বুধবার, ১৮ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা
পর্যবেক্ষণ

আমরা কি এই বাংলাদেশ চেয়েছিলাম

রোবায়েত ফেরদৌস

আমরা কি এই বাংলাদেশ চেয়েছিলাম

আমাদের এই বাংলাদেশ আজ কঠিন বাস্তবতার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। যতটা বোধ করতে পারছি সংকট তার চেয়ে ভয়াবহ। প্রশ্ন হচ্ছে, ’৭১-এ মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা এই বাংলাদেশ চেয়েছিলাম কিনা? এ প্রশ্ন আমাদের করতে হবে এবং এর উত্তরও খোঁজার চেষ্টা করতে হবে। আজকের বাংলাদেশে বই লেখার জন্য, ব্লগ লেখার জন্য, চিন্তা প্রকাশ করার জন্য জীবন দিতে হচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন খ্যাতিমান অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদকে একটি উপন্যাস লেখার জন্য তারই উপন্যাসের  মতো চাপাতির কোপে ‘ফালি ফালি করে কাটা চাঁদ’-এ পরিণত করা হয়েছিল। প্রশ্ন হচ্ছে বইতে কী থাকে? বইতে কিছু শব্দ থাকে, কিছু বাক্য থাকে। শব্দ এবং বাক্য দিয়ে লেখক তার চিন্তা-চেতনা প্রকাশ করে থাকেন। চিন্তা কারও বিরুদ্ধে যেতে পারে। কেউ এটা অপছন্দ করতেই পারেন। যারা এগুলো অপছন্দ করেন, তার চেয়ে তীব্র শব্দ দিয়ে, তার থেকে তীব্র বাক্য দিয়ে ১০টি বই লিখতে পারেন ১টি বইয়ের জবাবে। কিন্তু বইয়ের জবাব দেওয়া হচ্ছে চাপাতি দিয়ে, চিন্তার জবাব দেওয়া হচ্ছে বুলেট দিয়ে? এটি কোনো সভ্য সমাজের বৈশিষ্ট্য নয়। আমরা কি এই বাংলাদেশ চেয়েছিলাম? এ প্রশ্নটা আবার করতে হয়। যে অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশের স্বপ্ন সে সময় ছিল, সেটি মার খেয়ে যাচ্ছে, আমাদের পরাজিত মনে হচ্ছে নিজেকে। চিন্তা প্রকাশ করার জন্য, বই লিখবার জন্য প্রতিনিয়ত হত্যা করা হচ্ছে। কোথায় হত্যা করা হচ্ছে? অভিজিৎকে হত্যা করা হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, যেটাকে জাতীয় মুক্তচিন্তার প্রতীক বলা হয়। কখন করা হয়? একুশে ফেব্রুয়ারি। বাঙালি জাতির অসাম্প্রদায়িক চেতনা, আমরা বলি ’৭১-এর স্বাধীনতার প্রথম নমুনা। ’৪৮ থেকে পরবর্তীতে ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন। সেই একুশের মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে কলিজার ভিতরে হাত ঢুকিয়ে কলিজা ছিঁড়ে নিয়ে গেছে তারা! দেখিয়েছে দাম্ভিকতা, দুই দিকে পুলিশ দাঁড়িয়েছিল কিন্তু কিছু করতে পারেনি। জাগৃতি প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী ফয়সাল আরেফিন দীপনের হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটিও একই রকম। কয়েক শ’ গজ দূরে মাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।

নিরাপত্তা তাহলে কোথায়? প্রভাবশালী মন্ত্রী ক্ষমতাসীনদের ছাড়া কারও নিরাপত্তা নেই। চাইলে এই রাষ্ট্রে যে কেউ যে কাউকে হত্যা করতে পারে! পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে, র‌্যাব দাঁড়িয়ে আছে কেউ কিছু করতে পারছে না। কেউ ঠেকাতে পারছে না। কাজেই আমরা অনিশ্চয়তার দিকে যাচ্ছি কিনা? একটা বড় পাকিস্তান ভেঙে ছোট পাকিস্তানের স্বপ্ন কি আমাদের ছিল? স্বাধীন পাকিস্তানের স্বপ্ন কিংবা বাঙালি পাকিস্তানের স্বপ্ন? আমার জন্ম মুক্তিযুদ্ধের সময়। আমার ডাকনাম মুক্তি। যুদ্ধ শুরু হয়েছে তিন মাস, তারপর আমার মা-বাবা বলেছেন দেশ নিশ্চয় স্বাধীন হবে, এ আশা নিয়ে এবং দেশ স্বাধীনও হয়েছে। কিন্তু সেই স্বাধীনতার স্বপ্ন এত বছরেও পেয়েছি কিনা এ প্রশ্ন আমাদের করতে হবে। যারা সরাসরি যুদ্ধ করেছেন অস্ত্র হাতে তাদের গন্তব্য নিয়ে, চিন্তা নিয়ে। তাদের তো আরও বেশি কুরে কুরে খায় এ প্রশ্নগুলো। এ জন্য কি তারা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন?

