বুধবার, ১৮ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

মুজাহিদের রায় আজ সাকার শুনানি হয়নি

নিজস্ব প্রতিবেদক

মুজাহিদের রায় আজ সাকার শুনানি হয়নি

মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের রিভিউ (পুনর্বিবেচনা) আবেদনের ওপর আজ বেলা সাড়ে ১১টায় আদেশ দেবেন আপিল বিভাগ। শুনানি শেষে গতকাল প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে চার সদস্যের আপিল বিভাগ এ দিন ধার্য করেন। বেঞ্চের অন্য সদস্যরা হলেন বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী। এই বেঞ্চে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আরেক আসামি বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর রিভিউ আবেদনের ওপর গতকাল শুনানির দিন ধার্য থাকলেও তা হয়নি। আজ এ বিষয়ে শুনানি হওয়ার কথা রয়েছে। আপিল বিভাগের আজকের কার্যতালিকায় সাকা চৌধুরীর রিভিউ আবেদনটি শুনানির জন্য ৩ নম্বর ক্রমিকে রয়েছে। মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের আগে মুজাহিদ ও সাকার শেষ আইনি সুযোগ এই রিভিউ আবেদন। এ আবেদনে রায়ের কোনো পরিবর্তন না হলে তাদের সামনে রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চাওয়ার সুযোগই কেবল বাকি থাকবে। এদিকে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামীর আপিল শুনানি অনুষ্ঠিত হয়েছে। আপিল বিভাগের একই বেঞ্চ শুনানি আজ পর্যন্ত মুলতবি করেন। শুনানি উপলক্ষে সুপ্রিমকোর্ট প্রাঙ্গণে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। আদালতে প্রবেশের ক্ষেত্রে প্রত্যেকের পরিচয় নিশ্চিতের পাশাপাশি সন্দেহভাজনদের তল্লাশি করা হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য মোতায়েনের পাশাপাশি সাদা পোশাকে বাড়ানো হয় গোয়েন্দা নজরদারি।

মুজাহিদের রিভিউ শুনানি শেষে আসামিপক্ষের প্রধান আইনজীবী খন্দকার মাহবুব বলেন, ‘মুজাহিদ খালাস পাবেন বলে আশা করি।’ তবে রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, ‘আশা করি মুজাহিদের ফাঁসি বহাল থাকবে।’ সকাল ৯টা ০৪ মিনিটে মুজাহিদের রিভিউ শুনানি শুরু হয়ে বেলা ১১টা পর্যন্ত চলে। পরে বিরতি দিয়ে সাড়ে ১১টায় শুরু হয়ে তা চলে ১২টা পর্যন্ত। প্রথমে মুজাহিদের পক্ষে তার আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন শুনানি করেন। তাকে সহযোগিতা করেন আইনজীবী এস এম শাহজাহান ও শিশির মনির। খন্দকার মাহবুবের শুনানি শেষে রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম শুনানি করেন। শুনানির সময় ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু, প্রসিকিউটর সৈয়দ হায়দার আলী, রানা দাশগুপ্ত, তুরিন আফরোজ প্রমুখ আইনজীবী আদালতে উপস্থিত ছিলেন।

আমরা খালাসের জন্যই যাই :  শুনানি শেষে আসামিপক্ষের প্রধান আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, ‘যেসব সাক্ষীর ওপর ভিত্তি করে মুজাহিদকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে তা বেআইনিভাবে হয়েছে। এ জন্য এ রায়ের পুনর্বিবেচনার আবেদন জানানো হয়েছে। আদালত আমাদের বক্তব্য ধৈর্যসহকারে শুনেছেন। আশা করি তিনি খালাস পাবেন।’ রায়ের বিষয়ে প্রত্যাশা সম্পর্কে জানতে চাইলে খন্দকার মাহবুব সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা যখন মামলা করতে যাই, তখন সব সময়ই প্রত্যাশা করি, আসামি খালাস পাবেন।’ তিনি বলেন, ‘এখানে কিন্তু আমরা সব অভিযোগের বিরুদ্ধে যাইনি। আমাদের বক্তব্য একটিমাত্র চার্জে। যে চার্জে তাকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে।’ খন্দকার মাহবুব বলেন, ‘আমরা দেখিয়েছি, আলবদরের কমান্ড ছিল আর্মি কমান্ড। সেটি আমরা মুনতাসির মামুনের একটি বই থেকে নিয়াজী সাহেবের ইন্টারভিউয়ে দেখিয়েছি। নিয়াজী সাহেব বলেছেন, আলবদর, আলশামস সরাসরি আর্মি কমান্ডে ছিল।’ তিনি বলেন, ‘আমরা বলেছি, অন্য কেস যখন আমরা করেছি, তখন মামলায় যারা আসামি ছিলেন, তাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছিল, অমুক স্থানে তারা হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে, আগুন দিয়েছে, নির্যাতন করেছে। কিন্তু মুজাহিদের বিরুদ্ধে চার্জে তার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ নেই।’

সাজা কমলে দেশবাসী হতাশ হবে : তবে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেন, বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে মুজাহিদের সাজা কমানো হলে দেশবাসী হতাশ হবে। তিনি বলেন, মুজাহিদ সে সময় ছাত্রসংঘের সভাপতি হিসেবে আলবদর বাহিনীর সদস্যদের উৎসাহিত করেছেন, অনুপ্রেরণা দিয়েছেন। এ জন্য তাকে দেওয়া আপিল বিভাগের মৃত্যুদণ্ডের রায় সঠিক হয়েছে। কেননা দেশকে মেধাশূন্য করতে সে সময় আলবদর বাহিনী বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছে। তিনি মুক্তিযোদ্ধা ও বুদ্ধিজীবীদের নিশ্চিহ্ন করার আহ্বান জানিয়েছেন। ঢাকার মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারে বুদ্ধিজীবীদের ওপর রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীর নির্যাতনের সঙ্গে মুজাহিদের সম্পৃক্ততা ছিল। মাহবুবে আলম বলেন, ‘মানবতাবিরোধী অপরাধে সরাসরি অংশ নিতে হবে, এ আইনে এমনটি নেই। মুজাহিদের আইনজীবীরা তার পক্ষে আদালতে যেসব বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন, তার বিরুদ্ধে আমি আদালতে যুক্তি তুলে ধরেছি।’ অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘আইনজীবীরা আদালতে বলেছেন, একাত্তরে মুজাহিদ বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ নেননি। আমি বলেছি, মানবতাবিরোধী অপরাধে মুজাহিদ আলবদর বাহিনীর সদস্যদের উৎসাহিত করেছেন, অনুপ্রেরণা দিয়েছেন, সহযোগিতা করেছেন। এ জন্য তার সাজা বহাল থাকা উচিত।’ এর আগে ১৬ জুন আপিল বিভাগের এ বেঞ্চ একাত্তরে আলবদর বাহিনীর প্রধান মুজাহিদের আপিলের রায় ঘোষণা করেন। রায়ে মুজাহিদকে দেওয়া ট্রাইব্যুনালের ফাঁসির আদেশ বহাল রাখেন আপিল বিভাগ। ২৯ জুলাই সাকা চৌধুরীকে দেওয়া ট্রাইব্যুনালের ফাঁসির রায়ও আপিল বিভাগ বহাল রাখেন। দুটি রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশিত হয় ৩০ সেপ্টেম্বর। এরপর আসামিপক্ষ মৃত্যুদণ্ড পুনর্বিবেচনা চেয়ে আপিল বিভাগে আবেদন করে। ইতিমধ্যে নিয়ম অনুযায়ী ট্রাইব্যুনাল দুজনের মৃত্যু পরোয়ানা জারি করে কারা কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠিয়েছেন। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে মুজাহিদকে এবং গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারে সাকা চৌধুরীকে সেই মৃত্যু পরোয়ানা পড়ে শোনানো হয়েছে। রিভিউ শুনানির অপেক্ষায় থাকা অবস্থায় সাকা চৌধুরী পাঁচ পাকিস্তানিসহ আটজনের সাক্ষ্য নেওয়ার জন্য ১৯ অক্টোবর আদালতে আবেদন করেন। সেই আবেদনে আদালতে গিয়ে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য ওই আটজনের নামে সমন জারির আরজি জানানো হয়। তবে ২ নভেম্বর শুনানি শেষে আপিল বিভাগ সাকার সে আবেদন খারিজ করে দেন।

