বৃহস্পতিবার, ২৮ জানুয়ারি, ২০১৬ ০০:০০ টা

টাকা লোপাট, ঋণ জালিয়াতিতে ব্যাংক পরিচালকরা

আলী রিয়াজ

টাকা লোপাট, ঋণ জালিয়াতিতে ব্যাংক পরিচালকরা

ব্যাংক পরিচালকরা একে অন্যের সঙ্গে যোগসাজশ করে সব নীতিমালাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বড় অঙ্কের ঋণ বাগিয়ে নিচ্ছেন। বিনিয়োগের জন্য ঋণগ্রহীতারা দিনের পর দিন ব্যাংকে ঘুরে ঋণ পান না। নানা ধরনের কাগজ, তথ্য দেওয়ার পরেও ঘুরতে হয় দুয়ারে দুয়ারে। কিন্তু ব্যাংকের পরিচালকদের আত্মীয়স্বজনদের নামে আবেদন করার সঙ্গে সঙ্গে ঋণ অনুমোদন হয়ে যায়। পরিচালকদের নিজেদের নামের পরিবর্তে স্ত্রী, পুত্র, ভাই বা কোনো আত্মীয়স্বজনের নামে এসব ঋণ নিয়ে লোপাট করছেন হাজার হাজার কোটি টাকা। সাম্প্রতিক সময়ে চট্টগ্রামকেন্দ্রিক কয়েকটি বড় শিল্প গ্রুপের বিরুদ্ধে নিজেদের আত্মীয়স্বজনের নামে ঋণ নেওয়ার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত কয়েক বছরে ভুয়া এলসি, প্রকল্প দেখিয়ে কয়েকশ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে বিদেশে পালিয়ে গেছেন বেশ কজন ঋণগ্রহীতা। পরে বাংলাদেশ ব্যাংক চাপ দিলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক ওই ব্যবসায়ীদের আর খুঁজে পায় না। পরিচালকদের অনিয়ম আর দুর্নীতির আগ্রাসন ঠেকাতে না পারলে এ খাতে বিপর্যয় নেমে আসতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। পরিচালকরা বোর্ডে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করে ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামেও ঋণ অনুমোদন করছেন। নিজের ব্যাংকে সম্ভব না হলে যোগসাজশ করে অন্য ব্যাংকের মাধ্যমে ঋণ নিয়ে বছরের পর বছর আর ঋণ শোধ করছেন না। যে ব্যক্তির নামে ঋণ নিচ্ছেন কয়েক দিন পর তার আর হদিস পাওয়া যায় না। এমনকি যেসব মর্টগেজ, কাগজপত্র জমা দেওয়া হয় তা-ও ভুয়া। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, সর্বশেষ ২০১৫ সালে ব্যাংকিং খাতে নিজ ব্যাংক থেকে পরিচালকদের নেওয়া ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা। আগের বছর ২০১৪ সালে যা ছিল সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা। মাত্র এক বছরের ব্যবধানে নিজ ব্যাংক থেকে পরিচালকরা অস্বাভাবিকহারে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, পরিচালকরা নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে কোটি কোটি টাকা বিভিন্ন নামে ঋণ নিয়েছেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শনে দেখা গেছে, এক ব্যাংকের পরিচালক অন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন। গত এক বছরে যার পরিমাণ ২০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। জামানত ছাড়া অথবা কোনো কোনো ক্ষেত্রে অতি সামান্য জামানতে চট্টগ্রামের শতাধিক ব্যবসায়ীকে ঋণ দিয়েছে ব্যাংক। ঋণ মঞ্জুরিতে কোনো কোনো ক্ষেত্রে অনিয়মেরও আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। এক ডজনেরও বেশি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তারা আর ফেরত দিচ্ছেন না। এদের মধ্যে মোস্তফা গ্রুপ, এইচআর গ্রুপ, ইলিয়াস অ্যান্ড ব্রাদার্স, ইমাম গ্রুপ, নূরজাহান গ্রুপ, টিকে গ্রুপ, জেসমিন গ্রুপসহ শতাধিক গ্রুপ ও প্রতিষ্ঠান ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ নিলেও ফেরত দিচ্ছে না। এসব গ্রুপের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন একাধিক ব্যাংকের পরিচালক। এসব অনিয়মের সঙ্গে সরাসরি জড়িত যমুনা ব্যাংকের চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ শাখা, প্রিমিয়ার, এনসিসি ব্যাংকসহ একাধিক বেসরকারি ব্যাংক। গত বছর চট্টগ্রামভিত্তিক এইচআর গ্রুপের আর্থিক অনিয়মের বিষয়ে ১৮টি ব্যাংকের ২০টি শাখায় বিশেষ পরিদর্শন চালায় বাংলাদেশ ব্যাংক। পরিদর্শনে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকার ঋণ অনিয়ম পায়। ইতিমধ্যে গ্রাহক এসব ঋণ খেলাপি হিসেবে প্রদর্শনে উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা নেওয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক শুধু ঝুঁকির বিপরীতে সঞ্চিতি সংরক্ষণের নির্দেশনা দিয়েছে। সম্প্রতি একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক থেকে ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকা অন্য একাধিক ব্যাংকের পরিচালকের শিল্পপ্রতিষ্ঠানের নামে-বেনামে ঋণ দেওয়া হয়েছে। কোনো ধরনের নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ব্যাংকের চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ ও লালদীঘি শাখায় জালিয়াতির ঘটনায় স্থানীয় একজন ব্যাংক পরিচালকের যোগসূত্র রয়েছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তে বেরিয়ে এসেছে। ওই দুই শাখায় প্রায় ৫০০ কোটি টাকার ঋণ জালিয়াতি হয়েছে। একই ব্যাংকের স্থানীয় কার্যালয়ে ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকার ঋণ জালিয়াতিতেও পরিচালকদের হাত রয়েছে বলে প্রমাণ পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক; যা অন্য ব্যাংকের পরিচালকের বেনামি প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের বিশেষায়িত একটি ব্যাংকের খোদ চেয়ারম্যানের যোগসাজশে ওই ব্যাংক এবং অন্য ব্যাংকের পরিচালকদের প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছে বেআইনিভাবে। শুধু তাই নয়, গত পাঁচ থেকে সাত বছরে ওই ব্যাংকে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ অনিয়ম হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, শুধু রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক থেকে নয়, বেসরকারি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচালকরাও জড়িয়ে পড়ছেন একের পর এক অনিয়মে। এমন কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংকে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার অনিয়ম করেছেন খোদ পরিচালকরাই। যারা নিজেদের নাম ব্যবহার না করলেও আত্মীয়স্বজনকে দিয়ে ঋণ আবেদন করান। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের কাগজপত্র তৈরি করে সেসব ব্যক্তির নামে ঋণ অনুমোদন করাতে বোর্ড সভায় ভূমিকা রাখছেন। গত ডিসেম্বরে একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান প্রায় ৬০০ কোটি টাকা জালিয়াতি করে ঋণ নিয়েছেন। পরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শনে ধরা পড়লে তাকে বোর্ড থেকে অপসারণ এবং পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেওয়া ওই প্রতিষ্ঠানে। নতুন প্রজন্মের একটি ব্যাংকে কয়েকশ কোটি টাকার ঋণ অনিয়ম পাওয়ার পর কেন্দ্রীয় ব্যাংক পর্যবেক্ষক নিয়োগ দিয়েছে গত সপ্তাহে। শিল্প বিনিয়োগের বিপরীতে ঋণ অনিয়মের সঙ্গে এলসি জালিয়াতি করা হয়েছে একই পদ্ধতিতে। পণ্য আমদানির এলসি খোলার পর শুরু হয় বেচাকেনা, বন্দর থেকে খালাস হওয়ার পর পর্যন্ত তা চলে। এর মধ্যে আমদানি পণ্য প্রায় এক ডজনবার হাতবদল হয়। প্রতিটি ক্ষেত্রেই ব্যাংক জড়িত। গত কয়েক বছরে একাধিক ব্যবসায়ী ঋণ নিয়ে দেশের বাইরে পালিয়ে গেছেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তে এসব জালিয়াতির প্রমাণ পাওয়ার পর শুধু প্রভিশন রাখার নির্দেশ দিয়ে আর কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি। ব্যাংকগুলো নিজেদের মুনাফা থেকে প্রভিশন রেখে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের টাকা লুটপাট করেছে। তবে পরিচালকদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি। জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, আদালতের নিষেধাজ্ঞা নিয়ে অনেকেই ঋণের অর্থ ফেরত দেয়নি। তবে ব্যাংকগুলোকে প্রভিশন রাখতে বাধ্য করা হয়েছে। জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ব্যাংক পরিচালকদের ঋণের ব্যাপারে আগেও অনেক অভিযোগ আসত। বর্তমানে হয়তো তা আরও বেড়েছে। রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করে শুধু রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতেই জালিয়াতি হচ্ছে না, বেসরকারি ব্যাংকের ক্ষেত্রেও রাজনৈতিক প্রভাব আছে। বিভিন্নভাবে তারা প্রভাব বিস্তার করে আত্মীয়স্বজনদের নামে ঋণ নিচ্ছেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকি বাড়ানোর বিকল্প নেই। যেসব ব্যাংকের পর্ষদ বা পরিচালকের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। তাহলে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে না।

সর্বশেষ খবর