সোমবার, ১১ জানুয়ারি, ২০১৬ ০০:০০ টা
ইজতেমার প্রথম পর্বে আখেরি মোনাজাত

দেশ জাতি ও বিশ্ব মানবতার কল্যাণ কামনা

মোস্তফা কাজল টঙ্গী থেকে ফিরে

দেশ জাতি ও বিশ্ব মানবতার কল্যাণ কামনা

বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্বের শেষ দিনে গতকাল তুরাগ তীরে ঢল নামে দেশ-বিদেশের ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের। আখেরি মোনাজাতে অংশ নিয়ে তারা আল্লাহর দরবারে ক্ষমা প্রার্থনা করেন —বাংলাদেশ প্রতিদিন

আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে গতকাল ৫১তম বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব শেষ হয়েছে। মোনাজাতে মহান আল্লাহর দরবারে দুই হাত তুলে কেঁদে কেঁদে ক্ষমা চেয়েছেন মুসল্লিরা। তারা পাপ থেকে মুক্তির জন্য আকুতি-মিনতি করেছেন। পাশাপাশি দেশ-জাতি-মানবতার কল্যাণ ও সমৃদ্ধি চেয়েছেন। মানুষের জন্য রহমত ও শান্তি কামনা করেছেন। আখেরি মোনাজাত পরিচালনা করেন দিল্লির তাবলিগ জামাতের শীর্ষ মুরব্বি মাওলানা মোহাম্মদ সা’দ। বেলা ১১টা ৮ মিনিটে শুরু হয়ে ১১টা ৩২ মিনিটে মোনাজাত শেষ হয়। এরপর চার দিন বিরতি দিয়ে ১৫ জানুয়ারি শুরু হবে দ্বিতীয় পর্বের আয়োজন। আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় পর্ব শেষ হবে ১৭ জানুয়ারি। প্রতিবারের মতো এবারের বিশ্ব এজতেমার প্রথম পর্বের আখেরি মোনাজাতে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীসহ মন্ত্রিপরিষদ সদস্য, সংসদ সদস্যসহ বিভিন্ন ব্যক্তিবর্গ অংশগ্রহণ করেছেন। রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ বঙ্গভবনে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবনে এবং বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া গুলশানে নিজ কার্যালয়ে টেলিভিশন সেটের সামনে বসে সরাসরি সম্প্রচার দেখে মোনাজাতে অংশ নেন। এ ছাড়া ইজতেমা মাঠের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল চোখে পড়ার মতো। আখেরি মোনাজাতে অংশ নিতে গতকাল ভোর থেকে টঙ্গীর তুরাগতীরে লাখো মুসল্লির ঢল নামে। টঙ্গী শহর, ইজতেমাস্থল ও এর আশপাশের এলাকা জনসমুদ্রে পরিণত হয়। যত দূর চোখ যায় শুধু মানুষ আর মানুষ দেখা যায়। মোনাজাত শুরুর সঙ্গে সঙ্গে মুসল্লিরা দুই হাত তুলে ‘আমিন’, আমিন ধ্বনি তোলেন। বিশ্ব ইজতেমার ময়দান ও এর আশপাশের কয়েক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে দেড় শতাধিক লাগানো মাইকে সেই ধ্বনি ছড়িয়ে পড়ে। মোনাজাত শুরু হতেই পুরো এলাকাজুড়ে নেমে আসে পিন পতন নীরবতা। খানিক পর পর শুধু ভেসে আসে আমিন, ছুম্মা আমিন, আল্লাহুম্মা আমিন। অনুতপ্ত মানুষের কান্নার আওয়াজে আকাশ বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। জীবনের সব পাপ-তাপ থেকে মুক্তির জন্য, পরম দয়াময় আল্লাহর দরবারে অনুনয়-বিনয় করে পানাহ ভিক্ষা করছিলেন তারা। ক্ষমা লাভের আশায় লাখো মানুষের সঙ্গে একত্রে হাত তুলতে দূরদূরান্ত থেকে ছুটে এসেছিলেন তারা ভোর থেকেই। বহু মানুষের অংশগ্রহণে ইহলোকের মঙ্গল, পরলোকের ক্ষমা, দেশের কল্যাণ, মুসলিম উম্মাহর ঐক্য ও বিশ্বশান্তি কামনার মধ্য দিয়ে শেষ হয়। গতকাল প্রথম পর্বের আখেরি মোনাজাতে প্রায় ১০ লক্ষাধিক মানুষ অংশ নিয়েছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রের ধারণা। এবারের ইজতেমায় গত ২৪ ঘণ্টায় এক বিদেশিসহ আরও তিন মুসল্লির মৃত্যু হয়। মোনাজাত শেষে বাদ যোহর জানাযা শেষে স্বজনের কাছে লাশ হস্তান্তর করা হয়। মোনাজাতে অংশ নিতে সকাল নাগাদ ইজতেমার মাঠ কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়। মুসল্লিরা মাঠের আশপাশের রাস্তা, অলিগলিতে অবস্থান নেন।

যানজটের কারণে ইজতেমাস্থলে পৌঁছাতে না পেরে অনেক মুসল্লি মহাসড়ক ও সড়কে অবস্থান নেন। অনেকে উত্তরার অলি ও গলিতে দাঁড়িয়ে মোনাজাতে শামিল হন। আবার অনেকে পুরনো খবরের কাগজ, পাটি, সিমেন্টের বস্তা ও পলিথিন বিছিয়ে বসে পড়েন। পাশ্ববর্তী কয়েক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বাসাবাড়ি, কল-কারখানা, অফিস, দোকান ও যানবাহনের ছাদ এবং তুরাগ নদে নৌকায় অবস্থান নেন মুসল্লিরা। আখেরি মোনাজাতে অংশ নিতে টঙ্গীর পথে শনিবার মধ্যরাত থেকেই ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে মোটর গাড়ি চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ফলে মোনাজাতে অংশ নিতে চারদিক থেকে লাখ লাখ মুসল্লি পায়ে হেঁটেই ইজতেমাস্থলে পৌঁছেন। যে দিকেই চোখ যায় সেদিকেই দেখা যায় শুধু টুপি-পাঞ্জাবি পরা মানুষ আর মানুষ। সবাই অপেক্ষায় ছিলেন কখন শুরু হবে সেই কাঙ্ক্ষিত আখেরি মোনাজাত। ইজতেমাস্থলের চারপাশের ৩ থেকে ৪ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে কোথাও তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না। আখেরি মোনাজাতের জন্য গতকাল আশপাশ এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কল-কারখানাসহ বিভিন্ন অফিস-আদালতে ছিল ছুটি। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে ছুটি ঘোষণা না করলেও কর্মকর্তাদের মোনাজাতে অংশ নিতে বাধা ছিল না। নানা বয়সী ও পেশার মানুষ এমনকি মহিলারাও ভিড় ঠেলে মোনাজাতে অংশ নিতে গতকাল সকালেই টঙ্গী এলাকায় পৌঁছেন। ইজতেমার তিন দিনের বয়ান শুনতে মুসল্লিদের বেশির ভাগ প্রথম দিনই তুরাগতীরে সমবেত হন। যারা নিয়মিত বয়ান শুনতে পারেননি, তাদের মধ্যে অনেকে আখেরি মোনাজাতে অংশ নিতে নিয়ত করেন।

