শুক্রবার, ২৫ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

অভিযোগের পাহাড় প্রার্থীদের

গোলাম রাব্বানী

অভিযোগের পাহাড় প্রার্থীদের

পৌরসভা নির্বাচনকে ঘিরে অভিযোগের পাহাড় জমেছে নির্বাচন কমিশনসহ সারা দেশের রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয়ে। দলীয়ভাবে পৌরসভার মেয়র পদে নির্বাচন হওয়ায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিরোধী পক্ষ বিএনপির প্রার্থীরা পাল্টাপাল্টি অভিযোগ করছেন। যদিও ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীদের বিরুদ্ধেই বেশি অভিযোগ এসেছে ইসি সচিবালয়ে। অধিকাংশ প্রার্থী সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। এ ছাড়া প্রশাসনের বিরুদ্ধে পক্ষপাতসহ হয়রানিরও অভিযোগ তুলেছেন অনেক মেয়র প্রার্থী। এর মধ্যে গতকাল হবিগঞ্জ-৩ ও সিরাজগঞ্জ-৬ আসনের সংসদ সদস্যকে সতর্ক করে দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। আর রিটার্নিং অফিসারদের বলা হয়েছে, আচরণবিধি লঙ্ঘন হলে তাত্ক্ষণিক দৃশ্যমান ব্যবস্থা নিতে হবে।

এদিকে পৌরসভায় সুষ্ঠু ভোট নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন খোদ ক্ষমতাসীন দলের এমপি শওকত আলী। নবম সংসদের এই ডেপুটি স্পিকার নিজ এলাকার এক মেয়র প্রার্থীর বিরুদ্ধে অভিযোগ জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশনে। এ ছাড়া বিএনপির পক্ষ থেকেও তোলা হচ্ছে নানা অভিযোগ। তাদের একটি প্রতিনিধিদল অন্তত ১৭টি পৌরসভায় সুনির্দিষ্টভাবে তাদের প্রচার কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগ দিয়েছে ইসিতে। এসব অভিযোগের বেশির ভাগ স্থানীয় পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে। এ ছাড়া অন্তত ১৪টি থানার ওসির বিরুদ্ধে স্থানীয় এমপির নির্দেশে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীর পক্ষাবলম্বনের অভিযোগ রয়েছে। বেশ কয়েকজন আওয়ামী লীগ প্রার্থী ইসিতে লিখিতভাবে এ অভিযোগ দায়ের করেছেন।

ইসি সূত্র জানিয়েছে, গতকাল পর্যন্ত বিভিন্ন পৌরসভা থেকে ইসি সচিবালয়ে শতাধিক অভিযোগ এসেছে। এ ছাড়া ২৩৪ পৌরসভার রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয়েও অভিযোগের স্তূপ জমেছে। কিন্তু কোনো অভিযোগ খতিয়ে দেখা হচ্ছে না বলেও প্রার্থীরা   জানিয়েছেন। কমিশন সচিবালয়ের একজন উপ-সচিবের নেতৃত্বে দুই সদস্যের একটি মনিটরিং টিম গঠন করা হয়েছে। এ কমিটির কাজ হচ্ছে— গণমাধ্যমের খবর সম্পর্কে ব্যাখ্যা চেয়ে সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং অফিসারকে চিঠি দেওয়া। এক্ষেত্রে রিটার্নিং অফিসারদের কোনো সময়সীমাও বেঁধে দেওয়া হচ্ছে না। অনেক সময় অভিযোগের সত্যতা যাচাই না করেই সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অভিযোগের সত্যতা নেই। ভোটের দিন যতই ঘনিয়ে আসছে ততই অভিযোগ বাড়ছে নির্বাচন কমিশনে। ইসি কর্মকর্তারা অন্তত ৭০টি পৌরসভায় বিধি লঙ্ঘন ও হামলা-সংঘর্ষের অভিযোগ শনাক্ত করেছেন।

