সোমবার, ২১ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা
সাক্ষাৎকার : মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর

উন্নয়ন যতই হোক গণতন্ত্র ছাড়া তা টেকসই হবে না

মাহমুদ আজহার

উন্নয়ন যতই হোক গণতন্ত্র ছাড়া তা টেকসই হবে না

‘উন্নয়ন যতই হোক, দেশে স্থিতিশীল গণতন্ত্র ছাড়া তা কখনোই টেকসই হবে না। সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে গণতন্ত্রকে বিকশিত করা। কিন্তু তারা হাঁটছে উল্টো পথে। সরকারের নীতি-নির্ধারকদের পক্ষ থেকে প্রকাশ্যে তো বলেই দেওয়া হচ্ছে, এখন গণতন্ত্র প্রধান ইস্যু নয়, প্রয়োজন উন্নয়ন। তাদের লক্ষ্য হচ্ছে, গণতন্ত্র সেকেন্ডারি, প্রথম প্রাধান্য হচ্ছে উন্নয়ন। এ জন্য যদি কঠোর হতে হয়, তাই করা হবে। এই ধারণার পুরোটাই নেতিবাচক।’

সম্প্রতি রাজধানীর উত্তরায় নিজ বাসভবনে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন বিএনপির  ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। সদ্য কারামুক্ত বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের এই নেতার মতে, ‘উন্নয়ন কখনোই সম্ভব হবে না, যদি দেশে গণতন্ত্র না থাকে। একটি দেশে যদি ভিন্নমত না থাকে, বিরোধী দল না থাকে, তাহলে  একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হবে। দেশের ইতিহাস তাই বলে।’ গণতন্ত্রের ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, ‘গণতন্ত্র হলো এমন একটা পদ্ধতি, যেখানে সকলে যার যার মতামত প্রকাশ করবে। সেই মত প্রকাশের স্বাধীনতা দিতে হবে। ভিন্নমত সহিষ্ণুতা, সহনশীলতা, টলারেন্স থাকতে হবে। কথায় কথায় বিরোধী দলের নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার, গুলি কিংবা নির্যাতন করা যাবে না। করা হলে তাকে বলা হয় অটোক্রেসি, গণতন্ত্র নয়। বাংলাদেশে বর্তমান রাজনীতি যেটা চলছে, তা গণতন্ত্রের মুখোশে, ছদ্মবেশে একনায়কতন্ত্র। বলা যায়, একদলীয় শাসন।’ মির্জা ফখরুল বলেন, ‘আজ রাষ্ট্রের সমস্ত প্রতিষ্ঠানকে সরকারি দল নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে সরকারকেই পথ বের করতে হবে। তাদের বুঝতে হবে, এই ধরনের ব্যবস্থা কখনো টেকসই হয় না। এভাবে  বেশিদিন টেকা যায় না। গণতন্ত্র এখন ধ্বংসপ্রাপ্ত। সরকারকে এটা উপলব্ধি করতে হবে। জনগণকেও সচেতন হতে হবে। এর প্রতিবাদ করতে হবে।’ বিএনপির মেয়াদোত্তীর্ণ কাউন্সিল, সাংগঠনিক পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় স্থবিরতা প্রসঙ্গেও কথা বলেন বিএনপির ক্লিন ইমেজের এই নেতা। তিনি বলেন, ‘বর্তমানে দেশে যে পরিবেশ বিরাজ করছে, তাতে কোনো বিরোধী দলের সাংগঠনিক কার্যক্রম চালানো খুবই দুষ্কর হয়ে পড়েছে। বলা চলে, প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এর মধ্যেও আমরা জেলায় জেলায় সংগঠন গোছানোর কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু মূল বিষয়টা হচ্ছে, জনগণের দৃষ্টিকে ভিন্ন দিকে নিতে সরকার বিএনপির দোষ খুঁজে বের করার চেষ্টা করা। কিন্তু সরকার কী করছে, আওয়ামী লীগ কী করছে, এ ব্যাপারে গণমাধ্যমসহ কেউই মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছে না।’ বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব বলেন, ‘আমরা পৌরসভা নির্বাচনের পরপরই কাউন্সিল করব। পৌর নির্বাচনের পাশাপাশি সাংগঠনিক পুনর্গঠনও চলছে। কিন্তু এটা এখন বড় সমস্যা নয়। দেশে এখন বড় সমস্যা হলো গণতন্ত্র। বিএনপির কাউন্সিল হলো কী হলো না এটা বড় কথা নয়, প্রয়োজন দেশে গণতন্ত্র। তা আছে কি না, দেখতে হবে। কাউন্সিল করার সুযোগ আছে কি না? গণতান্ত্রিক উপায়ে আন্দোলন করার কোনো সুযোগ আছে কি না? এটাই মূল ইস্যু।’ তিনি জানান, ‘দেশে গণতন্ত্র থাকলে কবেই আমাদের কাউন্সিল হয়ে যেত। আমরা প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। হলরুমও ভাড়া করেছিলাম। ওই সময় আমাদের অফিস থেকে একসঙ্গে ১৫৪ জনকে গ্রেফতার করে নিয়ে গেল। আমাদের তো সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড চালানোর সুযোগই দেওয়া হচ্ছে না। এ জিনিসগুলো কেউ বস্তুনিষ্ঠভাবে দেখে না। সব বিএনপির দোষ বলে চালিয়ে দেয়।’ কথা হয় আসন্ন পৌরসভা নির্বাচন নিয়েও। বাংলাদেশ প্রতিদিনকে খোলামেলাভাবেই মির্জা ফখরুল বলেন, ‘আমরা পৌর নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত থাকব। নির্বাচন যে সুষ্ঠু হবে না, আমরা তাও জানি। তারপরও আমরা শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নির্বাচন কমিশনের ওপর চাপ প্রয়োগ করছি। কিন্তু তারা শুধু সরকারের কথাই শুনছে। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করছে না। আমরা অতীতেও স্থানীয় সরকারের সব নির্বাচনে থেকেছি। জনগণের ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনার জন্য এবারের নির্বাচনেও থাকব।’ গণতন্ত্র রক্ষায় এবার নির্বাচনে গেলে ২০১৪ সালে ৫ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচন বর্জন করলেন কেন— এমন প্রশ্নে সাবেক এই মন্ত্রী বলেন, ‘৫ জানুয়ারির প্রেক্ষাপট ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সরকার নিজেদের ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে ৯০ ভাগ মানুষের মতামতকে তোয়াক্কা না করে সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা তুলে ফেলে। এটা জনগণ ভালোভাবে নেয়নি। তাই আমরা কিংবা ২০-দলীয় জোট নয়, অধিকাংশ রাজনৈতিক দলই নির্বাচন বর্জন করে। তারপরও ভোটের দিন কী ঘটেছে তা গণমাধ্যমের সুবাদে বিশ্ববাসী দেখতে পেয়েছে।’ নির্বাচন বর্জনের যৌক্তিক প্রেক্ষাপট তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘ওই সময় আমাদের আন্দোলনে জনগণের সমর্থন ছিল। কারণটা ছিল, জনগণও বুঝতে পেরেছে, নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে হলে একটা নির্দলীয় সরকার ব্যবস্থা দরকার। আমরা সেটা নিয়ে ক্ষমতাসীনদের চাপ সৃষ্টি করেছি। আন্দোলনও করেছি। আমরা ওই ভোটবিহীন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করিনি। দেশের অধিকাংশ দল অংশ না নেওয়ার পরও ভোটবিহীন ওই নির্বাচন দেশবাসী দেখেছে। বিদেশিরাও দেখেছে।’ পৌর নির্বাচনে অংশ নেওয়া প্রসঙ্গে বলেন, ‘বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আমরা পৌর নির্বাচনে যাচ্ছি। বিএনপি একটি নির্বাচনমুখী দল। আমাদের ওপর প্রচণ্ড চাপও আছে। তাই নানা প্রতিকূলতাকে সামনে রেখেও আমরা নির্বাচনে যাচ্ছি। নির্বাচন আন্দোলনেরই একটা অংশ। এখন আন্দোলন বলতে রাস্তায় নেমে হরতাল-অবরোধ করার একটা কৌশলেই সীমাবদ্ধ নেই, অনেক কৌশল আছে। সেটা আমরা করছি। কখনো কখনো সরকারকে সময় দিতে হয়, যখন মনে হবে, রাস্তায় নেমে আন্দোলন করতে হবে, তখন তাই হবে। জনগণ সেখানে অংশ নেবে বলে আমাদের বিশ্বাস।’ সরকারের সঙ্গে সংলাপ সমঝোতা প্রসঙ্গেও কথা হয়। তার ভাষায়— ‘আমরা সরকারকে বার বার সংলাপের আহ্বান জানিয়েছি, জাতীয় ঐক্যের কথা বলেছি। সরকারের পক্ষ থেকে কোনো রেসপন্স তো নেই, বরং তারা ধাম্ভিকতার সঙ্গে বলছে, কোনো সংলাপ হবে না। এ নিয়ে নেতিবাচক কথাবার্তা বলছে। এর অর্থই হলো— সরকার চায় না দেশে বিরোধী দল থাকুক, কাজ করুক, ভিন্ন মত থাকুক। তারা এভাবেই চিরস্থায়ী ক্ষমতা চায়। আমাদের কাজ আমরা করছি, জনগণের কাছে যাচ্ছি।’ ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব বলেন, ‘অনেকেই বলেন— সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণে বিএনপির আন্দোলন সফল হচ্ছে না। আসলে তারা চোখ বন্ধ করে থাকে। ৫ জানুয়ারিকে ঘিরে ঢাকায় তিন দিন ধরে সরকার অঘোষিত হরতাল করেছিল। অবরোধ করে লোকজনের চলাচলের সব পথ বন্ধ করে দিয়েছিল। যখন ওই ধরনের কোনো কর্মসূচি দিই, সরকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দলীয় হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে মাঠে নামে।’ তিনি বলেন, ‘গত ৫ জানুয়ারি কী হয়েছে? আমরা যে কর্মসূচি দিয়েছিলাম, তাতে ম্যাডামকে (খালেদা জিয়া) দুই দিন আগে থেকেই আটকে রাখা হয়েছিল, বের হতে দেয়নি। গোটা ঢাকা শহরের হোটেল, রেস্টুরেন্ট, বাসা-বাড়িতে অভিযান চালিয়ে গণগ্রেফতার করে সবকিছু বন্ধ করে দিয়েছিল। এটা কি সাংগঠনিক দুর্বলতা? আমরা কী এখন তাহলে বন্দুক বা পিস্তল দিয়ে সরকারের সঙ্গে যুদ্ধ করব? বিএনপি তো কোনো সন্ত্রাসী দল নয়, মারামারি করার দলও নয়। আমরা শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করতে চাই। সেই কর্মসূচিতে বাধা দিলে তো সেভাবে করা যায় না।’ সরকারের সঙ্গে বিএনপির কোনো গোপন যোগাযোগ আছে কি না— এমন প্রশ্নে মির্জা ফখরুল সাফ জানিয়ে দেন, এ ধরনের কোনো যোগাযোগ নেই। তাদের সঙ্গে কোনো পর্যায়েই কথাবার্তা নেই। কোনো কোনো গণমাধ্যম এ নিয়ে যা খুশি তাই  লিখছে। সম্প্রতি সদ্য বিদায়ী ভারতের রাষ্ট্রদূত পঙ্কজ শরণের সঙ্গে বিএনপির এক নেতার ডিনার পার্টিকে কোনো কোনো গণমাধ্যম বলল, বিএনপি নেতাদের সঙ্গে গোপন বৈঠক। এ নিয়ে কিইবা বলার আছে।

সর্বশেষ খবর