জার্মানিতে হলোকাস্টে এক কোটির মতো ইহুদিকে নিধন করা করা হয়েছিল। নাৎসি পার্টিকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। কিন্তু এখানে কীভাবে জামায়াত রাজনীতি করে? কীভাবে এখানে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির জায়গা তৈরি হয়? কাজেই এখানেও আমাদের প্রশ্ন করতে হয় আমরা আর কত ছাড় দেব? আমরা তো দেখেছি এ রাষ্ট্রে জামায়াতের লোক মন্ত্রী হয়ে জাতীয় পতাকা গাড়িতে তুলে আমাদের বুকের ওপর দিয়ে চলে গেছে। আমরা কিছু করতে পারিনি। সাকা চৌধুরীর মতো চিহ্নিত রাজাকার আদালতের রায়ে দোষী প্রমাণিত হওয়ার পরও এখনো বিএনপির স্ট্যান্ডিং কমিটির মেম্বার! বিএনপি তাকে সেই কমিটিতে এখনো পর্যন্ত বহাল রেখেছে। একজন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত খুনি আসামি এখনো বিএনপির স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্য!! কাজেই এখানে স্বাধীনতা মার খেয়েছে, মুক্তিযুদ্ধ মার খেয়েছে!

মানুষ মানুষ হিসেবে বাঁচে তার চিন্তার জন্য, তার মুক্তবুদ্ধির জন্য। মানুষের ইতিহাস চিন্তার ইতিহাস। দার্শনিক ডেকার্টে বলেছেন, মানুষ, মানুষ হয় কেন? আমি চিন্তা করতে পারি, এ জন্যই আমি অস্তিত্ববান। যে সমাজের মানুষ চিন্তা করতে পারে না, যে সমাজ চিন্তা করতে পারে না সে সমাজ মৃত সমাজ। সে সমাজের মাংস শিয়ালে, কুকুরে খাবে। সে রকম একটা মৃত সমাজের দিকে আমরা যাচ্ছি কিনা? যেখানে বিরোধী চিন্তা কেউ সহ্য করতে পারছে না। আমি একা থাকব বাকিরা কেউ থাকবে না। ক্ষমতার ঝোঁকই হচ্ছে স্বৈরাচারী হয়ে ওঠা। বাসায় কাজের মেয়ে যদি তিনজন থাকে, তাহলে প্রধান কাজের মেয়ে বাকি দুজনের ওপর নির্যাতন করবে। ক্ষমতার ঝোঁকটা হচ্ছে এই রকম। যে কারণে সব রাজনৈতিক দার্শনিক চাইতেন যে ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। চেক অ্যান্ড ব্যালান্স করতে হবে। এটা না হলে কোনো রাষ্ট্র চলতে পারে না। আধুনিক রাষ্ট্রগুলোর গণতন্ত্র টিকে থাকার মূল কারণ, একটা প্রতিষ্ঠান আর একটা প্রতিষ্ঠানকে চোখে চোখে রাখবে, দেখে রাখবে। সরকারকে দেখবে সংসদ, সংসদকে দেখবে খবরের কাগজ- এভাবে। যদি কোনো বিচ্যুতি হয় তাহলে তাকে ধরবে। কিন্তু আমাদের এখানে প্রতিটি প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়ে গেছে। পুলিশ প্রশাসন বলুন, বিচার প্রশাসন বলুন, নির্বাচন কমিশন বলুন, দুদক বলুন আমরা কোনো প্রতিষ্ঠানকে বাঁচাতে পারিনি। যে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করতে পারে না সেই রাষ্ট্র ব্যর্থ হতে বাধ্য। আমরা এখনো কোনো প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করতে পারিনি। যে প্রতিষ্ঠানগুলো নির্মিত ছিল সেগুলোও আমরা একের পর এক ধ্বংস করে ফেলেছি। পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে। গ্যালিলিও টেলিস্কোপ দিয়ে তা প্রমাণ করেছিলেন। গ্যালিলিওর সময় পৃথিবীতে লোক ছিল ৮০ কোটির মতো। ওই সময় যদি নির্বাচন হতো গ্যালিলিও তার মতের পক্ষে মাত্র একটি ভোট