আসন্ন পৌরসভায় সুষ্ঠু ভোটের আশ্বাস নির্বাচন কমিশন এবং সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া হলেও নিজের এলাকা শরীয়তপুরের নড়িয়া নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন শরীয়তপুর-২ আসনের ক্ষমতাসীন দলের সংসদ সদস্য শওকত আলী। তিনি নিজেই নড়িয়া পৌরসভায় তার দলের ‘বিদ্রোহী’ মেয়র প্রার্থীর বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে হাজির হন। তিনি বলেন, বিদ্রোহী প্রার্থী ‘ত্রাস’ সৃষ্টি করেছেন নড়িয়ায়। ফলে সুষ্ঠু ভোট নিয়ে সংশয়ে আছেন তিনি। নড়িয়া পৌরসভায় মোটরসাইকেল নিয়ে মহড়া দেওয়া হচ্ছে। আচরণবিধি হরদম লঙ্ঘিত হচ্ছে, অস্থির অবস্থা, ত্রাসের অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। এ অভিযোগ শুধু নড়িয়ায় নয়, সারা দেশের বিভিন্ন পৌরসভার চিত্র এমনটাই বলে মনে করছেন নির্বাচন সংশ্লিষ্টরা। এসবের মধ্যে কুমিল্লার লাকসাম, চাঁদপুরের কচুয়া, পটুয়াখালীর কলাপাড়া, রাজশাহীর তাহেরপুর, নরসিংদী, ময়মনসিংহের গৌরীপুর, জামালপুরের ইসলামপুর, নোয়াখালীর চৌমুহনী, চাঁপাইনবাবগঞ্জের রহনপুর, সিলেটের গোলাপগঞ্জ, শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ (২টি অভিযোগ), হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ, সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর, ঢাকার সাভার ও ধামরাই, নড়াইল সদর ও কালিয়া, মুন্সীগঞ্জের মীরকাদিম, চাঁদপুরের ছেঙ্গারচর, ঝিনাইদহের মহেশপুর, চট্টগ্রামের চন্দনাইশ, শেরপুর সদর, ময়মনসিংহের ফুলপুর ও রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ পৌরসভায় বেশি অভিযোগ রয়েছে।

বাংলাদেশ প্রতিদিনের প্রতিনিধিদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী— বন্দরনগরী চট্টগ্রামেও অভিযোগের শেষ নেই। উঠছে পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মেয়র প্রার্থীর পক্ষে পক্ষপাতিত্ব করার অভিযোগও। পৌরসভায় রিটার্নিং কর্মকর্তা বরাবরে মৌখিক অভিযোগ আসছে প্রতিনিয়ত। তবে চট্টগ্রামের মীরসরাই, বারৈয়ারহাট, রাউজান, সন্দ্বীপ, সাতকানিয়া ও পটিয়ায় মোট ১৬টি অভিযোগ। এর মধ্যে মীরসরাই ও বারৈয়ারহাট পৌরসভায় প্রচারণায় বাধা, সংঘর্ষ ও পোস্টার ছেঁড়ার অভিযোগ রয়েছে ১২টি। রাউজান, সাতকানিয়া, সন্দ্বীপ ও সীতাকুণ্ডেও রয়েছে অভিযোগ। টাঙ্গাইলের ৮টি পৌরসভার প্রার্থীরা এ পর্যন্ত ৫৭টি অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ দায়ের করেছেন সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং অফিসারদের কাছে। অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগের বিষয়ে প্রার্থীদেরও কারণ দর্শানোর নোটিস দিয়েই দায় সারছেন রিটার্নিং অফিসার। কুমিল্লা জেলা নির্বাচন অফিসে পৌর নির্বাচনে বিধি লঙ্ঘনের নানা অভিযোগ আসছে। ছয়টি পৌরসভায় ২০টির মতো অভিযোগ পড়েছে। কিশোরগঞ্জের সাতটি পৌর নির্বাচনে এ পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে ছয়টি অভিযোগ জমা পড়েছে। পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি পৌরসভায় নৌকা প্রতীকে মেয়র পদে নির্বাচন করছেন পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. গোলাম কবির। ধানের শীষের প্রার্থী বিএনপি নেতা শফিকুল ইসলাম ফরিদ। নির্বাচনের শুরু থেকেই ফরিদের আশঙ্কা নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ নিয়ে। নির্বাচনের দিন যতই এগিয়ে আসছে ততই শঙ্কা বাড়ছে ধানের শীষের প্রার্থীর। শফিকুল ইসলাম ফরিদ অভিযোগ করেন, তার প্রতিপক্ষ প্রার্থীর লোকজন তার কর্মী-সমর্থকদের প্রতিনিয়ত ভয়ভীতি হুমকি দিচ্ছে। বিভিন্ন স্থানে তার পোস্টার ছিঁড়ে ফেলছে। নির্বাচন কর্মকর্তাকে জানিয়েও কোনো লাভ হচ্ছে না।

