সোমবার, ৩০ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

ডিজেলের দাম না কমায় বিপাকে কৃষকরা

এক তৃতীয়াংশ দাম কমেছে বিশ্ববাজারে দেশে বেশি, বাড়ছে পণ্য উৎপাদন খরচ

জিন্নাতুন নূর

বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম এক-তৃতীয়াংশ কমে এলেও দেশের বাজারে এখনো এর কোনো প্রভাব পড়েনি। বিশেষ করে ডিজেলের দাম না কমায় কৃষকদের উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে। আর বাড়তি খরচে পণ্য উৎপাদন করেও কৃষকরা তার নায্যমূল্য পাচ্ছেন না। এ কারণে কৃষকরা সার্বিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সেচকাজে ব্যবহৃত দেশের প্রায় ১৩ হাজার পানির পাম্প চলে জ্বালানি তেল দিয়ে। আর তেলের দাম যদি বিশ্ববাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে কমানো হতো তবে প্রতি মণ ধানে কৃষকদের ৫০ থেকে ৬০ টাকা উৎপাদন খরচ কমে যেত। আর এই টাকা সাশ্রয় হলে তারা বছরে অন্তত দুই  হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় করতে পারতেন। তাদের মতে, তেলের দাম কমালে এক ধরনের উৎপাদনমুখী তৎপরতা বৃদ্ধি পাবে। এতে অর্থনীতিকে একটি শক্তিশালী অবস্থানে নেওয়া যাবে। বিনিয়োগ পরিস্থিতি আরও ভালো হবে। কিন্তু সরকার তার রাজনৈতিক ভাবমূর্তি রক্ষা করতে বিভিন্ন কৃষিপণ্যের দাম কমালেও কৃষকদের উৎপাদন খরচ বেড়েই যাচ্ছে। মধ্যস্বত্বভোগীদের স্বার্থ রক্ষায় কৃষকদের ক্ষতি করা হচ্ছে। অন্যদিকে অনেক সময় ধরে কম দামে তেল কিনে তা বেশি দামে বিক্রি করে বিপুল অঙ্কের মুনাফা করছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। সর্বশেষ ২০১৩ সালে আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে যে উচ্চমূল্য নির্ধারণ করা হয়েছিল সে দামেই বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে অকটেন, পেট্রল, ডিজেল, কেরোসিন ও ফার্নেস অয়েল। এর আগে অব্যাহতভাবে তেলের দাম বাড়ানোর ফলে একই সঙ্গে পরিবহন ব্যয়, বিদ্যুৎ উৎপাদন ও কৃষিপণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পায়। আর এই ব্যয় বৃদ্ধির প্রভাব সরাসরি পড়েছে সাধারণ ভোক্তা ও কৃষকদের ওপর। বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের জ্বালানি তেলের চাহিদা ৫৪ লাখ ৮৪ হাজার ৯৬৬ মেট্রিক টন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় ডিজেল। ডিজেলের চাহিদা ৩২ লাখ ৪২ হাজার ৫৫৪ মেট্রিক টন। বিশ্ববাজারে দাম বাড়ার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে সর্বশেষ ২০১৩ সালের ৪ জানুয়ারি জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি করা হয়। কিন্তু এরপর প্রায় দুই বছর বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এলেও দেশে এর দাম আর কমানো হয়নি। জানা যায়, বিপিসি এখন ডিজেল, ফার্নেস অয়েল ও কেরোসিন বিক্রি করে প্রতি লিটারে লাভ করছে ২০ টাকা। আর অকটেন ও পেট্রল বিক্রি করে প্রতি লিটারে গড়ে ৪০ টাকা করে লাভ করছে। গত অর্থবছরে (২০১৪-১৫) বিপিসি চার হাজার কোটি টাকার মুনাফা করে আর চলতি অর্থবছরে বিপিসির মুনাফা ২ হাজার ২০০ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) থেকে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে দেশের মোট সেচ পাম্পের ৮০ শতাংশের উপর ডিজেলচালিত। আর দেশে সেচ করে ফসল উৎপাদনকারী কৃষকের সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ৬০ লাখ। এ কৃষকদের ৭০ শতাংশের বেশি ডিজেলচালিত সেচ পাম্প দিয়ে পানি সরবরাহ করে মোট সেচাধীন আবাদি জমির দুই-তৃতীয়াংশ ফসল উৎপাদন করেন। আর সেচ খরচ কমে গেলে কৃষকরা আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারবেন। এ ছাড়া বিদ্যুৎকেন্দ্র, শিল্প পরিবহন ও কৃষিকাজে ডিজেলের ব্যবহার বেশি। এর মধ্যে বিদ্যুৎকেন্দ্রের বাইরে অনান্য খাতে ডিজেল ব্যবহারের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই। এ জন্য এসব খাতে সরকার তেলের দাম কমানোর পক্ষে নয়। সংশ্লিষ্টরা বলেন, বাংলাদেশে আমদানি করা পেট্রলজাত পণ্যের দাম না কমানোয় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন কৃষক। দেশে ডিজেলে দাম না কমানোয় কৃষকরা এখন ধান উৎপাদনে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। কৃষকরা যদি ৬৮ টাকার বদলে ৫০ টাকায় ডিজেল কিনতে পারতেন তবে বর্তমানের চেয়ে আরও বেশি ধান উৎপাদন করতে উৎসাহিত হতেন। কারণ তারা যে দামে ধান উৎপাদন করেন