পেতেন, নিজের ভোট। পৃথিবীর সব লোক তাকে একটি ভোট দিত না ‘যে পৃথিবী সূর্যের চারপাশে ঘোরে’। পুরো পৃথিবী ঘোরে জ্ঞানের শক্তির ওপর। জ্ঞানের শক্তি গণতন্ত্রের চেয়েও শক্তিশালী। সেই জ্ঞানকে সংকুচিত করা হচ্ছে, বৈরীভাবে। অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ, মুক্তবুদ্ধির যে বাংলাদেশের স্বপ্ন আমরা দেখেছিলাম তা অনেকখানি মার খেয়ে গেছে। যে বহুত্ববাদির স্বপ্ন আমরা দেখেছিলাম, এখানে বাঙালি, চাকমা, মারমা, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সবাই থাকবে; কিন্তু আজ এই রাষ্ট্রকে বাঙালি মুসলমান রাষ্ট্র বানানো হচ্ছে। কেবল বাঙালি, কেবল মুসলমান। অন্য কোনো ধর্মের মানুষ না, অন্য কোনো জাতির মানুষ না। এটাই কি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছিল? আমরা জানি যে মুক্তিযুদ্ধে চাকমা, মারমা, থেকে শুরু করে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সবাই অংশগ্রহণ করেছিল। তাহলে কেন রাষ্ট্র কেবল বাঙালির হবে? কেন কেবল মুসলমানের হবে? আমাদের যুদ্ধ কিন্তু অনেক কঠিন, অনেক শক্ত, অনেক প্রবল। আমরা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে গড়তে পারিনি। এ শিক্ষার মধ্য দিয়ে একটা আধুনিক, বিজ্ঞানমনস্ক, ধর্মনিরপেক্ষ জাতি তৈরি হতে পারে। এ শিক্ষাব্যবস্থার ওপর মানুষ তৈরি হবে। যে কারণে চীন এবং রাশিয়ায় বিপ্লবের পর শিক্ষাব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনা হয়েছিল। এ শিক্ষাব্যবস্থা ঠিক করতে, সঠিকভাবে গড়তে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। আমাদের নানারকম শিক্ষা চলছে যার মধ্যে কোনো সমন্বয় নেই। এ শিক্ষার মাঝে এই মনস্ক তৈরি হচ্ছে যে, আমার চিন্তাই ঠিক, বাকি চিন্তাগুলো ভুল। মৌলবাদীর জায়গা হচ্ছে এই জায়গা। কাজেই আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে সংস্কার করতে হবে। যে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার চলছে সে বিচারগুলো সম্পন্ন করতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর কাজ হবে জামায়াত কিংবা ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলকে অপ্রয়োজনীয় করে ফেলা, তাদের অপ্রাসঙ্গিক আর অপাঙ্ক্তেয় করে ফেলা। সমাজে তাদের কোনো জায়গা যেন না থাকে। শেষ করি বিখ্যাত সেই বয়ান দিয়ে যেখানে বলা হচ্ছে, ‘তারা একজন কবিকে নেওয়া হচ্ছে হত্যা করবার জন্য, কিন্তু আমি কোনো প্রতিবাদ করিনি কারণ আমি তো কবি না। তারপর একজন শিল্পীকে ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কিন্তু আমি প্রতিবাদ করিনি। কারণ আমি শিল্পী না। এরপর একজন বিজ্ঞানী নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, কিন্তু আমি প্রতিবাদ করিনি। কারণ আমি বিজ্ঞানী না। তারপর একদিন আসবে তারা আমাকেই ধরবে কিন্তু তখন প্রতিবাদ করার কেউ থাকবে না।’

রোবায়েত ফেরদৌস : সহযোগী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় [email protected]

সর্বশেষ খবর