শনিবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা
পর্যবেক্ষণ

চুড়ি নারী চকলেট চুলায় আমাদের নির্বাচন কমিশন

সামিয়া রহমান

চুড়ি নারী চকলেট চুলায় আমাদের নির্বাচন কমিশন

এক মেয়ের স্বামী খুব অসুস্থ হয়ে কোমায় চলে গিয়েছিল। প্রায় এক মাস ধরে অসুস্থ থাকার পর লোকটি একসময় ধীরে ধীরে চেতনা ফিরে পেল। এই একমাস মেয়েটি প্রতিদিন হাসপাতালে তার স্বামীর পাশে বসে থাকত। চেতনা ফিরে পেয়ে স্বামী চেয়ে দেখে তার স্ত্রী তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। লোকটি তার স্ত্রীকে ডাকল। বলল, ‘শোনো আমার পাশে এসে বসো।’ এতদিন পর স্বামীর কথা শুনে স্ত্রীর চোখ পানিতে ভরে এলো। স্বামী বলল, ‘তুমি জানো কি, তুমি আমার সঙ্গে সব খারাপ সময়ে ছিলে। যখন আমার চাকরি চলে যায়, তুমি আমার পাশে ছিলে, যখন আমার ব্যবসা ফেল করে, তুমি ছিলে আমার সঙ্গে, যখন একটা গণ্ডগোলে আমার গায়ে গুলি লাগে, তখনো তুমি ছিলে অবিচল, যখন আমাদের বাড়িটি হাতছাড়া হয়ে যায়, তুমি একদম ছায়ার মতো ছিলে, যখন আমার শরীর খারাপ হলো, তুমি তখনো আছো আমার পাশে... তুমি জানো তুমি আসলে কি?’ মেয়েটি প্রবল প্রেম নিয়ে স্নেহভরা কোমল কণ্ঠে স্বামীর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, ‘কি?’ স্বামীর উত্তর, ‘আমার মনে হয় তুমি আমার জন্য দুর্ভাগ্য!’ এতটা দুর্ভাগ্য আমার ব্যক্তিগতভাবে হয়নি। কিন্তু মেয়েদের দুর্ভাগা করে তোলার বা দেখার প্রবণতা এখনো এই সমাজে বদলায়নি। তাই বোধহয় কাজ থেকে ফেরার পথে নারীকে এখনো গণধর্ষণের শিকার হতে হয়, প্রেম করার অপরাধে মাথা ন্যাড়া করে দেওয়া হয়, পার্কে প্রেমিকের সঙ্গে গল্প করার অপরাধে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে জরিমানা দিয়ে গালিগালাজ শুনে অপমানিত হতে হয়, শাশুড়ি-ননদের হাতে বাড়ির বৌকে নগ্ন করার ভিডিও করে সেই ভিডিও ফেসবুকে আপলোড করা হয়, নারীমূর্তির স্তনে সন্তানের বয়সী বাচ্চা ছেলেরা হাত দিয়ে, মুখ দিয়ে ছবি তুলে ফেসবুকে আপলোড করে ‘ফান’ নাম দিয়ে মজা করে। আমার শিক্ষিত প্রগতিশীল মেয়ে বন্ধুরা কখনো নিজেদের নারী পরিচয় তুলে ধরতে পছন্দ করেন না। নারী হিসেবে অতিরিক্ত সুবিধা নেওয়ার পক্ষপাতীও তারা নন। কিন্তু আমি মনেপ্রাণে আপাদমস্তক মেয়ে। ভিড়ের রাস্তায় ধাক্কাধাকি, ঠেলাঠেলি করে চলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। মনে করি আমার সমাজ এখনো সেই সুযোগ-সুবিধা আমাকে দেয়নি। হয়তো ভুল ধারণা, হয়তো মধ্যবিত্ত সুবিধাবাদীর মতো কথা। হয়তো আমি নিজে সমাজের সুবিধাভোগী শ্রেণিতে আছি বলে এ ধরনের চিন্তা। কিন্তু রাস্তাঘাটে চলতে-ফিরতে এমনকি ভার্চ্যুয়াল মিডিয়াতেও যখন নোংরা অশ্লীল দৃষ্টি দেখি, কমেন্ট আর কথা শুনি, আমি মনে করি কিছু সুবিধা পেলে আমাদের সম্মানটা বাঁচে। আবারও বলছি, এটি আমার একান্তই ব্যক্তিগত মত। সত্যি বলতে কি নিজেকে কখনো মেয়ে হিসেবে নয়, মানুষ হিসেবে ভেবে এসেছি সব সময়। বড় গলায় বিদেশি বন্ধুদের বলি— আমার দেশের প্রধানমন্ত্রী নারী, বিরোধীদলীয় নেত্রীও নারী, স্পিকার নারী। কিন্তু মানুষকে দুর্বল পরাজিত নারী হিসেবে দেখার প্রবণতা পাল্টায়নি। এখনো প্রতি পদে পদে বৈষম্য আছে, সমালোচনা আছে, তিরস্কার আছে, আছে মধ্যযুগীয় মানসিকতা। এতদিন ভাবতাম আমরা আধুনিক সনাতন মধ্যযুগ পার করে এসেছি, এটি আসলে আমাদের মধ্যবিত্ত মানসিকতা। সব সময় আমরা সব দোষ তো মধ্যবিত্ত শ্রেণির ওপরই দিয়ে এসেছি। আলোচনা-সমালোচনায় মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে হেনস্থা করতে দেখেছি। বলা হয়, মধ্যবিত্তের ছদ্ম গাম্ভীর্য আর আত্মপ্রসাদের কপটতার মুখোশে সব অন্যায়-অবিচার ঘটে আর আমরা মধ্যবিত্ত শ্রেণি নীরব দর্শকের মতো সিনেমা দেখতে থাকি। চোখের সামনে ঘটতে থাকে একের পর এক ঘটনা, আমরা পলায়নপর, স্বার্থপর, পরমুখাপেক্ষী হয়ে সব অবলোকন করে যাই। ... যদি পাছে লোকে কিছু বলে। মধ্যযুগীয় না মধ্যবিত্ত মানসিকতা তা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে, কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক দল বা রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের আচরণও যখন তথাকথিত সুবিধাবাদী মধ্যবিত্ত শ্রেণি এবং চিরাচরিত মধ্যযুগীয় ধ্যান-ধারণাকে অনুসরণ করে তখন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্যও আমাদের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে ওঠে।

সমালোচনা উঠছে পৌরসভা নির্বাচনে অংশ নেওয়া নারী প্রার্থীদের নারী হিসেবেই মূল্যায়ন করা হচ্ছে, যোগ্যতার নিরিখে নয়। নির্বাচন কমিশনের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সাতজন আর বিএনপি একজনকে নারীকে মেয়র পদে প্রার্থী দিয়েছে। বাকি দলগুলোর প্রার্থীর তালিকায় কোনো নারী প্রার্থী খুঁজে পাওয়া যায়নি। রাজনৈতিক দলের বাইরে ১২ জন নারী স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। বাম দলগুলোর মধ্যে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি কোনো নারী প্রার্থীকে মনোনয়ন দেয়নি। সব মিলিয়ে ২৩৪টি পৌরসভা নির্বাচনে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আছেন মোট ২০ জন নারী। আমাদের মেয়েদের যোগ্যতা কি কমে গেল? নাকি মেয়েদের ওপর আস্থার অভাব? তাহলে নারীর ক্ষমতায়নের নামে এত গালভরা বুলি কেন? নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে সরকারের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি কোথায় গেল? যদি রাজনৈতিক দলগুলো মনে করে যোগ্যতার বিচারে নারী প্রার্থীরা পিছিয়ে আছেন তাহলে তাদের এগিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব তো রাজনৈতিক দলগুলোরই থাকা উচিত ছিল। বিচার কি যোগ্যতার মানদণ্ডে হলো নাকি পেশিশক্তির জোরে? সবচেয়ে হাস্যকর হেনস্থা হচ্ছে নারী প্রার্থীদের জন্য প্রযোজ্য প্রতীক নিয়ে। নারীদের জন্য বরাদ্দ প্রতীক হলো— পুতুল, চুড়ি, চুলা, ভ্যানিটি ব্যাগ, চকলেট ইত্যাদি। নারীকে দুর্বল করে দেখানোর কী চমকার ব্যবস্থা। যেন নারী শুধু গৃহস্থালি কাজেরই উপযুক্ত। সমাজের গুরুত্বপূর্ণ কাজ উন্নয়ন, নেতৃত্ব তাদের দিয়ে সম্ভব নয়। সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচন কমিশন সময়ের অজুহাত দেয়। সময় স্বল্পতার কথা বলে। এর আগেও সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সংরক্ষিত আসনের নারী প্রার্থীদের জন্য এ ধরনের প্রতীক বরাদ্দ করা হয়েছিল। প্রশ্ন ওঠে, একই ভুল দ্বিতীয়বার হয় কেমন করে? গণমাধ্যমে দেখলাম নির্বাচন কমিশনের এক যুগ্ম-সচিব বলেছেন, প্রতীক প্রতীকই। প্রতীক নিয়ে যদি সমস্যা হয় তবে মেয়েরা কেন সংরক্ষিত আসনে লড়ছেন। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিই বদলানো উচিত। হ্যাঁ, উপযুক্ত কথাই বটে। আসলেই তো, আমরা নারীর ক্ষমতায়ন চাই, আবার সংরক্ষিত আসনও চাই। অধিকার চাই, আবার সংরক্ষিত আসনও চাই। অধিকার চাই, আবার প্রতীকের নারী-পুরুষ বিচার করি। সমান অধিকারের কথা বলি, আবার বাসে ট্রেনে, রাস্তায় পুরুষদের অশালীন ধাক্কাও খেতে চাই না। একদিকে নারীদের সম্মান চাই, আবার সংরক্ষিত সিটও চাই। আমাদের আবদারেরই বোধহয় সীমা-পরিসীমা নেই। সমস্যাটা কোথায়? আচরণ, চিন্তায়, অধিকারের সীমারেখায়? এটি কি আমাদের চিন্তার সীমাবদ্ধতা নাকি সনাতন বৈষম্যমূলক আচরণ? ফিমিনিস্ট, সিস্টারহুড, উইমেন লিব, উইমেন ইজম, মেল শোভেনিজম অ্যাটিটিউড শব্দগুলো আমার কাছে কোনো অর্থ বহন করে না। কারণ আমি ব্যক্তিগতভাবে নারীবাদী নই। নারীর অধিকার নিয়েও লড়তে আসিনি। মানুষের অধিকার আমার কাছে প্রথম। সেই অধিকারের দাবিতেই এ ধরনের প্রতীক আমার কাছে অসম্মানজনক, অবমাননাকর। সেটি পুরুষের জন্য হোক আর নারীর জন্যই হোক। যথারীতি এ আলোচনা-সমালোচনায়ও দোষারোপ পাল্টা দোষারোপের রাজনীতির খেলাও চলে। গণমাধ্যমে এসেছে বিএনপির মহিলাবিষয়ক সম্পাদক বলেছেন, যেমন সরকার, তেমন প্রতীক, তেমন কমিশন। যুক্তি পাল্টা যুক্তি। কিন্তু সমাধানে কি আদৌ কোনো পক্ষ উদ্যোগী? মনে আছে আমাদের শৈশবের ছড়াটির কথা? ‘বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর, নদে এল বান, শিব ঠাকুরের বিয়ে হল, তিন কন্যা দান। এক কন্যা রাঁধেন বাড়েন, এক কন্যা খান, এক কন্যা রাগ করে বাপের বাড়ি যান।’ শিব ঠাকুরকে তিনটি কন্যা দান করার কথা বলা হচ্ছে, অর্থাৎ তার তিন তিনটি স্ত্রী! ছড়াটির উপস্থাপনাটি এতই নিরীহ ছিল যে, এটিই ঠাকুর মশাইয়ের প্রাপ্য এবং এটিই স্বাভাবিক। আমাদের নির্বাচন কমিশনে কর্মকর্তারা তাদের চুড়ি, চুলা, ভ্যানিটি ব্যাগের প্রতীক দিয়ে নারী-পুরুষকে বিভাজিত করার প্রচেষ্টাটির মতোই স্বতঃসিদ্ধ ও স্বাভাবিক।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

সর্বশেষ খবর