নের মানুষ। সরকারি সড়ক হলেও তাদের চলাচলের সড়কটি উন্নয়নের আওতায় আসেনি। সেই সড়কের নাম নিজের নামে রাখলে উন্নয়ন করানোর প্রতিশ্রুতি দেন এমপির ভাতিজা রওনাক জাহান রব্বানী খাজা। বাধ্য গ্রামবাসী তাই সেই সড়কটির নামফলকে লিখে দিল এমপির ওই ভাতিজার নাম। ‘বহুলী রওনাক জাহান রব্বানী খাজা রোড’ নাম রাখা মাত্রই সেটিতে এমপির সুদৃষ্টি পড়ে। সরকারি নাম পাল্টে ভাতিজার নামে রাখা এ সড়কটির পাকাকরণ কাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন এমপি ডা. আমান উল্লাহ। গত ১৮ আগস্ট উপজেলার ধীতপুর ইউনিয়নের বহুলীতে এ সড়কের আনুষ্ঠানিক ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। বহুলী ওয়ার্ড যুবলীগের সাবেক সভাপতি ফকরুল হাসান রুনু ভাতিজা খাজার নামে রাস্তার ফলক এমপির উন্মোচনের বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, বহুলী দাখিল মাদ্রাসা প্রাঙ্গণে এ উপলক্ষে আলোচনা সভায় এমপি বক্তব্য দেন। ধীতপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শফিকুল ইসলাম কামাল বলেন, অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে জানতে পারি সংসদ সদস্যের ভাতিজার নামে রাস্তা পাকাকরণের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন হচ্ছে। তবে এলজিইডির উপজেলা প্রকৌশলী কবির উদ্দিন শাহ বলেন, এমপি রাস্তা নির্মাণের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করলেও এখনো কাজ শুরু হয়নি। কবে নাগাদ কাজ হবে বা কত টাকা বরাদ্দ- এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে রাজি হননি তিনি।

 

 

সর্বশেষ খবর