বাজারে এর চেয়ে কম মূল্য পান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ আবু আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, কৃষকরা তাদের পণ্য উৎপাদনের জন্য মূলত ডিজেল ও কেরোসিনের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে মিল রেখে দেশে আমদানি করা তেলের দাম না কমানোয় কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। তেলের দাম না কমানোয় একদিকে তারা যেমন উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন অন্যদিকে পণ্য পরিবহন ব্যয়ও তাদের ক্ষতিগ্রস্ত করছে। তিনি বলেন, বিপিসি তেলের দাম না কমানোর বিষয়ে এখন যে তর্ক করছেন তা আমাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সঙ্গে কোনোভাবেই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। গ্যাসের মজুদ ঠিক রেখে এর মূল্য বাড়িয়ে পেট্রলজাত পণ্য অকটেন, ডিজেলের মূল্য কমানোর যৌক্তিকতা রয়েছে। তেল-গ্যাস-খনিজসম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা কমিটির সদস্য সচিব আনু মুহাম্মদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বাংলাদেশে তেলের দাম কমালে অর্থনীতির একটি নতুন গতি তৈরি হবে। এর ফলে ফসল উৎপাদন ব্যয় ও পরিবহন ভাড়া কমবে। কিন্তু সরকার জনগণের ভোগান্তি সম্পূর্ণভাবে অগ্রাহ্য করে কিছু লোকজনকে খুশি করতে এই গণবিরোধী সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ এ দুটি প্রতিষ্ঠানের কাছে সরকারের ‘মাথা নত অবস্থান-এর কারণে জ্বালানির দাম কমানো হয়নি। তিনি বলেন, দেশি-বিদেশি কিছু গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে সারা দেশের মানুষ যারা উৎপাদন ও পরিবহন ব্যয় কমলে লাভবান হতেন এবং উৎপাদন গতিশীলতা পেতো সেটি থেকে বাংলাদেশের মানুষকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। তিনি বলেন, কৃষক সেচের জন্য ডিজেল ব্যবহার করেন। জ্বালানির দাম না কমালে কৃষকদের ওপর এর প্রভাব পড়ে। কারণ কৃষকরা যে দামে খাদ্যপণ্য উৎপাদন করেন তার সঙ্গে তারা যে দামে বাজারে উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করে তার মধ্যে বড় ধরনের অসঙ্গতি রয়েছে। যেভাবে উৎপাদন ব্যয় বাড়ছে তার সঙ্গে তারা যে দামে বাজার থেকে তেল কিনছে তা মিলছে না। আমরা যে দামে কৃষি পণ্য কিনি তার চেয়ে অনেক কম দামে কৃষকরা বাজারে কৃষি পণ্য বিক্রি করেন। বাজারের মধ্যে কিছু গোষ্ঠীর আধিপত্যের কারণে এটা হয়। এরকম সংকটের মধ্যে উৎপাদন ব্যয় যদি কোনোভাবে কমানোর সুযোগ থাকে তবে কৃষক ও কৃষির জন্য তা হবে বড় উৎসাহব্যঞ্জক ঘটনা। কিন্তু সরকার সেই সুযোগ হাতছাড়া করছে। বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির নেতা রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, তেলের দাম না কমিয়ে জনগণের পকেট কাটা হচ্ছে। এর ফলে সাধারণ মানুষ বিশেষ করে কৃষক সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কারণ কৃষকের উৎপাদন খরচ ক্রমেই বেড়েই যাচ্ছে। অতীতের ভর্তুকি কমাতে বর্তমানে তেলের দাম না কমানোর জন্য অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের বক্তব্য অগ্রহণযোগ্য। এ জন্য আমাদের সবাইকে সোচ্চার হতে হবে। জ্বালানি তেলের দাম কমানো হলে যোগাযোগ খরচও কমত। এতে বিভিন্ন কৃষি পণ্যের দাম কমত। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা ম. তামিম বলেন, ডিজেলের দাম না কমানোয় সেচকাজে পানির পাম্পসহ গভীর নলকূপ ব্যবহার করছেন যে প্রান্তিক কৃষকরা তারা কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। কারণ যেসব মহাজন কৃষকদের কাছে এসব পাম্প ভাড়ায় দিচ্ছেন তারা অধিক মুনাফা করছেন। সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্টের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক রাজ্জেকুজ্জামান রতন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বোরো মৌসুম শুষ্ক হওয়ায় এ সময় প্রাকৃতিক পানির উৎস শুকিয়ে যায়। এ সময় তাদের সেচের জন্য এই পাম্পগুলোর প্রতি নির্ভর করতে হয়। কিন্তু তেলের দাম না কমানোয় পরিবহন ও সেচ খরচ বাড়ছে। আর মধ্যস্বত্বভোগীদের স্বার্থ রক্ষায় কৃষকদের ক্ষতি করা হচ্ছে। তিনি বলেন, ধনী ও মধ্যবিত্তদের সুবিধা দেওয়াই সরকারের লক্ষ্য। তারা গরিবদের স্বার্থ উপেক্ষা করছে। ব্যবসায়িক সুবিধা দেখছে। সবমিলিয়ে জনগণের দুর্ভোগ বাড়ছে আর মুষ্টিমেয়রা লাভবান হচ্ছেন।

সর্বশেষ খবর