শুক্রবার, ৪ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

অসন্তোষের অনল

ক্ষোভ নিয়ে যাত্রা শুরু আওয়ামী লীগের

গোলাম রাব্বানী ও রফিকুল ইসলাম রনি

অসন্তোষের অনল

নোয়াখালী জেলা, চাটখিল উপজেলা ও পৌরসভা আওয়ামী লীগ যৌথভাবে চাটখিল পৌরসভার দলীয় মেয়র প্রার্থী হিসেবে কেন্দ্রে পাঠায় জাকির হোসেন জাহাঙ্গীরের নাম। এর সঙ্গে স্থানীয় এমপি ও দলের সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতারাও তাকে সমর্থন দেন। সবার ধারণা ছিল জাহাঙ্গীরই পাবেন দলীয় মনোনয়ন। কিন্তু ঢাকায় এসে বদলে যায় সবকিছু। কেন্দ্র থেকে মনোনয়ন দেওয়া হয় মোহাম্মদ উল্লাকে। এতে হতাশ ও বিস্মিত স্থানীয় এমপি, পৌর, উপজেলা ও জেলার নেতারা। এ ‘ভুতুড়ে কাণ্ড’ কে ঘটিয়েছেন তা জানেন না তারা। একইভাবে দলীয় প্রতীকে প্রথমবারে মতো অনুষ্ঠেয় পৌরসভা নির্বাচনে এমপিদের স্ত্রী, পুত্র, জামাতাসহ আত্নীয়স্বজনদের মেয়র পদে মনোনয়ন দেওয়ায় হতাশ আওয়ামী লীগের ত্যাগী ও মাঠের নেতা-কর্মীরা। ঢাকার অদূরে একটি পৌরসভায় মেয়র পদে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে স্থানীয় এমপির স্ত্রীকে। এতে হতাশ, ব্যথিত হয়েছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা। নাম প্রকাশ না করে স্থানীয় এক নেতা বলেন, ‘তিনি এমপি, স্ত্রী হবেন পৌরসভার মেয়র আর পুত্র হলেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রক। আমাদের আর করার কিছুই নেই।’ একই অবস্থা পিরোজপুরেও। স্বরূপকাঠি পৌর মেয়র পদে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন স্থানীয় এমপির ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত গোলাম কবির। এ নিয়ে দলের প্রায় সবাই অসন্তুষ্ট। তাকে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা মেনে নিতে পারছেন না কোনোভাবেই।

সূত্রমতে, দলীয় প্রতীকে প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠেয় পৌরসভা নির্বাচনে মেয়র পদে আওয়ামী লীগের বেশির ভাগ অঞ্চলেই মনোনয়ন প্রক্রিয়ায় যার যত প্রভাব ততটাই কাজে লাগিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এতে নেতা-কর্মীরা হতাশ ও অসন্তুষ্ট হয়েছেন। আর এ কারণে গতকাল শেষ দিনে অনেক বিক্ষুব্ধ নেতাকে মেয়র পদে নিজেদের মনোনয়নপত্র দাখিল করতে দেখা গেছে। আবার অনেকে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন নির্বাচনে থাকবেন নিষ্ক্রিয়। এতে নির্বাচনে দলকে মাশুল দিতে হবে।

মেয়র পদে মনোনয়নে বঞ্চিতদের মধ্যে ক্ষোভ-অসন্তোষ আওয়ামী লীগের সমর্থক ভোটারদের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন অনেকে। জানা গেছে, চূড়ান্তভাবে মনোনীত প্রার্থীর নাম এলাকায় পৌঁছার পর অনেক জায়গায়ই ক্ষোভে ফেটে পড়েন বঞ্চিতদের সমর্থকরা। তাদের কেউ কেউ স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী হচ্ছেন। কোথাও কোথাও সংঘর্ষেও জড়িয়ে পড়ছেন তারা। এ ক্ষোভ-অসন্তোষের জের ধরে বরগুনার বেতাগীতে বুধবার হরতাল পালন করেছে উপজেলা আওয়ামী লীগের বিক্ষুব্ধ একটি অংশ। পরে রাতে প্রার্থী পরিবর্তন করতে বাধ্য হয় কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ। এদিকে সুপারিশ করা প্রার্থীকে কেন্দ্র থেকে দলীয় মনোনয়ন না দেওয়ায় মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলা ও পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ সব অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মী গণপদত্যাগ করেছেন। চুয়াডাঙ্গার জীবননগরে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন মুন্সী নাসির উদ্দীন। যিনি যুদ্ধাপরাধের মামলার রায়ে ফাঁসিতে মারা যাওয়া আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের আইনজীবী মুন্সী আহসান কবীরের ছোট ভাই। তবে মুন্সী নাসির দীর্ঘদিন থেকে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। তার পরও তার বিষয়ে দলের অনেকে আপত্তি তুলছেন। এ কারণে নির্বাচনী প্রচারণা থেকে অনেক ত্যাগী নেতা নিজেদের বিরত রাখবেন বলে জানা গেছে। চাঁদপুরের কচুয়ায় মেয়র পদে মনোনয়ন পেয়েছেন নাজমুল আলম স্বপন। রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় নাজমুল আলম স্বপনকে মেনে নেয়নি দলের একটি বড় অংশ। সিরাজগঞ্জের বেলকুচি পৌরসভায় মনোনয়ন পেয়েছেন সাবেক মন্ত্রী আবদুল লতিফ বিশ্বাসের স্ত্রী আশানুর বিশ্বাস। তার এ মনোনয়ন মানতে পারছেন না স্থানীয় আওয়ামী লীগের একটি অংশ। এ নিয়ে সেখানে নেতা-কর্মীদের মধ্যে চরম অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। রাজশাহীর পুঠিয়ায় উপজেলা যুবলীগ সভাপতি রবিউল ইসলাম রবি দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন। তিনি স্থানীয় এমপি আবদুল ওয়াদুদ দারার ব্যক্তিগত মনোনীত ও ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের প্রার্থী। এখানে স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা নিষ্ক্রিয় থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা পৌরসভায় মেয়র পদে তৃণমূল থেকে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বিল্লাল হোসেন সরকারের নাম পাঠানো হলেও কেন্দ্র থেকে মনোনয়ন পেয়েছেন বর্তমান মেয়র আবদুল হাই আকন্দ। তার এ মনোনয়নের বিরোধিতা করে দলের সাবেক উপজেলা সভাপতি আবদুস সামাদ মাস্টার বলেছেন, দলীয় শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে কয়েকবারই দল থেকে বহিষ্কার হয়েছেন আবদুল হাই আকন্দ। দলের সদস্যপদ পর্যন্ত হারিয়েছেন তিনি। তার পক্ষে কীভাবে নৌকায় ভোট চাইব?

কুষ্টিয়ার খোকসায় দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন তারিকুল ইসলাম তারিক। তাকে মানতে নারাজ দলের একাংশ। তাদের মতে, তারিক পৌর এলাকার মানুষের কাছে তেমন পরিচিত নন। এ ছাড়াও তিনি পৌরসভার বাসিন্দা নন। তাকে চ্যালেঞ্জ করে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে গতকাল মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন যুবলীগ নেতা আল মাসুম মোর্শেদ শান্ত। শান্ত বলেন, দলের বিরুদ্ধে নয়, ব্যক্তির বিরুদ্ধে আমার নির্বাচন। পৌরবাসীর চাওয়াতেই প্রার্থী হয়েছি। জয়ের মালা নিয়েই কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে দেখা করব।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে স্থানীয় এমপি গোলাম রাব্বানীর পছন্দের প্রার্থী উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও শিবিরের নৃশংস হামলায় একটি পা হারানো কারিবুল হক রাজিন মনোনয়ন পাননি। তার সমর্থকদের অভিযোগ, পুরোপুরি নিষ্ক্রিয় আওয়ামী লীগ নেতা মঈন খানকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে।

নড়াইলের কালিয়া পৌরসভায় মনোনয়ন পেয়েছেন কালিয়া থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ওয়াহিদুজ্জামান হীরা। দলের নেতা-কর্মীদের কাছে তিনি সৎ ও কর্মীবান্ধব রাজনীতিবিদ হিসেবে পরিচিত। তবে, এ বিষয়টি মানতে রাজি নয় তার বিরোধী পক্ষ। তাদের মতে, ওয়াহিদুজ্জমান হীরা রাজনীতির মানুষ নন। জানা গেছে, এ পৌরসভায় এমপির ঘনিষ্ঠ একাধিক প্রার্থী স্বতন্ত্র হিসেবে মাঠে থাকছেন। একইভাবে নাটোরের দুটি পৌরসভার একক প্রার্থীর নাম পাঠানো হলেও কেন্দ্র থেকে পরিবর্তন করে নতুন মুখ দেওয়া হয়েছে। তবে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শফিকুল ইসলাম শিমুল এমপি প্রভাব খাটিয়ে একক নাম কেন্দ্রে পাঠান বলে অভিযোগ।

চট্টগ্রামের মনোনয়ন নিয়ে অসন্তোষ চলছে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে। কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে চট্টগ্রামে বিভিন্ন পৌরসভায় আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন নয়জন। এতে ১০ পৌরসভায় দলীয় মনোনীতসহ মোট ১৯ জন আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী মনোনয়ন ফরম জমা দিয়েছেন। এতে চারটি পৌরসভায় নয়জন বিদ্রোহীও রয়েছেন। চার পৌরসভার মধ্যে বারইয়ারহাটে একজন, রাউজানে চারজন, রাঙ্গুনিয়ায় দুজন, সীতাকুণ্ডে দুজন বিদ্রোহী প্রার্থী রয়েছেন।

বগুড়ার ধুনট পৌরসভায় মেয়র পদে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন না পেয়ে দল থেকে পদত্যাগ করেছেন বর্তমান পৌর কাউন্সিলর আল-আমিন তরফদার। বুধবার রাত ৮টার দিকে ধুনট উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেন তিনি। এ বিষয়ে আল-আমিন তরফদার জানান, দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে মেয়র পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন তিনি। বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ পৌরসভায় মেয়র পদে আওয়ামী লীগের মনিরুল হক তালুকদারকে মনোনয়ন দেওয়া নিয়ে স্থানীয় নেতা-কর্মীদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। গতকাল মনোনয়নপত্র দাখিলের সময় তার সঙ্গে স্থানীয় নেতারা ছিলেন না। স্থানীয় এমপি, উপজেলা ও জেলা আওয়ামী লীগের পছন্দের প্রার্থীকে কেন্দ্রীয় বাছাই বোর্ড মনোনয়ন না দেওয়ায় স্থানীয় নেতারা দলীয় এ প্রার্থীর সঙ্গে যাননি। আসন্ন এ পৌরসভা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নতুন করে শুরু হয়েছে মোরেলগঞ্জ আওয়ামী লীগের গ্রুপিং। এ ছাড়া গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ ও গোবিন্দগঞ্জ পৌরসভায় আওয়ামী লীগের ছয়জন বিদ্রোহী প্রার্থী স্বতন্ত্র হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন।

সর্বশেষ খবর