সুনামগঞ্জের চার পৌরসভায় এ পর্যন্ত এক প্রার্থীর বিরুদ্ধে অপর প্রার্থী আচরণবিধি লঙ্ঘনের দুটি লিখিত অভিযোগ করেছেন। পাহাড়ি জনপদ বান্দরবানে দুটি  পৌরসভা। বান্দরবান কেচিংঘাটা জামে মসজিদে জুমার নামাজ পড়তে গিয়ে বান্দরবান পৌরসভার বিএনপির ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থী জাবেদ রেজা মসজিদের কার্পেট কিনে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

বাগেরহাটে পৌর নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে নির্বাচনী পরিবেশ ততই খারাপ থেকে উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। প্রার্থী ও তার সমর্থকদের বিরুদ্ধে নির্বাচনী আচরণবিধি ভঙ্গের পাল্টাপাল্টি অভিযোগ করছেন প্রতিপক্ষ প্রার্থীরা। রংপুরের বদরগঞ্জ পৌরসভা নির্বাচনে আচরণবিধি লঙ্ঘনের ১০টি অভিযোগ রয়েছে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া পৌরসভা নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থী মো. তাকজিল খলিফার বিরুদ্ধে আচরণবিধি ভঙ্গের অভিযোগ করেছেন বিএনপি মনোনীত মেয়র প্রার্থী হাজী মো. মন্তাজ মিয়া। রিটার্নিং অফিসারের কাছে  লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন তিনি। নির্বাচনে আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে কুড়িগ্রামের এমপি মাঈদুল ইসলাম মুকুলের বিরুদ্ধে। তার বিরুদ্ধে নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ করেছেন বিএনপির প্রার্থী তারেক আবুল আলা চৌধুরী ও (আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী) সাজাদুর রহমান সাজু। সাতক্ষীরার কলারোয়া পৌরসভার দুজন মেয়র প্রার্থী রিটার্নিং অফিসারের কাছে একে অপরের বিরুদ্ধে পাল্টাপাল্টি আচরণবিধি লঙ্ঘনের লিখিত অভিযোগ করেছেন। নেত্রকোনায় এ পর্যন্ত প্রায় পাঁচটি অভিযোগ এসেছে দেয়ালে পোস্টার লাগানো এবং শোডাউনসহ বিভিন্ন নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের।

লক্ষ্মীপুরের রায়পুর পৌরসভা নির্বাচনে আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী ইসমাইল হোসেন খোকন  ও বিএনপির প্রার্থী এ বি এম জিলানীকে (বর্তমান মেয়র) কারণ দর্শানোর নোটিস দিয়েছেন রিটার্নিং অফিসার। পটুয়াখালীর কলাপাড়া পৌর নির্বাচনে বিএনপির মেয়র প্রার্থী হাজী হুমায়ুন শিকদার পৌর নির্বাচনে পাঁচটি ভোটকেন্দ্রকে অতি ঝুঁকিপূর্ণ বলে নির্বাচন কমিশনকে জানিয়েছেন। ফরিদপুরের নগরকান্দায় পৌরসভা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী (স্বতন্ত্র) প্রার্থী মুরাদ হোসেন বিকুল মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে হয়রানির চেষ্টা করা হতে পারে বলে আশংকা প্রকাশ করেছেন। তিনি প্রধান নির্বাচন কমিশনার বরাবরে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন। তিনি বলেছেন, আমার লোকজনকে বিভিন্নভাবে হুমকি-ধমকি দেওয়া হচ্ছে। ফলে আমি ও আমার লোকজন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। মেয়র প্রার্থীর পাশাপাশি সাধারণ কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত কাউন্সিলর প্রার্থীদের বিরুদ্ধেও অভিযোগের শেষ নেই। ঝালকাঠির নলছিটি পৌরসভা নির্বাচনে তিন কাউন্সিলর প্রার্থী একে অপরের বিরুদ্ধে আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ করেছেন। একইভাবে সারা দেশে কাউন্সিলর প্রার্থীদের বিরুদ্ধে অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে।

সর্বশেষ খবর