ট্রাইব্যুনালে মুজাহিদের বিচার হয় সাত অভিযোগে। এর মধ্যে বিচারিক আদালতে প্রমাণিত প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড, তৃতীয় অভিযোগে পাঁচ বছর ও পঞ্চম অভিযোগে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয় তাকে। প্রমাণিত না হওয়ায় দ্বিতীয় ও চতুর্থ অভিযোগ থেকে খালাস পান মুজাহিদ। রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন তিনি। আপিলে প্রথম অভিযোগে খালাস পান তিনি। তবে প্রমাণিত হয় তৃতীয়, পঞ্চম, ষষ্ঠ ও সপ্তম অভিযোগ। একাত্তরে বুদ্ধিজীবী হত্যার ষষ্ঠ অভিযোগে মুজাহিদকে দেওয়া ট্রাইব্যুনালের ফাঁসির আদেশ বহাল রাখেন আপিল বিভাগ। তৃতীয় ও পঞ্চম অভিযোগে বিচারিক আদালতের দেওয়া দণ্ড বহাল রাখেন সর্বোচ্চ আদালত। আর ট্রাইব্যুনালে মৃত্যুদণ্ড হলেও দণ্ড কমিয়ে সপ্তম অভিযোগে যাবজ্জীবন সাজা দেওয়া হয় আসামিকে। বাকি দুই অভিযোগে ট্রাইব্যুনালে খালাস পাওয়ায় এর বিরুদ্ধে আপিল করেননি মুজাহিদ। তৃতীয় অভিযোগ, একাত্তরের জুনের প্রথম সপ্তাহে ফরিদপুরের রথখোলা গ্রামের রণজিৎ নাথ ওরফে বাবু নাথকে খাবাসপুর মসজিদের কাছ থেকে ধরে পুরাতন সার্কিট হাউসে নিয়ে যায় রাজাকাররা। সেখানে উপস্থিত মুজাহিদের ইঙ্গিতে রাজাকার ও অবাঙালিরা হত্যার উদ্দেশ্যে বিহারি ক্যাম্পের পূর্ব দিকে জনৈক আবদুর রশিদের বাড়িতে নিয়ে নির্যাতন করে তাকে। পরে পালিয়ে যান বাবু নাথ। পঞ্চম অভিযোগ, আগস্টের ৩০ তারিখ রাতে মতিউর রহমান নিজামীকে সঙ্গে নিয়ে নাখালপাড়ার পুরাতন এমপি হোস্টেলে পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্পে যান মুজাহিদ। সেখানে আটক সুরকার আলতাফ মাহমুদ, জহির উদ্দিন জালাল, বদি, রুমি, জুয়েল ও আজাদকে গালাগাল করেন তারা। পরে সেখানে অমানবিক নির্যাতনের পর মুজাহিদ একজন ছাড়া বাকিদের হত্যা করেন তার সহযোগীদের সহযোগিতায়। ষষ্ঠ অভিযোগ, মোহাম্মদপুরের ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে (বর্তমানে শারীরিক শিক্ষা কলেজ) পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্পে দলীয় নেতাদের নিয়ে বাঙালি নিধনের পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্র করতেন মুজাহিদ। এরই ধারাবাহিকতায় ১০ ডিসেম্বর থেকে শুরু হয় বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড। সপ্তম অভিযোগ, ১৩ মে বেলা ২টা থেকে আড়াইটার মধ্যে রাজাকার কালু বিহারি, ওহাব, জালাল ও অন্যান্যের সঙ্গে গাড়িতে করে ফরিদপুরের কোতোয়ালি থানার খলিলপুর বাজারে শান্তি কমিটির কার্যালয়ে যান মুজাহিদ। সেখানে সভার পর সহযোগীদের নিয়ে হিন্দু-অধ্যুষিত বাকচর গ্রামে হামলা চালান তিনি। বীরেন্দ্র সাহা, নৃপেণ সিকদার, সানু সাহাসহ কয়েকজনকে হত্যা করা হয় মুজাহিদের নির্দেশে। রাজাকাররা এ সময় ধর্ষণ করে এক হিন্দু নারীকে।

সর্বশেষ খবর