শনিবার, ৯ জানুয়ারি, ২০১৬ ০০:০০ টা

ঢালাও পরিবর্তন আওয়ামী লীগে

কাউন্সিলের প্রস্তুতি, কর্মীবান্ধব গণমুখী সংগঠন করতে চান শেখ হাসিনা

রফিকুল ইসলাম রনি

ঢালাও পরিবর্তন আওয়ামী লীগে

ঢালাও পরিবর্তন আসছে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদে। বাদ পড়ছেন বিতর্কিতরা। দলের গঠনতন্ত্রেও আনা হচ্ছে সংশোধনী। গত দুই জাতীয় কাউন্সিলে তেমন কোনো পরিবর্তন না হলেও এবার সাংগঠনিক সম্পাদক পদে আসছে আমূল পরিবর্তন। যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক পদেও আসতে পারে নতুন মুখ। দলের সর্বোচ্চ নীতি-নির্ধারণী ফোরাম প্রেসিডিয়াম পদেও রয়েছে পরিবর্তনের আভাস। আজ আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে কাউন্সিলের তারিখ চূড়ান্ত করা হবে। দলীয় একটি সূত্র জানিয়েছে, ২৯ জানুয়ারি শুক্রবার সম্মেলন করার পক্ষে দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা। তবে কোনো কারণে ওই তারিখে সম্মেলন না হলে ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে হবে শাসক দলের ২১তম জাতীয় কাউন্সিল।  জানা গেছে, ২০১২ সালের ২৯ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের সর্বশেষ কাউন্সিল হয়। দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী বর্তমান কার্যনির্বাহী সংসদের মেয়াদ গত ডিসেম্বরে শেষ হয়েছে। ডিসেম্বরে কাউন্সিল করার কথা থাকলেও পৌরসভা নির্বাচনের কারণে তা হয়নি। আগামী ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভা নির্বাচনের আগেই কেন্দ্রীয় সম্মেলন শেষ করতে চায় আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড। এ লক্ষ্যে শুরু হয়েছে প্রস্তুতি। আওয়ামী লীগের কাউন্সিল ঘিরে সাংগঠনিক তত্পরতার পাশাপাশি দলের অভ্যন্তরে শুরু হয়েছে নানা লবিং-গ্রুপিং। সূত্রমতে, দলের কেন্দ্রীয় সম্মেলন নিয়ে প্রেসিডিয়ামের দুজন সদস্য অতিসম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কথা বলেন। এ সময় তিনি ২৯ জানুয়ারি কাউন্সিল করা যেতে পারে বলে আভাস দেন। আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফরউল্লাহ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আজ শনিবার কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠকে কেন্দ্রীয় কাউন্সিলসহ সদ্য অনুষ্ঠিত ও আসন্ন পৌরসভা নির্বাচনের কিছু বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন প্রেসিডিয়াম সদস্য জানিয়েছেন, বিগত কাউন্সিলে কিছু পদে  পরিবর্তন জরুরি ছিল, কিন্তু করা হয়নি। এবার বেশকিছু পরিবর্তন আনতে পারেন দলীয় সভাপতি। কিছু নেতা দলীয় পদপদবির অপব্যবহার করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। দলের সব পর্যায়ের নেতার সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড শুরু করে তাদের ব্যক্তিগত, সামাজিক ও ব্যবসায়িক সব ধরনের তথ্যই নেত্রীর জানা। কাউন্সিলে সেসব বিবেচনা ও মূল্যায়ন করা হবে। বিগত দিনে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে নিষ্ক্রিয় আর সক্রিয় থাকার বিষয়টি বিবেচনা করা হবে।  সূত্রমতে, সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে আনার প্রশ্নে এবার মাঠের ত্যাগী ও পরীক্ষিত এবং ছাত্রলীগের সাবেক নেতাদের মূল্যায়ন করা হবে। কার্যনির্বাহী সংসদের কলেবর বাড়ানোর গুঞ্জন থাকলেও নীতি-নির্ধারকরা বলছেন, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সংখ্যা থাকবে অপরিবর্তিত। তবে নতুন কিছু পদ সৃষ্টি করা হতে পারে। সূত্রটি জানায়, এবারের কাউন্সিলে আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রে পরিবর্তন আনা হবে। বর্তমানে সাত বিভাগে একটি করে সাংগঠনিক সম্পাদকের পদ রয়েছে। ময়মনসিংহ, ফরিদপুর ও কুমিল্লা নতুন তিনটি বিভাগ হলে সাংগঠনিক সম্পাদকের পদ বৃদ্ধি করে ১০ করা হতে পারে। সাধারণ সম্পাদকের সমমর্যাদায় দলের মুখপাত্রের পদ সৃষ্টি হতে পারে। প্রতিনিয়তই দলের পক্ষ থেকে কোনো না কোনো ইস্যুতে বক্তব্য দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা থেকেই পদটির কথা চিন্তা করা হচ্ছে। দলের বর্তমান গঠনতন্ত্রে মুখপাত্রের বিষয়টি স্পষ্ট না থাকলেও দলের সাধারণ সম্পাদকই মুখপাত্রের দায়িত্ব পালন করে আসছেন। এর বাইরে নতুন করে তথ্য ও প্রযুক্তি (আইসিটি), প্রশিক্ষণ, মানবাধিকারসহ কয়েকটি সম্পাদকীয় পদ সৃষ্টি করা হতে পারে। এ ছাড়া প্রচার ও প্রকাশনা, শিল্প ও বাণিজ্য, কৃষি ও সমবায়সহ কয়েকটি সম্পাদকীয় পদকে ভেঙে এর সংখ্যা বাড়ানো হতে পারে। আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, দলটির কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের মোট সদস্য ৭৩ জন। এর মধ্যে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ প্রেসিডিয়াম সদস্য ১৫ জন, সাধারণ সম্পাদকসহ সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য ৩২ জন। একজন কোষাধ্যক্ষ ও সভাপতি মনোনীত সদস্য ২৬ জন।  প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাসের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আওয়ামী লীগ সব সময়ই তার জেলা-উপজেলাসহ শাখা ইউনিট বৃদ্ধি করে আসছে। দলের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদ এই শাখা ইউনিটগুলোর অনুমোদন দিয়ে থাকে। নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর শহর সিটি করপোরেশনে উন্নীত হওয়ায় এ দুই মহানগরীকে ইতিমধ্যে জেলা শাখার মর্যাদা দিয়ে নতুন কমিটিও গঠন করা হয়েছে। এ দুটি শাখা যুক্ত হওয়ায় দলটির সাংগঠনিক জেলা ৭৩টি থেকে বেড়ে ৭৫টি হয়েছে। এখনো কার্যকর না হলেও কার্যনির্বাহী সংসদ ঢাকা মহানগরীকেও দুইভাগে ভাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছে। এদিকে ময়মনসিংহ বিভাগের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হলে জেলার মর্যাদা দিয়ে বিভাগীয় শহরটিতে আরেকটি ইউনিট অনুমোদন দেওয়া হবে। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত ফরিদপুর ও কুমিল্লাকে বিভাগ করা হলে সেখানেও একই ধরনের অর্থাত্ জেলার মর্যাদায় মহানগর কমিটি গঠনের পদক্ষেপ নেওয়া হবে।  সূত্রমতে, দলের সাত সাংগঠনিক সম্পাদকই দুই মেয়াদে দায়িত্ব পালন করেছেন। এরমধ্যে অন্তত চারজন তাদের সাংগঠনিক দক্ষতা দিতে ব্যর্থ হয়েছেন বলে মনে করেন দলের নীতি-নির্ধারণী মহল। আগামী কাউন্সিলে কপাল পুড়তে পারে তাদের। প্রেসিডিয়াম সদস্যদের মধ্যে যারা নিষ্ক্রিয় বাদ পড়তে পারেন তারাও। গুরুত্বপূর্ণ সম্পাদকীয় পদে থেকেও দলকে তেমন কিছু দিতে পারেননি বেশ কয়েকজন নেতা। দলের কাজে মনোযোগী হওয়ার চেয়ে তারা বেশি ব্যস্ত ছিলেন নিজেদের ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে। ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন এমন জনাদশেক নেতা। নামেই কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য দলের কার্যনির্বাহী কমিটির মিটিং ছাড়া কোথায়ও পাওয়া যায় না এমন নেতার সংখ্যাও কম নয়। পদ হারাতে হতে পারে তাদেরও।  জানা গেছে, নতুন কমিটিতে সাবেক ছাত্রলীগ নেতাদের একটি বড় অংশের ঠাঁই হতে পারে। এ ক্ষেত্রে বাদ দেওয়া হবে বিতর্কিতদের। যারা বিগতদিনে নানাভাবে দলকে বিতর্কিত করেছেন, প্রভাব খাটাতে গিয়ে সংগঠনের ভাবমর্যাদা ডুবিয়েছেন তাদের স্থান এবার কেন্দ্রীয় কমিটিতে হবে না। ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা নেতা-কর্মীদের এমন বার্তা দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন অদক্ষ ও বিতর্কিতদের কোনোভাবেই দলে স্থান দেবেন না।

সম্মেলনের প্রস্তুতিতে ১০ কমিটি : আওয়ামী লীগের সম্মেলন ঘিরে ১০টি উপকমিটি করার কথা ভাবছেন দলটির কেন্দ্রীয় নেতারা। এর মধ্যে অভ্যর্থনা, খাদ্য, দফতর, সাজসজ্জা, প্রচার-প্রকাশনা, মঞ্চ, শৃঙ্খলা, স্বাস্থ্য, গঠনতন্ত্র সংশোধন, যোগাযোগ উপকমিটি গঠনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে দলের নীতিনির্ধারণী মহল। এ জন্য দলের কৃষি ও সমবায় বিষয়ক সম্পাদক ড. আবদুর রাজ্জাককে বিশেষ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তিনি দলীয় সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে কমিটি গঠন করবেন। গত শুক্রবার রাতে ধানমন্ডিতে দলের সিনিয়র নেতাদের এক বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে বলে দায়িত্বশীল একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছেন।

আজ বৈঠক : আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠক আজ। সন্ধ্যা ৬টায় গণভবনে দলীয় সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হবে। সভায় কেন্দ্রীয় সম্মেলন, সদ্য অনুষ্ঠিত পৌরসভা নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থীদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং বেশ কিছু জেলার অনুমোদন দেওয়া হতে পারে। বৈঠকে দলের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম সংশ্লিষ্টদের যথাসময়ে উপস্থিত থাকার অনুরোধ জানিয়েছেন।

সর্বশেষ খবর