রবিবার, ৬ মার্চ, ২০১৬ ০০:০০ টা

কেরানীগঞ্জে তুমুল লড়াই করি

মোস্তফা মহসীন মন্টু

কেরানীগঞ্জে তুমুল লড়াই করি

দীর্ঘ নয় মাস কারাভোগের পর একাত্তরের ১ মার্চ আমরা জেল ভেঙে বের হই। তখন আমার বয়স ২৫। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগে এমএ দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। মাতৃভূমিকে ঔপনিবেশিক শাসনমুক্ত করার জন্য বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামে যুক্ত হয়েছিলাম। ১৯৭০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের একটি মিছিলে আমিও ছিলাম। ওই মিছিলে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী বাধা দিলে তাদের সঙ্গে আমাদের সংঘর্ষ বেধে যায়। এতে এক ক্যাপ্টেন নিহত হন। এ ঘটনায় সামরিক সরকার মামলা করল। আমাকে ও ছাত্রনেতা কামরুল আলম খান খসরু এবং আমার ভাই সেলিম জাহানসহ ৪০০ জনকে আসামি করে মামলা দেওয়া হয়। জুন মাসে ইকবাল হল থেকে আমি গ্রেফতার হই। ১৯৭০-এর জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানে ১৬৯ আসনের মধ্যে ১৬৭টিতে জয়ী হয় আওয়ামী লীগ। বাঙালির এ বিজয় পাকিস্তানিরা মেনে নিতে পারে না। তারা ষড়যন্ত্র করতে থাকে। ’৭১-এর ১ মার্চ ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেন। এর প্রতিবাদে সারা বাংলার মানুষ গর্জে উঠেছিল। আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে। ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন। বলে দিয়েছিলেন যুদ্ধের সময় কী করতে হবে। এ ভাষণে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধযুদ্ধের বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। পরিস্থিতি সামাল দিতে জেনারেল ইয়াহিয়া খান আলোচনার নামে কালক্ষেপণ করতে থাকেন। ২৩ মার্চ আমরা ঢাকায় বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করলাম। শেখ ফজলুল হক মণি, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, কামরুল আলম খান খসরু, আমি এবং ছাত্রলীগের কয়েকজনকে বঙ্গবন্ধু ডেকে বললেন, পরিস্থিতি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের দিকে যাচ্ছে। ছয় দফা থেকে ধীরে ধীরে আন্দোলনকে এক দফার দিকে নিয়ে গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ৩ মার্চ থেকে আমরা অস্ত্র সংগ্রহ করছিলাম। ২৫ মার্চ রাত ৯টায় ধানমন্ডি-৩২ নম্বর বাড়িতে বঙ্গবন্ধুর কাছে ছিলাম। বঙ্গবন্ধু আমাদের বললেন, তোমরা নিরাপদ এলাকায় চলে যাও। আমরা তাকে আমাদের সঙ্গে যেতে বলি। আমাদের সঙ্গে চলুন। বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘আমাকে না পেলে আর্মি সবাইকে মেরে ফেলবে, তোমরা যাও।’ বঙ্গবন্ধুর বাড়ি থেকে বের হয়ে ইকবাল হলে আসি, সেখানে কিছু অস্ত্র ছিল, দুটি গাড়িতে সেগুলো তুলি। রাত ১১টায় এস এম হলের সামনে ট্যাংকসহ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী অবস্থান নেয়। জানতে পেরে আমি গাড়ি নিয়ে আজিমপুর, হাজারীবাগ হয়ে কামরাঙ্গীরচর পৌঁছাই। নৌকায় করে অস্ত্র কেরানীগঞ্জে নিয়ে যাই। রাত দেড়টায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঢাকায় গণহত্যা শুরু করে। আমরা ২৬ মার্চ কেরানীগঞ্জ থানা ঘেরাও করে অস্ত্র এবং গোলাবারুদ সংগ্রহ করি। থানায় কয়েকজন বাঙালি পুলিশ ছিল তাদের সঙ্গে নিয়ে আসি। ঢাকা থেকে শেখ ফজলুল হক মণি, তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী, আবদুল মালেক উকিল, আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, শাজাহান সিরাজ, আ স ম আবদুর রব, নূরে আলম সিদ্দিকী কেরানীগঞ্জে আসেন। পরে কেন্দ্রীয় নেতারা চলে গেলেন ফরিদপুর হয়ে মুজিবনগরে। মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে অস্থায়ী মুজিবনগর সরকারের তত্ত্বাবধানে। ২৬ মার্চ কেরানীগঞ্জে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করি। লাখ লাখ মানুষ ঢাকা থেকে কেরানীগঞ্জে আসতে থাকে। ওইদিন ভোরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কেরানীগঞ্জে হামলা চালায়। তারা ভোর থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত প্রায় সাড়ে চার লাখ বাঙালিকে হত্যা করে। কয়েক দিন পরে আমি মুজিবনগরে চলে যাই। ভবেরপাড়া আমবাগান ক্যাম্পের দায়িত্ব আমাকে দেওয়া হয়েছিল। সেখানে সারা দেশ থেকে ছাত্রলীগ নেতাদের সংঘবদ্ধ করি। খাবার সংগ্রহ করে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পাঠানোর ব্যবস্থা করি। পরে আমাকে কলকাতা শিলিগুড়ি নিয়ে যাওয়া হলো। দেরাদুনে দুই মাস ট্রেনিং নিয়ে কেরানীগঞ্জে ফিরে আসি। কেরানীগঞ্জে গড়ে তুললাম ১২টি ক্যাম্প। এখানে স্বাধীনতার পক্ষে নারী-পুরুষ এবং বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে মুক্তিযুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করি। আমি ও খসরু দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে কেরানীগঞ্জে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করি। দলে দলে বিভক্ত হয়ে পাকিস্তানিদের ওপর হামলা চালাই। আমি তখন বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স (বিএলএফ) যা ‘মুজিববাহিনী’ নামে পরিচিত তার ঢাকা জেলা কমান্ডার। কেরানীগঞ্জে হানাদার বাহিনীর সঙ্গে দুই রাত এক দিন সামনাসামনি যুদ্ধ হয় আমাদের। এতে ১২ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। পরে হেলিকপ্টার থেকে আমাদের ওপর গুলিবর্ষণ করে ওরা। এ সময় প্রায় ১৪০০ পাকিস্তানি সেনা আমাদের ওপর হামলা করে। আমরা সাভারে চলে গেলাম। কয়েক দিন পর জিঞ্জিরা থানা ঘেরাও করে অস্ত্র ও গোলাবারুদ সংগ্রহ করেছিলাম। লিফলেট বিলি করে ঢাকা থেকে বাঙালিদের অন্যত্র চলে যেতে বলি। ঢাকায় খাদ্য সরবরাহ বন্ধ করে দিই। যাত্রাবাড়ী, রাজউক, মতিঝিলসহ বিভিন্ন স্থানে হানাদার বাহিনীর ওপর হামলা চালিয়েছিলাম। খবর পেলাম, পাকিস্তানি সেনারা আত্মসমর্পণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। ১৬ ডিসেম্বর সকালে কেরানীগঞ্জ থেকে চকবাজারের মধ্য দিয়ে ঢাকায় পৌঁছাই। বিকাল ৪টা ৩১ মিনিটে পাকিস্তানি বাহিনী নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করে। বিজয়ের আনন্দে ভাসতে থাকে বাঙালি জাতি।

সর্বশেষ খবর