শনিবার, ৩০ জানুয়ারি, ২০১৬ ০০:০০ টা

ফ্লাইওভার বিড়ম্বনা

মানিক মুনতাসির

ফ্লাইওভার বিড়ম্বনা

ধীরগতিতে চলছে মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারের নির্মাণ কাজ —বাংলাদেশ প্রতিদিন

ভুল নকশায় তৈরি হচ্ছে মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভার। নকশায় ভুল থাকায় ডান হাতি গাড়ির জন্য নির্মাণ হচ্ছে বাম হাতি স্টিয়ারিংয়ের এই ফ্লাইওভার। যুক্তরাষ্ট্রের একটি কোম্পানির করা নকশা অনুযায়ী ফ্লাইওভারটির কাজ হচ্ছে। সে দেশের গাড়িগুলো বাম হাতি স্টিয়ারিং হওয়ায় সব রাস্তাই বাম হাতি লেনে বানানো। কিন্তু বাংলাদেশে সব ধরনের মোটরযান ডান হাতে চালিত। সে দেশের রাস্তার আদলে করা নকশায় ফ্লাইওভার করায় বিপত্তি ঘটেছে। এই বিপত্তি ধরাও পড়েছে অনেক বিলম্বে। এখন এ ভুল সংশোধনের কোনো সুযোগ নেই বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। এই ভুল শুধরাতে হলে ফ্লাইওভারের ৬০টি পিলার ভাঙতে হবে। যা অসম্ভব। তবে সেতু বিভাগ বলছে, ১০ থেকে ১২টি পিলার ভাঙতে হবে। ৬০টির তথ্য সঠিক নয় বলে সেতু বিভাগের দাবি। ফলে ভুল নকশাতেই তৈরি হচ্ছে ফ্লাইওভার। তবে আংশিক সংশোধিত প্রকল্পে ফ্লাইওভারের কয়েকটি লুপের দৈর্ঘ্য বাড়ানো হয়েছে। এদিকে, কাজের ধীরগতির কারণে দফায় দফায় এ প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় ও ব্যয় বাড়ানো হয়েছে। সর্বশেষ সংশোধন অনুযায়ী ১ হাজার ২১৮ কোটি ৮৯ লাখ টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। আর মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে ২০১৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। প্রথমদিকে ডিপিপি অনুমোদনের সময় এর ব্যয় ধরা হয়েছিল ৪৪৬ কোটি টাকা। পরবর্তীতে বেড়ে দাঁড়ায় ৭৭২ কোটি টাকায়। আর তৃতীয়বার সংশোধনী এনে ধরা হয়েছে ১ হাজার ২১৮ কোটি টাকা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যত টাকাই ব্যয় হোক না কেন। সেই স্থাপনা দেশ ও জনগণের কাজে আসতে হবে। কিন্তু মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভার যানজট নিরসনে কতটা ভূমিকা রাখবে তা নিয়ে অনেক প্রশ্নের জবাব নেই সংশ্লিষ্টদের কাছে। সেই সঙ্গে নকশা ত্রুটির কারণে সম্ভাব্য দুর্ঘটনার ঝুঁকি তো থাকছেই। জানা গেছে, মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারের নকশা করা হয়েছে বাম হাতে চালিত গাড়ির কথা মাথায় রেখে। নির্মাণ করা হচ্ছে সে আদলেই। এ জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন পয়েন্টে রাখা হয়নি ডানে মোড় নেওয়ার র‌্যাম্প। ফলে ত্রুটিপূর্ণ এ ফ্লাইওভার ব্যবহারে নানা জটিলতা সৃষ্টি হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এদিকে, নকশায় ত্রুটি সংশোধনের যুক্তিতে বাড়ানো হয়েছে মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারের নির্মাণ ব্যয়। তবে বাম হাতে চালিত মোটরযানের বিষয়টি আর সংশোধন করা হয়নি। মূল নকশা অপরিবর্তিত রেখে ভূগর্ভস্থ পরিসেবা সংযোগ লাইনের কারণে শুধু ভিত্তি নকশায় পরিবর্তন আনা হয়েছে। পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফ্লাইওভারে ওঠার রাস্তা বেশি ঢালু হয়, যাতে স্বাভাবিক গতিতে গাড়ি চালিয়েই ওঠা যায়। আর নামার রাস্তাটি হয় তুলনামূলক খাড়া। ফলে গতি কমিয়ে দ্রুত নামা যায়। এতে ফ্লাইওভারে ওঠার র‌্যাম্পটির দৈর্ঘ্য বেশি ও নামার র‌্যাম্পের দৈর্ঘ্য কম থাকে। কিন্তু মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারের নকশা এর বিপরীত।

