সোমবার, ২১ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা
সরেজমিন কিশোরগঞ্জ

গোপনে নৌকায় ভোট চাইছে বিএনপি!

শেখ সফিউদ্দিন জিন্নাহ, কিশোরগঞ্জ থেকে ফিরে

দেশের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী জেলা কিশোরগঞ্জ। ঐতিহাসিক অনেক ঘটনার সাক্ষী এই কিশোরগঞ্জ জেলা। রয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ আস্থাভাজন ও স্বাধীন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক সৈয়দ নজরুল ইসলামের স্মৃতি। আর এই পৌরসভার আসন্ন নির্বাচনকে ঘিরে সাধারণ মানুষের মাঝে রয়েছে ব্যাপক কৌতূহল। বিএনপি-জাতীয় পার্টিসহ অন্যান্য ছোট-বড় দলের নেতা-কর্মীরা গোপনে গোপনে নৌকার প্রার্থীর পক্ষে ভোট চাওয়ার ঘটনা ব্যাপক কৌতূহলের সৃষ্টি করেছে। আর এতে অনেকটা বেকায়দায় রয়েছেন ধানের শীষের প্রার্থী। তবে জামায়াতের নেতা-কর্মীরা ধানের শীষের পক্ষেই কাজ করছেন। অন্যদিকে জাতীয় পার্টির কোনো প্রার্থী না থাকায় নেতা-কর্মীরা বিভক্ত হয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রার্থীর পক্ষে কাজ করছেন। এখানে আওয়ামী লীগের নৌকার মেয়র প্রার্থী মো. পারভেজ, বিএনপির ধানের শীষের মেয়র প্রার্থী মাজহারুল ইসলাম ও সিপিবির কাস্তের মেয়র প্রার্থী আবুল হাসেম। মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যেই। তবে প্রচারণায় কমতি নেই সিপিবি প্রার্থী আবুল হাসেমের। পৌর এলাকার একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত চষে বেড়াচ্ছেন তিন প্রার্থীই। ইতিমধ্যে সাধারণ ভোটারদের মধ্যে নির্বাচনকে ঘিরে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখা দিয়েছে। তবে বিএনপির অনেক কর্মী আত্মীয়দের বাড়ি বাড়ি গিয়ে নিজ দলের প্রার্থীর পক্ষে ভোট না চেয়ে নৌকার পক্ষেই ভোট চাচ্ছেন বলে অভিযোগ করেন বিএনপির একাধিক নেতা। তবে জামায়াতের নেতা-কর্মীদের প্রকাশ্যে না দেখা গেলেও বিচ্ছিন্নভাবে ধানের শীষের পক্ষে কাজ করছেন বলে জানায় জামায়াতের নেতারা। অন্যদিকে প্রচারণায় পিছিয়ে নেই কাউন্সিলর প্রার্থীরাও। ভোটারদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে নিজের প্রতীকে ভোট প্রার্থনা করছেন। বিশেষ করে মহিলা কাউন্সিলরদের বাড়ির মা-বোনদের কাছে খোলামেলাভাবে ভোট চাইতে দেখা গেছে। এদিকে পৌরসভার ৯ ওয়ার্ডের নরসুন্দা নদীর দক্ষিণপাড়ে চারটি ও উত্তরপাড়ে পাঁচটি ওয়ার্ড হওয়ার কারণে নির্বাচনটি এখন অঞ্চলভিত্তিক হয়েছে। বিশেষ করে বৃহত্তর গ্রাম শোলাকিয়ায় চারটি ওয়ার্ড থাকায় আঞ্চলিকতাটা হয়েছে। এর মধ্যে ২ নম্বর ওয়ার্ডের শোলাকিয়া কানিকাটা এলাকায় আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকার প্রার্থী মো. পারভেজের বাড়ি হওয়ায় এই সুবিধাটা বেশি পাচ্ছেন তিনি। অন্যদিকে বিএনপি মনোনীত ধানের শীষের প্রার্থী মাজহারুল ইসলাম এই আঞ্চলিক সুবিধাটা পাননি। অন্যদিকে বৃহত্তর শোলাকিয়া গ্রামে বিএনপি সমর্থিত ভোটারের সংখ্যা বেশি হলেও এখানকার সাধারণ ভোটাররা দলের চেয়ে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছেন আঞ্চলিকতাকে। আর এসব কারণেই বিএনপির কর্মীরা এখন নৌকার পক্ষে গোপনে কাজ করছেন। এ বিষয়ে কিশোরগঞ্জ জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক এমপি মো. মাসুদ হিলালী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমি দলের পক্ষে তিন তিনবার আওয়ামী লীগের হেভিওয়েট নেতা সৈয়দ আশরাফের সঙ্গে সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছি। একবার (১৫ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগ বর্জিত নির্বাচন) এমপিও হয়েছি। তারপরও দলের সিদ্ধান্তের বাইরে যাইনি। কিন্তু এবারের পৌর নির্বাচনে সরাসরি দলের প্রতীকে প্রার্থী দেওয়ার পর প্রার্থী বা বর্তমান কমিটির কেউ আমার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করেনি। তাই আমি চুপচাপ রয়েছি। তবে আমি শুনেছি ২ নম্বর ওয়ার্ডের বিএনপির কর্মীরা পারভেজের পক্ষে কাজ করছেন। এদিকে কিশোরগঞ্জ জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক মো. ইসরাইল মিয়া বিএনপির মনোনয়ন না পেয়ে অনেকটা অভিমান নিয়ে দলীয় কার্যক্রম থেকে দূরে রয়েছেন। শুধু তাই নয়, তার সমর্থক কর্মীরাও নির্বাচনী কার্যক্রম থেকে বিরত রয়েছেন। তবে এ বিষয়ে কিশোরগঞ্জ জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক মো. ইসরাইল মিয়া বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এতদিন হয়তো আমার কর্মীরা চুপচাপ ছিল কিন্তু এখন আর চুপ নেই। সবাই ধানের শীষের পক্ষে কাজ করছেন। তবে তিনি ধানের শীষের প্রার্থী মাজহারুল ইসলামের ব্যাপারে কোনো কথা বলতে রাজি হননি। এদিকে আওয়ামী লীগের নৌকার প্রার্থী মো. পারভেজ সকাল থেকেই পৌরসভার হারুয়া, বত্রিশসহ কয়েকটি এলাকায় গণসংযোগ করেছেন। এ সময় বত্রিশ এলাকায় একটি উঠোন বৈঠকও করেন। উঠোন বৈঠকে পাড়া-মহল্লার নারি-পুরুষদের কাছে ভোট প্রার্থনা করেন। সন্ধ্যায় পৌর এলাকার বটতলা ও ফার্মের মোড়ে দুটি পথসভা করেছেন। আওয়ামী লীগের নৌকার প্রার্থী মো. পারভেজ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, কিশোরগঞ্জ এলাকার এমপি হলেন সৈয়দ আশরাফ ভাই। আর আশরাফ ভাইয়ের সম্মানে এখানে কখনো আওয়ামী লীগ-বিএনপির মাঝে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব হয়নি। গত উপজেলা নির্বাচনে আশরাফ ভাইয়ের আপন চাচাতো ভাই টিটু আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে নির্বাচন করলেও সুষ্ঠু নির্বাচনের কারণে বিএনপির প্রার্থী বিজয়ী হয়েছে। তবে বিএনপির কর্মীরা তার পক্ষে কাজ করার বিষয়টি তিনি অস্বীকার করেন। অন্যদিকে বিএনপির প্রার্থী মাজহারুল ইসলাম গতকাল সকাল থেকে পৌর এলাকার গাইটাল, রেলস্টেশন এলাকাসহ কয়েকটি এলাকায় গণসংযোগ করেন। সন্ধ্যায় শহরের আখড়া বাজারে একটি পথসভা করেন। বিএনপির প্রার্থী মাজহারুল ইসলাম বলেন, আমার জানামতে বিএনপির কোনো নেতা-কর্মী বিরোধিতা করছেন না। তবে হয়তোবা কেউ কেউ আত্মীয়তার কারণে পারভেজের পক্ষে কাজ করছেন। তবে জাতীয় পার্টির বিষয়ে আমার জানা নেই। তিনি আরও বলেন, দলীয় সিদ্ধান্ত না মানলে তাদের বিরুদ্ধে দলই সিদ্ধান্ত নেবে। কিশোরগঞ্জ জেলা জাতীয় পার্টির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আশরাফ উদ্দিন রেনু বলেন, দলীয়ভাবে কোনো মেয়র প্রার্থী না থাকায় নেতা-কর্মীরা তাদের ইচ্ছেমতো নির্বাচন করছেন। কেউ আওয়ামী লীগ আবার কেউ বিএনপির পক্ষে কাজ করছেন বলেও তিনি স্বীকার করেন। গতকাল সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, সকাল থেকেই মেয়র প্রার্থীদের ভোটারদের বাড়ি গিয়ে ভোট প্রার্থনা করতে দেখা গেছে। পৌর শহরের অলি-গলি এখন পোস্টারে পোস্টারে ছেয়ে গেছে। কিশোরগঞ্জ কাচারি বাজারের ফল বিক্রেতা নাসিম বলেন, ‘এনো ভোড অয় এইপারে হেইপারে। তাইলে হুনতাছি বিএনপির কেউ কেউ পারভেজ ভাইরে ভোড দিব।’ চা দোকানি আজিজ বলেন, ‘কিতা কইতাছুন, এইহানে আশরাফ ভাইয়ের বাড়ি, এইহানে কহুনো ক্রাইম অয়না। অবেও না।’ রিটার্নিং অফিসার কাজী আবেদ হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, কিশোরগঞ্জ পৌর নির্বাচন সবচেয়ে সুষ্ঠুভাবেই হচ্ছে। এ পর্যন্ত কোনো আচরণ বিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ আমরা পাইনি। অন্যদিকে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী মো. পারভেজ। তিনি কিশোরগঞ্জ জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি, জেলা যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় যুবলীগের সদস্য ছিলেন। বিএনপি দলীয় মেয়র প্রার্থী মাজহারুল ইসলাম কিশোরগঞ্জ জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এবং সিপিবির প্রার্থী আবুল হাসেম জেলা সিপিবির সম্পাদকমণ্ডলীর মেম্বার। নির্বাচন অফিস সূত্রে জানা গেছে, ১৮৬৯ সালে প্রতিষ্ঠিত প্রথম শ্রেণির এই পৌর সভায় ৯টি ওয়ার্ডে মোট ভোটার সংখ্যা ৬১ হাজার ৩১০ জন। এর মধ্যে পুরুষ ২৯ হাজার ৯৮৭ জন ও মহিলা ৩১ হাজার ৩২৩ জন। মেয়র পদে তিনজন, ৯টি ওয়ার্ডের সাধারণ কাউন্সিলর ৪৩ ও সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর সাতজন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।

সর্বশেষ খবর