বন্ড সুবিধার অপব্যবহার করে প্রতি বছর ৫৮ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছে একটি সিন্ডিকেট। রপ্তানিকারকদের দেওয়া বন্ডেড ওয়্যারহাউস সুবিধার বড় অংশই অপব্যবহার করে আমদানিকৃত কাঁচামাল স্থানীয় বাজারে বিক্রি করা হচ্ছে। তাদের এ রাজস্ব ফাঁকি ঠেকাতে এনবিআর সম্প্রতি বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। রাজস্ব ফাঁকিবাজদের প্রতিরোধে এনবিআরের একাধিক টিম কাজ করছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে আলাপকালে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান মো. নজিবুর রহমান এসব কথা বলেছেন।
এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, দীর্ঘদিন বন্ড ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে যারা ছিলেন তারা হিসাব করে দেখেছেন, যে পরিমাণ বন্ড সুবিধার অপব্যবহার হয় তা ঠেকানো গেলে বছরে দুটি পদ্মা সেতুর নির্মাণ ব্যয়ের সমপরিমাণ অর্থায়ন করা সম্ভব। তাদের রাজস্ব ফাঁকি ঠেকাতে এনবিআরের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেল (সিআইসি), শুল্ক গোয়েন্দা ও ভ্যাট গোয়েন্দা বিভাগকে শক্তিশালী করা হয়েছে। এ ছাড়া আরও অনেক যুগোপযোগী উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো হয়েছে। বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তা বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালাচ্ছেন। সম্প্রতি খুলনার একটি প্রতিষ্ঠান বন্ড সুবিধার অপব্যবহার করতে গেলে কর্মকর্তারা তা ধরতে সমর্থ হয়েছেন। এতে ২৫৮ কোটি টাকার ফাঁকি ধরা পড়েছে। এসব কাজের জন্য বিভিন্ন পর্যায়ে কর্মকর্তাকে নানাভাবে হুমকিও দেওয়া হচ্ছে। ওই সিন্ডিকেট বেশ শক্তিশালী। তিনি বলেন, তাদের শিকড় যত নিচেই হোক না কেন তা উপড়ে ফেলা হবে। রাজস্ব ফাঁকিবাজদের উদ্দেশে তিনি বলেন, সঠিক নিয়মে রাজস্ব পরিশোধ করুন। ফাঁকি দিলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এখানে দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন করা হবে। তবে অযথা কেউ যাতে হয়রানির শিকার না হন সেদিকেও খেয়াল রাখা হবে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এখন থেকে আর অযথা কেউ হয়রানির শিকার হবেন না। তবে রাজস্ব ফাঁকিবাজদের এক ইঞ্চিও ছাড় দেওয়া হবে না। সম্প্রতি ব্যবসায়ীদের অযথা হয়রানি করা হচ্ছে, এ ধরনের অভিযোগ ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে করা হচ্ছে। এ বিষয়ে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, এ অভিযোগ সত্য নয়। কিছু কর্মকর্তা হয়তো লোভের বশবর্তী হয়ে এ কাজ করছেন। এতে অসৎ ব্যবসায়ীদেরও যোগসাজশ রয়েছে। তবে উভয়ের মধ্যকার যোগাযোগ কমিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। এটি বাস্তবায়ন সম্ভব হলে হয়রানিও কমে আসবে। তবে এ ক্ষেত্রে সবাইকে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানান তিনি। তিনি বলেন, জাতিসংঘ কর্তৃক মনোনীত সহস াব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) থেকে আমরা এখন টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় (এসডিজি) প্রবেশ করেছি। এর অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে সংশ্লিষ্ট দেশের নিজস্ব সম্পদ বাড়ানো এবং এর সঠিক ও দক্ষ ব্যবহার নিশ্চিত করা। অন্যদিকে দিন দিন বৈদেশিক সহায়তার প্রবাহও কমে আসবে। এ জন্য নিজস্ব সম্পদ বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। অভ্যন্তরীণ সম্পদ অর্থাৎ রাজস্ব জোগান দিতে এনবিআরই সরকারের অন্যতম ভরসা। সে জন্য এখানে সুশাসন নিশ্চিত করার কোনো বিকল্প নেই। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রীও দেশের ৯০ শতাংশ কাজ নিজস্ব অর্থায়নে করতে চান। এ লক্ষ্যে তিনি এনবিআরের সম্প্রসারণে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছেন। সারা দেশে এনবিআরের কার্যক্রম বিস্তৃত হচ্ছে। সবাইকে করের আওতায় আনার চেষ্টা হচ্ছে। এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, রাজস্ব কাঠামো সংস্কারে দীর্ঘমেয়াদি কিছু পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এগুলো পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন করা হবে। আয়করদাতা বাড়াতে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হবে। রাজধানীর অভিজাত এলাকায় জরিপ কার্যক্রম চালানো হবে। এ জন্য গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় এবং স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে ফ্ল্যাটবাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানেও জরিপ চালানো হবে। আশা করা যায়, এর মাধ্যমে দেশের একটা বড়সংখ্যক জনগোষ্ঠীকে আয়করের আওতায় আনা সম্ভব হবে। এনবিআর চেষ্টা করছে কর দিতে সক্ষম প্রত্যেকের কাছে পৌঁছানোর। তিনি বলেন, এ বছর রাজস্ব আদায়ের বিশাল আকারের টার্গেট দেওয়া হয়েছে; যা গত অর্থবছরের আদায়ের চেয়ে প্রায় ৩০ শতাংশ বেশি। এটা মেটানো হবে আয়কর, ভ্যাট, শুল্ক ও অন্যান্য খাতের কর থেকে। ইতিমধ্যে অর্থবছরের পাঁচ মাস অতিক্রান্ত হয়েছে। এনবিআরের হিসাবে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে খানিকটা পিছিয়ে রয়েছে রাজস্ব আদায়। তবে অর্থবছর শেষে টার্গেট পূরণ করা সম্ভব হবে বলে মনে করেন এনবিআর চেয়ারম্যান। নজিবুর রহমান বলেন, অর্থবছরের বাকি সময়ের মধ্যে এ অর্থের উল্লেখযোগ্য অংশ এবং রাজস্বসংক্রান্ত মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির মাধ্যমে বড় অঙ্কের রাজস্ব আদায় করা হবে। এতে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি ব্যবস্থাকে কার্যকর করা, অগ্রিম আয়কর (এআইটি) কর্তনের বিধান সক্রিয় করা এবং রাজস্ব আদায়কারী কর্মকর্তাদের প্রচেষ্টার মাধ্যমে রাজস্ব আদায় বাড়বে। অন্যদিকে আগামী মাসগুলোতে এডিপি বাস্তবায়ন বাড়বে, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড গতিশীল হবে। সেই সঙ্গে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ দেখানো হবে।