হিদায়তী বয়ান : প্রথম পর্বের ইজতেমার তৃতীয় দিনে হিদায়তী বয়ানে ভারতের মাওলানা মোহাম্মদ সা’দ বলেন, ইসলামে নামাজের স্থান মানুষের দেহের মাথার মতো। নামাজ হলো আল্লাহর হুকুম। আল্লাহর হুকুম পুরা হলে তার ওয়াদা পূরণ হয়ে যায়। যার দিলে আল্লাহর এক্কিন পয়দা হবে, সে আল্লাহর হুকুমকে অগ্রাধিকার দেবে। নামাজের ফজিলত বান্দা তখনই পাবে, যখন কেউ রসুল (সাঃ)-এর মতো করে নামাজ পড়ে। ভালো মউত তাদেরই হবে, যারা আল্লাহর হুকুম ও রসুল (সা.)-এর হুকুমমতো চলে। দীনের ঘরে বসে ইবাদতের চেয়ে বাইরে মেহনত করে ইবাদত বন্দিগী করা অনেক ফজিলত। আল্লাহ তাঁর বান্দাদের দীনের কাজে রাস্তায় বের হতে হুকুম দিয়েছেন। সবাইকে দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছে দেওয়ার কথা বলেছেন। আর এ দাওয়াতের জন্য তালিম নিতে হবে। মহল্লায় মহল্লায় মসজিদে বসে দীনের দাওয়াত নিয়ে পরামর্শ করতে হবে। এতে শক্রও বন্ধু হয়ে যেতে পারে। যিনি এখলাছের সঙ্গে দীনের কাজ করবেন তিনিই কামিয়াব হবেন। আল্লাহকে খুশি করার জন্য কাজ করলে জীবনে সফলতা আসে। সবচেয়ে বড় আমল হলো দীনের কাজে আল্লাহর রাস্তায় বের হওয়া। দুনিয়ার মাল সম্পদ আল্লাহর কাছে মূল্যহীন। দুনিয়া দুনিয়ার জায়গায় থাকবে। আখিরাতে দুনিয়ার কোনো সম্পদ কাজে লাগবে না। শুধু দীন ও আমলই কাজে লাগবে। আল্লাহ সব সময় ডাকছেন বান্দারা তার কাছে কিছু চাক। আল্লাহ বান্দাদের দেওয়ার জন্য সব সময় তাকে ডাকার অপেক্ষায় থাকেন। কখন বান্দা তার কাছে চাইবেন। যেমনটি ভিক্ষুক না পাওয়া পর্যন্ত চাইতেই থাকেন। বয়ানে আরও বলা হয়, দুনিয়ার চেয়ে আখেরাতের প্রতি আমাদের বেশি করে খেয়াল রাখতে হবে। দুনিয়ার জিন্দিগির চেয়ে আখিরাতের জিন্দিগি হচ্ছে দীর্ঘস্থায়ী। আমাদের ওপর বৃষ্টির ফোঁটার মতো পেরেশানি ধেয়ে আসছে। এ পেরেশানি থেকে রক্ষার জন্য আমাদের ইমানি শক্তিকে আরও মজবুত করতে হবে। ধাবিত হতে হবে আখিরাতের দীর্ঘ জিন্দিগির দিকে। আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করে নিজের কৃতকর্মের অনুসূচনার মাধ্যমে তার কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। চোখের পানি ফেলে মোনাজাত করতে হবে। মোনাজাত কবুল হলেই আমরা পাপমুক্ত হব। দুনিয়া ও আখিরাতে ফিরে আসবে শান্তি।

বিদেশি মেহমান : এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা, উত্তর আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়াসহ অন্তত ৯০টি দেশের তাবলিগ জামাতের প্রায় ২০ হাজার বিদেশি মেহমান এবারের ইজতেমায় অংশগ্রহণ করেছেন। এদের মধ্যে পাশ্ববর্তী দেশসমূহের সর্বোচ্চসংখ্যক বিদেশি মেহমান আগমন করেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের তাবলিগের কাজে বের হওয়ার জন্য এবার ইজতেমা স্থলে প্রথম পর্বে প্রায় ১০ হাজার জামাত তৈরি হয়েছে বলে ইজতেমার আয়োজক সূত্রে জানা গেছে। আগামী ১৫-২০ দিনের মধ্যে এসব জামাত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়বে বলে জানিয়েছে তাবলিগ সূত্র।

টেলিভিশন-মুঠোফোন ও ওয়্যারলেস সেটে মোনাজাত : ইজতেমা মাঠে না এসেও মোনাজাতের সময় হাত তুলেছেন অসংখ্য মানুষ। টঙ্গীর ইজতেমাস্থল থেকে প্রায় ১৫ কি.মি দূরে কনফারেন্সের মাধ্যমে গাজীপুরের চান্দনা চৌরাস্তায় মসজিদের মাইকে আখেরি মোনাজাত সম্প্রচার করা হয়। এখানে অর্ধ লক্ষাধিক নারী-পুরুষ ঈদগাহ মাঠে এবং পাশ্ববর্তী সড়ক ও ভবনগুলোতে জড়ো হয়ে মোনাজাতে অংশ নেন। এ ছাড়াও গাজীপুর জেলার বিভিন্ন এলাকায় টেলিভিশন, ওয়্যালেস সেট ও মুঠোফোনের মাধ্যমে মোনাজাত প্রচার করা হয়। এসব স্থানেও পুরুষের পাশাপাশি নারীদের ব্যাপক উপস্থিতি ছিল। আবার টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে সরাসরি সম্প্রচার করার কারণে অনেকে বাসায় বসে মোনাজাতে অংশ নিয়েছে। আবার দেশ বিদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে অনেকে ইজতেমাস্থলে অবস্থানকারীর সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ করেও মোনাজাতে শরিক হয়েছেন।

সর্বশেষ খবর