বুধবার, ১৮ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

বিদেশে বন্দী ১০ হাজার বাংলাদেশি

কূটনৈতিক প্রতিবেদক

বিদেশে বন্দী ১০ হাজার বাংলাদেশি

বিশ্বের ৪২টি দেশের কারাগারে বন্দীদশায় দিন কাটাতে হচ্ছে প্রায় ১০ হাজার বাংলাদেশিকে। তাদের দেশে ফেরানো তো দূরের কথা দেশের ঠিক কতজন নাগরিক বিদেশের কারাগারগুলোতে বন্দী হয়ে আছেন তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই সংশ্লিষ্টদের কাছে। প্রতিবেশী দেশ ভারতের কারাগারেই যে পাঁচ হাজার বাংলাদেশি বন্দী আছেন বলে ধারণা করা হয় তারও সঠিক তথ্য নেই কোনো সরকারি দফতরে। বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কারণেই এ ধরনের পরিসংখ্যান রাখা সম্ভব হচ্ছে না। অনেক সময় বন্দীদের সম্পর্কে জানাও যায় না। কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে আটকে থাকা বাংলাদেশিদের মধ্যে রয়েছেন অবৈধ অনুপ্রবেশ ও মেয়াদোত্তীর্ণ অবস্থানকারী ছাড়াও চুরি, মাদক পাচারসহ রোমহর্ষক খুনের মতো অপরাধের সঙ্গে জড়িতরাও।

সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও প্রবাসীদের নিয়ে গবেষণা করা সংস্থাগুলোর বিভিন্ন সময়ের পরিসংখ্যানের  তথ্যানুসারে, বিশ্বের ৪২টি দেশে কমপক্ষে ১০ হাজার বাংলাদেশি বন্দী হয়ে আছেন। এই সংখ্যা প্রতিনিয়তই পরিবর্তনও হচ্ছে। হতভাগাদের উদ্ধারের গতি শ্লথ হলেও চেষ্টা ও উদ্যোগ উভয়ই আছে সরকারের। নাম পরিচয় নিশ্চিত হয়ে দ্বিপক্ষীয় বোঝাপড়ার মাধ্যমে ২৩ দেশে বন্দী থাকা বাংলাদেশিদের ধাপে ধাপে আইনি সেবা দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। তবে বাকি দেশগুলোতে থাকা আটকদের বিষয়ে কোনো পক্ষ থেকেই তেমন কোনো উদ্যোগ নেই। জানা যায়, প্রতিদিনই প্রচলিত ও অপ্রচলিত পথে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে বাংলাদেশিরা। ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় তারা বৈধ পথের পাশাপাশি যাচ্ছেন অবৈধ পথেও। অনেকেই গিয়ে আটক হচ্ছেন সেখানকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে। আবার অনেকে মেয়াদ শেষে বাড়তি অবস্থান করে অবৈধ হয়ে যাচ্ছেন। বেশিরভাগই লুকিয়ে থেকে কাজ করছেন। কেউ কেউ গ্রেফতার হচ্ছেন। প্রতিবেশী ভারতে নিয়মতান্ত্রিক পথ ছাড়াও বিভিন্নভাবে সীমান্ত পেরিয়ে যাওয়াদের সংখ্যাও কম নয়। ভারতীয় গণমাধ্যমগুলোর তথ্যানুসারে শুধু পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন কারাগারেই আছে প্রায় পাঁচ হাজার বাংলাদেশি। অন্যদিকে, দুর্গম পথে ইউরোপে পাড়ি দিতে গিয়ে আফ্রিকার দেশগুলোতে বন্দী হওয়া অনেকের তথ্যই পাওয়া যায় না। সেখানকার অনেক দেশেই নিয়মতান্ত্রিক কারাগারের কাঠামোই নেই। সেখানে হয়তো কোনো ঘরের মধ্যে আটকে রাখা হয় গ্রেফতার হওয়া ভাগ্যান্বেষীদের। সম্প্রতি পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী সব দূতাবাস থেকে তথ্য সমন্বয় করে জাতীয় সংসদকে জানান, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের জেলে প্রায় সাত হাজার বাংলাদেশি নাগরিক বর্তমানে আটক রয়েছেন। তবে এ সংখ্যা প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হচ্ছে। এর আগে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তৈরি করা ২০১৪ সালের একটি তালিকায় ৪২টিরও বেশি দেশের কারাগারে ৭ হাজার ৮৫৯ জন বাংলাদেশি নাগরিক আটক থাকার কথা উল্লেখ আছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলী জাতীয় সংসদে সাত হাজার বন্দীর তথ্য জানানোর ঠিক দুই মাস আগে তৎকালীন প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন সংসদকে ২৩ দেশে ৪ হাজার ৫৭৭ জন বন্দী থাকার তথ্য দেন। তবে ভারতের কেবল পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, ২০১১ ও ২০১২ সালে প্রতি মাসে গড়ে দেড় থেকে দুই হাজার বাংলাদেশিকে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন কারাগারে ঢোকানো হতো। গত ছয় মাসে এর সংখ্যা প্রায় চার হাজারে এসে দাঁড়িয়েছে। এই রাজ্যের ৫৭টি সংশোধনাগারের ৩২টিতেই বাংলাদেশি বন্দী রয়েছেন। কারাগারগুলোর মধ্যে তিনটিতে বেশি বাংলাদেশি আছেন। এর মধ্যে দমদম জেলে এক হাজার ৬৫ জন, বনগাঁ জেলে ৫০০ জন ও বালুর ঘাট কারাগারে ৩৫০ জন বাংলাদেশি বন্দী রয়েছেন। এ ছাড়া আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে দুই বছরের অধিক সময় ধরে জান খালাসি (শাস্তির মেয়াদ শেষ) হিসেবে ৫০০ এর বেশি বাংলাদেশি রয়েছেন। কারাগারে বন্দী ৩ হাজার ২৭৫ জন বাংলাদেশির মধ্যে বিচারাধীন ২ হাজার ৪৩ জন, সাজাপ্রাপ্ত ৭২৬ জন, জান খালাসের সংখ্যা ৩৪০ জন, অবশিষ্টরা এসব বন্দীদের সন্তানাদি। পররাষ্ট্র, প্রবাসী কল্যাণ ও দূতাবাসগুলোর তালিকা অনুসারে, বাংলাদেশিরা বন্দী আছেন মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, দক্ষিণ কোরিয়া, লেবানন, জাপান, মালদ্বীপ, ওমান, মিসর, ইরান, বুলগেরিয়া, চীন, ফ্রান্স, তুরস্ক, আজারবাইজান, কোরিয়া, ব্রুনাই, জাপান, জিম্বাবুয়ে, তাঞ্জানিয়া, আলজেরিয়া, জর্ডান, মরিশাস, বাহরাইন, সাইপ্রাস, ইয়েমেন, লেবানন, সিরিয়া, কম্বোডিয়া, বেলজিয়াম, জর্জিয়া, সুইডেন, সার্বিয়া, নেপাল, পোল্যান্ড, বসনিয়া হার্জেগোভিনা, নেদারল্যান্ডস, ইতালি, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে। এর মধ্যে আমিরাত, সৌদি আরব, বাহরাইন, ওমান, মিসর, কাতার, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে খুন ধর্ষণের মতো অপরাধে ইতিমধ্যেই মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয়ে কার্যকরের অপেক্ষায় আছেন ৩৪ জন। মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার মতো অপরাধে বিচার চলছে ১৪৮ জনের। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বললেন, মন্ত্রণালয় বা বিএমইটি বা মিশনের লেবার উইংয়ের সঙ্গে সবাই যোগাযোগ করেছে তা বলা যাবে না। তারপরও বিচ্ছিন্নভাবে তালিকা সংরক্ষণে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হয়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র মতে, আটক বা বন্দী বাংলাদেশির তথ্য জানার সঙ্গে সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দূতাবাসের কনস্যুলার শাখার কর্মকর্তারা ওই বাংলাদেশির সঙ্গে কারাগারে সাক্ষাতের অনুমোদন চান। পরে কনস্যুলার অ্যাক্সেসে সাক্ষাতের পাসপোর্ট বা অন্যান্য কাগজপত্র থাকলে পরীক্ষা করা হয়। না থাকলে আটক ব্যক্তির দাবিকৃত তথ্যগুলো সংগ্রহ করে দেশে সেই দাবির সত্যতা নিশ্চিত করা হয়। নাগরিকত্বের প্রমাণ হাতে আসার পর দ্রুততম সময়ে তাদের মুক্তি বা সহায়তা দেয় দূতাবাস।

সর্বশেষ খবর