সরেজমিন দেখা যায়, সাতরাস্তা, মগবাজার, মালিবাগ, রাজারবাগ পুলিশ লাইন, শান্তিনগরসহ প্রতিটি এলাকায় ওঠার র‌্যাম্প অনেক বেশি খাড়া। এ জন্য এগুলোর দৈর্ঘ্যও রয়েছে কম। আর নামার র‌্যাম্পগুলো তুলনামূলক বেশি ঢালু। ফলে এগুলোর দৈর্ঘ্যও বেশি রাখা হয়েছে। আর বাম হাতে চালিত যানের জন্য নির্মাণাধীন এ ফ্লাইওভার ডান হাতে চালিত যানের জন্য ব্যবহার করতে হবে বাধ্য হয়েই। এ বিষয়ে মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভার প্রকল্পের পরিচালক নাজমুল আলম বলেন, নকশায় কিছু ত্রুটি ছিল যা সংশোধন করা হয়েছে। তবে বাম হাতি আর ডান হাতি র‌্যাম্প বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি বলেন, ফ্লাইওভারের নকশা প্রণয়নে যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষজ্ঞদের সহায়তা নেওয়া হয়। আর নকশা সংশোধনে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) বিশেষজ্ঞদের সহায়তা নেওয়া হয়েছে। আর কোনো ত্রুটি আছে কিনা-সেটা টেকনিক্যাল কমিটি ভালো বলতে পারবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রে মোটরযানের সম্পূর্ণটাই বাম হাতে চালিত। সে দেশের বিশেষজ্ঞদের সহায়তা নেওয়ায় মূলত নকশায় ত্রুটি দেখা দিয়েছে। আর স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর (এলজিইডি) গ্রামেগঞ্জে সড়ক নির্মাণ করে। শহরে ফ্লাইওভার নির্মাণের কোনো ধরনের অভিজ্ঞতাই তাদের নেই। ফলে নকশা প্রণয়নের সময় সংশ্লিষ্টরা ত্রুটি চিহ্নিত করতে পারেননি। সূত্র জানায়, মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারে শান্তিনগর ছাড়া অন্য কোনো স্থানে ডানে মোড় নেয়ার সুযোগ নেই। কারণ তিন তলাবিশিষ্ট ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হলেও মগবাজার, বিশ্বরোড ইন্টারসেকশন ও টঙ্গী ডাইভারশন রোডে ওঠার  কোনো র‌্যাম্প রাখা হয়নি। এতে ফ্লাইওভারে যানবাহনের সংখ্যা কমে যাবে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা। জানা গেছে, ৮ দশমিক ২৫ কিলোমিটার দীর্ঘ ফ্লাইওভারটির নির্মাণ ব্যয় ধরা হয় ৪৪৬ কোটি টাকা। এখন তা বাড়িয়ে ১ হাজার ২১৮ কোটি ৮৯ লাখ টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে। অর্থাত্ ব্যয় বাড়ছে ৪৪৬ কোটি ১৯ লাখ টাকা। এরমধ্যে ফাউন্ডেশনের নকশা পরিবর্তনে ৯২ কোটি ১৯ লাখ, পট বেয়ারিং অ্যান্ড শক ট্রান্সমিশনে ৪৬ কোটি ৭৮ লাখ, র‌্যাম্প সম্প্রসারণে ৮৪ কোটি ৮৩ লাখ ও নির্মাণসামগ্রীর দাম বৃদ্ধির কারণে ২৩১ কোটি ২৬ লাখ টাকা ব্যয় বাড়ানো হয়েছে। এ বিষয়ে বুয়েটের পুর কৌশল বিভাগের অধ্যাপক শামসুল হক বলেন, এই ফ্লাইওভারের নকশা করার ক্ষেত্রে ইউরোপ আমেরিকার মতো বাঁ-দিকে স্টিয়ারিংয়ে চালিত গাড়ির কথা মাথায় রাখায় ওঠা-নামার লুপ তৈরি করা হচ্ছে। এতে বাংলাদেশের প্রচলিত সড়কে ও গাড়ির সঙ্গে বৈপরীত্য দেখা দিয়েছে। এতে দুর্ঘটনার প্রবল ঝুঁকি থাকছে। বাংলাদেশে অনেক ফিটনেসবিহীন ও ওভারলোডেড বাস-ট্রাক ও অন্যান্য যানবাহন রাস্তায় চলছে। মালবাহী গাড়িগুলো খাড়া লুপ দিয়ে উঠার ক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় পড়ার ঝুঁকি থাকবে। কুড়িল ফ্লাইওভার ও বনানী-জিয়া কলোনি ফ্লাইওভারের নকশাকার শামসুল হক বলেন, সাধারণত সিগনাল ও যানজটের ঝামেলা এড়িয়ে ডানদিকের রাস্তায় যাওয়ার সুবিধা করতেই ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হয়। মহাখালী ও খিলগাঁও ফ্লাইওভার এর উদাহরণ। কিন্তু মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যস্ত এলাকায় ডানে যাওয়া বা রাইট টার্নের ব্যবস্থা রাখা হয়নি। রাইট টার্ন না থাকলে শত শত কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এই স্থাপনা ব্যবহার করা আর ভূমির উপরে তৈরি রাস্তার মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকবে না। উল্টো ফ্লাইওভারের কলামগুলোর কারণে রাস্তার জায়গা নষ্ট হবে বলে তিনি মনে করেন। নকশায় ত্রুটির বিষয়গুলো কিভাবে ধরা পড়েছে জানতে চাইলে শামসুল হক বলেন, নির্মাণ কাজের মাঝামাঝি সময়ে এলজিইডির লোকজন আমাদের কাছে এসেছিলেন ভিন্ন একটি সমস্যা নিয়ে। ফ্লাইওভারের ডেক (মেঝে) স্থাপনে হিসাবের গরমিল নিয়ে তারা এসেছিলেন। আমরা তার সমাধান করতে পেরেছি। নকশার বিভিন্ন ত্রুটি নিয়ে যে অভিযোগ আসছিল তারও সত্যতা পাওয়া যায় তখনই। কিন্তু ততদিন প্রকল্পের কাজ অনেক দূর এগিয়ে গেছে। যা সংশোধন করা অসম্ভব।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর