শনিবার, ৩০ জানুয়ারি, ২০১৬ ০০:০০ টা

মূল ইস্যুতে নেই বিএনপি

* সবাই ব্যস্ত ইতিহাস চর্চায় * গণতন্ত্র ও নির্বাচন নিয়ে কর্মসূচি নেই * তৃণমূলে মামলাগ্রস্ত নেতা-কর্মীদের পাশে নেই কেউ * সরকারের অনিয়ম দুর্নীতির বিরুদ্ধে নেই জোরালো ভূমিকা

মাহমুদ আজহার

মূল ইস্যুতে নেই বিএনপি

মূল ইস্যুতে নেই বিএনপি। নেতারা ব্যস্ত এখন ইতিহাসচর্চা নিয়ে। নতুন নির্বাচনের দাবিতে দুই বছর বিএনপি যে আন্দোলন করেছিল, সে দাবিতে নেই জোরালো অবস্থান। নেতাদের মুখে মুখে এখন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসচর্চা। সামনে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন। এ নিয়েও কেন্দ্রে সে অর্থে কোনো প্রস্তুতি নেই। তৃণমূলের হামলা-মামলাসহ নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত নেতা-কর্মীদের পাশে দাঁড়ানোর নেই কেউ। অভিযোগ রয়েছে, আন্দোলনের সময় গুম-খুন হওয়া নেতা-কর্মীর পরিবারের খোঁজও নেওয়া হয় না কেন্দ্রীয়ভাবে।

সরকারের বিরুদ্ধে ‘দুর্নীতি’ বা ‘অনিয়ম’ নিয়েও কথা বলতে চান না সিনিয়র নেতারা। এ নিয়ে সর্বশেষ স্থায়ী কমিটির বৈঠকে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া কথা বলেন। নেতাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, সরকারের সব ‘অপকর্ম’ তুলে ধরতে হবে। এ নিয়ে সবাইকে কথা বলতে হবে। এদিকে, নেতাদের বড় একটি অংশই এখনো সরকার বা আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে ‘আঁতাত’ করেই চলাফেরা করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, দল গোছানোর পাশাপাশি আসন্ন ইউপি নির্বাচন নিয়ে বিএনপিকে মনোযোগী হওয়া উচিত। সরকার যদি অন্যায়ভাবে ভোট কেন্দ্র দখল করে, তারও তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কেন্দ্রের সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। মাঠপর‌্যায়ের নেতা-কর্মীদের দুঃখ-দুর্দশা ঘোচাতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে। গুম-খুন, গ্রেফতার বা পঙ্গুত্ববরণকারী নেতা-কর্মীদের আর্থিক সহযোগিতার হাত বাড়াতে হবে। জোরালো সমালোচনা করতে হবে সরকারের ভুল নীতির। যেমন— বিশ্বজুড়ে তেলের দাম কমলেও বাংলাদেশে এর দাম কমেনি। বিষয়টি নিয়ে বিএনপিকে প্রতিবাদ করতে হবে। আগামী নির্বাচন, গণতন্ত্র ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা; ঘুষ, দুর্নীতি, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি; দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিসহ গণদাবিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করা উচিত বলেও মনে করেন পর্যবেক্ষকরা। এ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘এখন আমরা কাউন্সিল ও দল গোছানোর চিন্তাই করছি। তবে আমরা মূল দাবি থেকে সরে আসিনি। দেশের মানুষের ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনাই আমাদের মূল লক্ষ্য। জনগণের প্রতিনিধিত্বশীল একটি সরকার গঠনের দাবি নিয়ে মাঠে আছি। পৌর নির্বাচনে অংশগ্রহণ কিংবা আসন্ন ইউপি নির্বাচনে যাওয়া— আন্দোলনেরই একটি অংশ। তবে রাতারাতি সব কিছু পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। জনগণকে সঙ্গে নিয়েই আমাদের শান্তিপূর্ণ সব কর্মসূচি থাকবে। সরকারের সব অগণতান্ত্রিক আচরণের জবাব দেওয়া হবে।’ বিএনপির কেন্দ্রীয় কার‌্যালয় সূত্রমতে, সারা দেশ থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী ৪ লাখ ৩ হাজার ৮৭৮ জন নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে প্রায় ২২ হাজার মামলা রয়েছে। গ্রেফতার হয়েছেন ১৭ হাজার ৮৮৫ জন। অবশ্য এর মধ্যে বেশ কিছু নেতা-কর্মী জামিনে মুক্ত হয়েছেন। এ ছাড়া বর্তমান সরকারের দুই মেয়াদে বিএনপির ৪৪০ জন নেতা-কর্মীকে হত্যা করা হয়েছে। আন্দোলনকে ঘিরে ২৬৭ জন নেতা-কর্মী গুম ও ৩৩৭ জন পঙ্গুত্ববরণ করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ মনে করেন, বিএনপির এখন মূল কাজ হওয়া উচিত দলের কাউন্সিল ও দল পুনর্গঠন করা। সরকারের সব ভ্রান্ত নীতির প্রতিবাদ করা। যেমন বিশ্বজুড়ে তেলের দাম কমছে, বাংলাদেশে বাড়ছে। এর বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিবাদ গড়ে তুলতে পারেনি বিএনপি। মুক্তিযুদ্ধে ছোটখাটো কিছু ভুলত্রুটি থাকতে পারে। কিন্তু এটা জাতির শ্রেষ্ঠ অর্জন। এটা নিয়ে কথা বলার সময় এখন নয়। ড. এমাজউদ্দীন আহমদের ভাষায়, কোনো জাতির সঠিক ইতিহাস রচনা করতে ৭৫ বছর সময় প্রয়োজন। বাংলাদেশ এখনো সে স্থানে যায়নি। এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধে এক দুই ভাগ ছাড়া পুরো জাতিই এর পক্ষে ছিল। বিরোধীদের চিহ্নিত করলেই তো আর সমস্যা থাকে না। আপাতত এসব বিষয়ের প্রতি মনোযোগ না দিয়ে বিএনপিকে দলের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে দৃষ্টি দেওয়া উচিত। এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এস এম এ ফায়েজ বলেন, ‘মহান মুক্তিযুদ্ধ একটি স্পর্শকাতর বিষয়। জাতির অস্তিত্বের প্রশ্ন। এ নিয়ে বিএনপি নেতাদের ভেবেচিন্তে কথা বলা উচিত। এ বিষয়ে হালকাভাবে কথা বলা ঠিক নয়। আমার মনে হয়, গত দুই বছরে বিএনপি যে সমস্যায় পড়ে ছিল, এখন তার কোনটা রেখে কোনটায় যাবে— তার দিশা খুঁজে পাচ্ছে না। তবে এ মুহূর্তে বিএনপির আন্দোলনে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। সংগঠন গোছানো জরুরি। পরবর্তীতে বিএনপি যা-ই করুক, তা করতে হবে কনস্ট্রাকটিভভাবে গণতান্ত্রিক উপায়ে। তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক আরও গভীর করা উচিত।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুলের মতে, ‘সরকারের জুলুম-অত্যাচারের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ গড়ে তোলাই এ মুহূর্তে বিএনপির জন্য জরুরি। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিএনপির বক্তব্য দেওয়া নিষ্প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। তবে জিয়াউর রহমানকে কেউ খাটো করে বক্তব্য দিলে তার প্রতিবাদ দল থেকে করতে পারে। জিয়ার অবদানকেও হাইলাইটস করতে পারে। কিন্তু স্বাধীনতাযুদ্ধ নিয়ে বিতর্কিত বক্তব্য তরুণ প্রজন্ম ভালোভাবে নেবে না। মনে রাখতে হবে, মুক্তিযুদ্ধ শুধু ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে শুরু হয়নি। এটা শুরু হয়েছে ১৯৪৮ সাল থেকে। এর নায়ক ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এ নিয়ে যদি কেউ বিতর্কিত কথা বলেন, হয় তার জ্ঞানের অভাব, নতুবা নিজেকে জাহির করতেই এ ধরনের বক্তব্য দিচ্ছেন।’

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর