শনিবার, ১৯ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

ব্যাংকিং অটোমেশন নিয়ে লুকোচুরি

আলী রিয়াজ

ব্যাংকিং অটোমেশন নিয়ে চলছে লুকোচুরি। ২০০৮ সালেই দেশের সব ব্যাংক শাখা অটোমেশন প্রকল্পের আওতায় নিয়ে আসার লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও সাত বছরেও তা সম্ভব হয়নি। বর্তমানে সারা দেশে প্রায় সাড়ে সাত হাজার ব্যাংক শাখার মধ্যে মাত্র ৩২৫টিতে আংশিক আরটিজিএস অটোমেশন চালু করা হয়েছে। এমনকি এটিএম বুথ চালু করার ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ পার্শ্ববর্তী ও প্রতিযোগী দেশের তুলনায় অনেক নিচে। অথচ দাবি করা হচ্ছে, পুরো ব্যাংকিং ব্যবস্থা এখন অটোমেশনের আওতায়। যতটুকু অটোমেশন হয়েছে তাও শুধু এটিএম থেকে টাকা উত্তোলন ও জমা দেওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ। এ ক্ষেত্রে বেসরকারি ব্যাংকগুলোয় কিছুটা অগ্রগতি থাকলেও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক এখনো কাগজনির্ভর ব্যাংকিং সেবা পরিচালনা করছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশের ব্যাংকিং খাত পুরোপুরি অটোমেশনের আওতায় নিয়ে আসা গেলে ৩ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জন করা যাবে। সম্ভব হবে ব্যাংকিং জালিয়াতি শতভাগ নিয়ন্ত্রণ করা। অনলাইন ব্যাংকিংয়ের ক্ষেত্রে সারা দেশের শাখাগুলোকে একই সিস্টেমের মধ্যে আনা যায়নি। এ কারণে ঋণ প্রদান, এলসি, বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেন একই সার্ভারে দেখা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে বন্ধ হচ্ছে না ব্যাংকিং খাতের অনিয়ম, দুর্নীতি ও জালিয়াতি। বিশ্লেষকরা বলছেন, অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব সার্ভারে যদি সব ব্যাংকের শাখার আলাদা উইং করে এগুলোকে অটোমেশনের মধ্যে আনা যায়, তাহলে কোনো দুর্নীতি করা সম্ভব হবে না। এমনকি এলসি জালিয়াতি, হলমার্ক, বিসমিল্লাহ গ্রুপের মতো ব্যাংক ডাকাতি করাও কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। টাকা পাচারের সব তথ্য একটি ওয়েবসাইটের মাধ্যমে করা সম্ভব হলে কেউ অনিয়ম করলেই সঙ্গে সঙ্গে তা বের করা যাবে। জানা গেছে, ২০০৬ সালে বিদেশ থেকে রেমিট্যান্স গ্রহণ নিরাপদ, দ্রুত ও নিশ্চিন্ত করতে ব্যাংকিং অটোমেশন প্রকল্প চালু করা হয়। ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর থাকার সময় ব্রিটেন সরকারের ডিপার্টমেন্ট অব ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট (ডিএফআইডি) অর্থায়নে বাংলাদেশ ব্যাংক এ প্রকল্প চালু করে। চেক ক্লিয়ারিং ও ইলেকট্রনিকস ফান্ড ট্রান্সফার সিস্টেম চালু করতে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়। এ প্রকল্পের পরিধি বৃদ্ধি করে পরবর্তী সময়ে চালু করা হয় চেক অটোমেশন, বৃহত্ লেনদেন অটোমেশন, ন্যাশনাল পেমেন্ট সিস্টেম, সরকারি কোম্পানির ডিভিডেন্ট অটোমেশন ও বেতন প্রদান অটোমেশন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে সরকারের ১০২টি অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে সব ধরনের বিল পরিশোধ করার প্রক্রিয়াটি অটোমেশনের আওতায় নিয়ে আসার প্রকল্প নেওয়া হয়। এ প্রকল্পের আওতায় মোবাইল ব্যাংকিং এবং এটিএম বুথ চালু করা সক্ষম হয়। কিন্তু মোবাইল ব্যাংকিং এবং এটিএম বুথ চালু করতে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো পুরোপুরি ব্যর্থ। অন্যান্য বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর এটিএম বুথ শুধু শহর এলাকায় রয়েছে। যেখানে বাংলাদেশে প্রতি ১০ লাখ লোকের জন্য এটিএম বুথ মাত্র দুটি, সেখানে কোরিয়ায় ৬০০টি, চীনে ৪৮টি, ভারতে ১২টি। আন্তব্যাংকিংয়ের সব ধরনের লেনদেন করতে বাংলাদেশ ব্যাংকের নেতৃত্বে দেশের ৫৭টি বাণিজ্যিক ব্যাংক ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান মিলে একটি ন্যাশনাল ক্লিয়ারিং কোম্পানি গঠনের প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছিল। প্রকল্পটির জন্য ওই বছর জাতীয় বাজেটে বিশেষ বরাদ্দ দেওয়া হয়। এরপর আর প্রকল্পটি এগোয়নি। তবে কার্ডভিত্তিক সেবা প্রদানকারী ব্যাংকগুলোকে একটি অভিন্ন প্লাটফর্মের আওতায় এনে এটিএম, পিওএস, ইন্টারনেট ব্যাংকিং ও মোবাইল ফিনানশিয়াল সার্ভিসেসকে আন্তপরিচালনযোগ্য করে তুলতে বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১২ সালের ডিসেম্বর মাসে ন্যাশনাল পেমেন্ট সুইচের কার্যক্রম শুরু করে। বর্তমানে ৪২টি ব্যাংক এনপিএসবির মাধ্যমে আন্তব্যাংক কার্ডভিত্তিক এটিএম লেনদেন করছে। পিওএস সার্ভিসকে আন্তপরিচালনযোগ্য করে তোলা, অনলাইন ব্যাংকিং ও মোবাইল ফিনানশিয়াল সার্ভিসেসের আওতাভুক্ত করার প্রক্রিয়া এখনো পরিকল্পনাধীন। যদিও ব্যাংকগুলোর সিস্টেমে সফল সমন্বয় ও বহু স্তরের টেস্টিং কার্যক্রমে ২০১০ সাল থেকে বাংলাদেশে অটোমেটেড চেক প্রসেসিং সিস্টেম পরিচালিত হচ্ছে। বাংলাদেশে ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফার নেটওয়ার্কের যাত্রা শুরু হয় ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারিতে। আবার এটিএম ও ডেবিট কার্ড ব্যবহার করতে ডাচ্-বাংলা ব্যাংকসহ কয়েকটি ব্যাংককে বিশেষ সুবিধা দেওয়ায় এক ধরনের অসম প্রতিযোগিতার তৈরি হয়েছে। ফলে অন্য ব্যাংকগুলো ভালো করতে পারছে না। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক ২৯ অক্টোবর রিয়েল টাইম গ্রোস সেটেলমেন্ট (আরটিজিএস) চালু করে। সারা দেশে আরটিজিএসের মাধ্যমে এখন বৃহত্ লেনদেন কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। এ পদ্ধতি চালুর ফলে আন্তব্যাংকিংয়ের যে কোনো লেনদেন এক দিনেই করা সম্ভব হচ্ছে। কিন্তু ন্যাশনাল ক্লিয়ারিং কোম্পানি গঠনে কোনো অগ্রগতি হয়নি। এখন ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) শুধু ব্রোকার হাউসের আন্তলেনদেনের জন্য আলাদা ক্লিয়ারিং কোম্পানি গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে। ২০০৮ সালেও ডিএসই একই প্রকল্প নেওয়ার পর বিশেষজ্ঞরা এর বিরোধিতা করে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণে কোম্পানি গঠনের পরামর্শ দেন। সে সময় বিশ্লেষকরা পরামর্শ দেন অন্তর্বর্তীকালীন সদস্য বাংলাদেশ ব্যাংকের কোম্পানির সঙ্গে ডিএসই ও সিএসইর ব্রোকার হাউসগুলোকে ন্যাশনাল পেমেন্ট সিস্টেমের সদস্য করার জন্য। কিন্তু গত ছয় বছরে বাংলাদেশ ব্যাংক তা বাস্তবায়ন করতে পারেনি। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা ম্যাকেঞ্জি ভারতের ব্যাংকিং পদ্ধতির ওপর এক গবেষণা চালায়। গবেষণা প্রতিবেদনে প্রাপ্ত ফলাফলে দেখানো হয়েছে, পুরো ব্যাংকিং কার্যক্রম অটোমেশনের আওতায় নিয়ে আসা হলে একটি দেশের জিডিপি ৩.২ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। অপ্রচলিত ঋণব্যবস্থা থেকে প্রচলিত ঋণব্যবস্থায় গেলে জিডিপির ০.৭ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। একই সঙ্গে একটি দেশের বৈদেশিক লেনদেনে ৩ বিলিয়ন ডলার জিডিপিতে অবদান রাখবে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ ড. জামালউদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘২০০৭ সালে ব্যাংকিং অটোমেশনের ওপর আমরা যে কাজ করেছি, এর আংশিক হয়েছে। গত সাত-আট বছরে মোবাইল ব্যাংকিং ছাড়া অটোমেশন বলতে যা বোঝায় বিদেশি ব্যাংক বাদে দেশের কোনো ব্যাংকই সম্পূর্ণ করতে পারেনি। আরটিজিএস সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে। শুধু এটিএম বুথে টাকা উত্তোলন, মোবাইল ব্যাংকিংয়ে টাকা লেনদেনকে অটোমেশন বলা যাবে না। এটি একটি সামান্য অংশ হতে পারে। কাগজপত্রবিহীন পুরো ব্যাংকিং সিস্টেম হলেই একে অটোমেশন বলা যাবে। একজন গ্রাহকের এখনো লাইনে দাঁড়িয়ে ব্যাংকিং সেবা নিতে হয়। প্রত্যন্ত অঞ্চলে ব্যাংকের শাখাগুলোতে পুরনো পদ্ধতিতেই আন্তব্যাংক লেনদেন হচ্ছে। বাংলাদেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা অন্যান্য দেশের চেয়ে অনেক পিছিয়ে আছে। আমাদের ব্যাংকগুলো প্রতিযোগী দেশের তুলনায় অনেক নিচে। আন্তশাখা রিকনসুলেশনে তিন থেকে চার বছর আউটস্ট্যান্ডিং আছে। ফলে সারা দেশের ব্যাংক শাখাগুলোর অনিয়ম নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হচ্ছে না। অটোমেশন হলে সব ধরনের অনাচার বন্ধ হয়ে যাবে।’ এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক শুভঙ্কর সাহা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ক্লিয়ারিং কোম্পানি গঠনের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়নি। তবে ২০০৬ সালে অটোমেশনের যে প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়, এর বেশির ভাগই বাস্তবায়িত হয়েছে। আমরা আরটিজিএস চালু করেছি। এর মাধ্যমে আন্তব্যাংকিং লেনদেন এক দিনে করা যাচ্ছে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর