শুক্রবার, ২৫ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

আওয়ামী লীগ নেতার বাড়িতে জঙ্গি আস্তানা

বিস্ফোরক গ্রেনেড সরঞ্জাম উদ্ধার আটক ৭

নিজস্ব প্রতিবেদক

আওয়ামী লীগ নেতার বাড়িতে জঙ্গি আস্তানা

মিরপুরে গতকাল বাড়িতে জঙ্গি আস্তানায় অভিযান চালায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। উদ্ধার করা হয় গ্রেনেড ও সরঞ্জাম —রোহেত রাজীব

রাজধানীর মিরপুর-১ নম্বর সেকশনের একটি বহুতল ভবনের জঙ্গি আস্তানায় টানা ১২ ঘণ্টা অভিযান চালিয়েছে মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। এ অভিযানে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ—জেএমবির তিন শীর্ষ জঙ্গিসহ সাতজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বুধবার দিবাগত রাত দেড়টা থেকে শুরু হওয়া এ অভিযান গতকাল বিকাল ৩টায় শেষ হয়। এ অভিযানে ১৬টি গ্রেনেড, বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক ও কয়েকটি ‘সুইসাইড ভেস্ট’ জব্দ করা হয়েছে। পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (গণমাধ্যম) জাহাঙ্গীর আলম জানান, আগের রাতে এক জেএমবি সদস্যকে গ্রেফতারের পর তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে শাহ আলী থানার ৯ নম্বর রোডের এ ব্লকের ৩ নম্বর বাড়িতে অভিযান চালানো হয়। পুলিশের সঙ্গে র‌্যাব ও সোয়াট ইউনিটের সদস্যরা এ অভিযানে অংশ নেন। ওই বাড়ির ছয় তলার একটি ফ্ল্যাটে এক ডজনের বেশি হাতে তৈরি গ্রেনেড পাওয়া যায়। বেলা ১টায় পুলিশের বোমা নিষ্ক্রিয়করণ ইউনিটের এক সদস্য গামছা দিয়ে মোড়ানো অবস্থায় গ্রেনেডগুলো ১০০ গজ দূরে সারেংবাড়ি মাজারসংলগ্ন একটি খালি প্লটে নিয়ে রাখেন। পরে ১টা ২০ মিনিটে গাড়ির টায়ার ও ইট বালুর বস্তা দিয়ে ঘিরে একটি গ্রেনেড নিষ্ক্রিয় করা হয়। পরে বিকাল ৪টা পর্যন্ত একে একে আরও সাতটি গ্রেনেড নিষ্ক্রিয় করা হয়। বোমাগুলো নিষ্ক্রিয় করার সময় বিকট শব্দে তা বিস্ফোরিত হয়। দুপুরেও ভবনটির বাইরে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ও আইনশৃঙ্খল রক্ষাকারী বাহিনীর বিপুলসংখ্যক সদস্যকে অবস্থান করতে দেখা যায়। এ ঘটনায় ভোর থেকে উত্সুক মানুষ ওই বাড়ির সামনে ভিড় করেন। এতে ওই সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে পড়লে এর প্রভাব অন্যান্য সড়কে ছড়িয়ে পড়ে। বেলা ১টার দিকে পুলিশ ওই বাড়ির সামনে থেকে সবাইকে সরিয়ে দেয়। এ ঘটনায় শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত শাহ আলী থানায় মামলা প্রক্রিয়াধীন ছিল।

যেভাবে শুরু হয় অভিযান : গতকালের অভিযানে নেতৃত্ব দেন ডিবির অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) ছানোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, বুধবার সন্ধ্যায় এক জেএমবি সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়। তার দেওয়া তথ্যানুযায়ী, মিরপুরের ওই বাড়িতে অভিযান শুরু করে পুলিশ। দিবাগত রাত ৩টার দিকে পুলিশ ওই ফ্ল্যাটে গেলে ভিতর থেকে দরজা খোলা হচ্ছিল না। এ সময় পুলিশ ভবনের ভিতর ও বাইরে অবস্থান নেয়। ফজরের আজানের পর পুলিশ এ বাড়ির সব লোককে নিরাপদে সরিয়ে দেয়। সকাল ৭টার দিকে ওই ফ্ল্যাটের দরজা ভেঙে পুলিশ ভিতরে ঢোকে। সেখান থেকে জেএমবির তিন সদস্য ও পাশের ফ্ল্যাট থেকে সন্দেহভাজন হিসেবে আরও চারজনকে আটক করা হয়।

প্রত্যক্ষদর্শীরা যা বলেন : ছয় তলা ভবনের নিচতলার বাসিন্দা জাহানারা বেগম জানান, রাত দেড়টার দিকে ডিবির সদস্যরা এ বাড়ি ঘিরে ফেলেন। অভিযান চলার সময় তারা কয়েক দফা বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পান। রাতেই পুলিশ তিন যুবককে ধরে নিয়ে যায়। আর গতকাল সকাল সাড়ে ১০টার দিকে চারজনকে নিয়ে যায়। ওই বাড়ির দ্বিতীয় তলার বাসিন্দা কামাল আহমেদ জানান, চলতি বছরের ১ অক্টোবর ওই ফ্ল্যাটে মেস ভাড়া দেওয়া হয়। বেশ কয়েকজন যুবককে তারা মেসে আসা-যাওয়া করতে দেখেছেন। তবে তারা কী করতেন, তা জানেন না। ছয় তলার বাসিন্দা মিলন নামে এক যুবক বলেন, পুলিশ ফ্ল্যাটে ঢুকতে গেলে ভিতরে থাকা যুবকদের সঙ্গে ধস্তাধস্তির ঘটনা ঘটে। একপর্যায়ে পুলিশ ভিতরে ঢুকলে ওই যুবকরা বিস্ফোরণ ঘটায়। গুলির ঘটনাও ঘটে। এ সময় পুলিশ তিনজনকে ধরে ফেললে অন্যরা পাশের কক্ষে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দেয়। এ সময় পরপর কয়েকটি বোমার বিস্ফোরণ ঘটে। জঙ্গিরা গ্রেনেড ছুড়লে পুলিশও পাল্টা গুলি করে।

পুলিশের বক্তব্য : মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, অভিযানের সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপস্থিতি টের পেয়ে ভবনের ভিতর থেকে গ্রেনেডের বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। এতে ভবনের তিনটি ফ্ল্যাটের জানালার কাচ ভেঙে যায়। জবাবে পুলিশও গুলি করতে বাধ্য হয়। ভবনের অন্য বাসিন্দাদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়ার পরই সেখানে অভিযান চালানো হয়। আটকদের বয়স ২০ থেকে ৩৫-এর মধ্যে জানিয়ে তিনি বলেন, এদের মধ্যে অন্তত তিনজন জেমএবির গুরুত্বপূর্ণ নেতা। জিজ্ঞাসাবাদ করে বাকিদের পরিচয় জানা যাবে। তিনি জানান, আটকদের ডিবি কার্যালয়ে নেওয়া হয়েছে। সাতজনের মধ্যে ছয়জনকে পাওয়া গেছে ওই ভবনের ছয় তলায়। আর বাকি একজনকে রাতেই বিস্ফোরকসহ গ্রেফতার করা হয়। অভিযানে যে পরিমাণ বিস্ফোরক জব্দ করা হয়েছে, তা দিয়ে ২০০ গ্রেনেড তৈরি করা যেত। মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার ও জঙ্গি প্রতিরোধ টিমের প্রধান ছানোয়ার হোসেন বলেন, হোসনি দালান, কামরাঙ্গীরচরসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে এর আগে যে ধরনের হাতে তৈরি গ্রেনেড উদ্ধার করা হয়েছিল, এ ভবনের বিস্ফোরকগুলোও সে রকম। ছয় তলার পাশাপাশি দুটি ফ্ল্যাটে অভিযান চালানো হয়। একটি ফ্ল্যাট থেকে বিস্ফোরকসহ দুজনকে আটক করা হয়। সেখানেই রান্নাঘরে, লোহার ট্রাংক এবং কাপড়ে পেঁচানো অবস্থায়ও বিস্ফোরকগুলো পাওয়া যায়। আর পাশের ফ্ল্যাট থেকে আটক বাকি চারজনের পরিচয় জানার চেষ্টা চলছে বলে এই পুলিশ কর্মকর্তা জানান। বাড়ির মালিকের বরাত দিয়ে ছানোয়ার আরও বলেন, ভাড়া নেওয়ার সময় যুবকরা নিজেদের স্থানীয় একটি কলেজের ছাত্র হিসেবে পরিচয় দিয়েছিল। এরা ওই বাসায় গ্রেনেড বানানোর কাজ করত বলে প্রাথমিকভাবে আমরা ধারণা করছি।

ভবন মালিক যা বলেন : জঙ্গি আস্তানার ভবন মালিক আবুল হোসেন ভূইয়া বলেন, চার মাস আগে ভবনের ছয় তলার পেছনের ফ্ল্যাটটি মাসে ৩০০০ টাকায় সাবলেট দেওয়া হয়। ভাড়া নেওয়ার সময় পরিচয় দিয়েছিল ব্যবসা করেন। কী ব্যবসা করেন জানতে পারিনি। ভাড়া নেওয়ার সময় ফ্যামিলি আছে বলে জানিয়েছিলেন। আবুল হোসেন ভূইয়া প্রতিবেশীদের কাছে আলী নামে পরিচিত। তিনি ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের ১ নম্বর ইউনিটের সাবেক সভাপতি। বর্তমানে তিনি বার্ধক্যজনিত রোগে আক্রান্ত। অভিযান চলার সময় তিনি ভবনের নিচ তলায় উপস্থিত ছিলেন।

ঘটনাস্থলে দুজন সংসদ সদস্য : জঙ্গি আস্তানায় অভিযানের খবর পেয়ে স্থানীয় সংসদ সদস্য মো. আসলামুল হক ও সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য সাবিনা আক্তার তুহিন ঘটনাস্থলে ছুটে যান। তারা দুজন পুলিশ ও র‌্যাবের অভিযান কার্যক্রম প্রত্যক্ষ করেন। এ সময় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৮ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর কাজী টিপু সুলতান উপস্থিত ছিলেন।

সর্বশেষ খবর