সোমবার, ৭ মার্চ, ২০১৬ ০০:০০ টা

একতরফা স্বাধীনতা ঘোষিত হয়নি কেন

অধ্যাপক ড. আবু সাইয়িদ

১. অনেক বিশ্লেষক অভিযোগ উত্থাপন করেন, ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত জনসভায় সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণা দিলে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী এত অধিকসংখ্যক বাঙালি হত্যা করার সুযোগ পেত না। ওই সভায় নির্দেশ দিলে জনগণ ক্যান্টনমেন্ট দখল করত। এ কথাগুলোতে যে মারাত্মক ভ্রান্তি রয়েছে, তা বিশ্লেষণে বোঝা যাবে। ১৯৭১-এর ৭ মার্চের পূর্বাপর কী ঘটনাবলি ঘটেছিল? পয়লা মার্চ পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের আহূত অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করলে, যে গণবিপ্লব দেখা দেয় সে প্রেক্ষিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ‘ভদ্র’ গভর্নর অ্যাডমিরাল আহসানকে সরিয়ে লে. জে. সাহেবজাদা ইয়াকুব  খানকে নতুন গভর্নর হিসেবে নিযুক্তি দেন। তিনি প্রেসিডেন্টকে ঢাকায় আসা ও অধিবেশনের নতুন তারিখ ঘোষণার অনুরোধ করেন। কিন্তু প্রেসিডেন্ট তা না করায় তিনি পদত্যাগ করেন এবং একটি সিগন্যাল বার্তা পাঠান। বার্তাটিতে বলা হয়, ‘এ সমস্যার কোনো সামরিক সমাধান নেই।... সামরিক সমাধান করতে হলে অজস্র নিরপরাধ সিভিলিয়ানকে মারতে হবে। আমি এটা মেনে নিতে পারি না। তাই আমি পদত্যাগ করছি।’ ২. ইয়াহিয়া খান বাধ্য হয়ে জেনারেল টিক্কা খানকে ৬ মার্চ তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর নিয়োগ দেন। ইয়াহিয়া খান ১০ মার্চ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের গোলটেবিল আহ্বান করেন। বঙ্গবন্ধু তা প্রত্যাখ্যান করেন। ৬ মার্চ গভীর রাতে ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধুকে টেলিফোনে অনুরোধ করেন, ‘আমি আশ্বাস দিতে পারি যে, জনগণের কাছে আপনার প্রদত্ত ওয়াদার চেয়ে আরও বেশিকিছু আপনি পেতে যাচ্ছেন।’ ৩. ৭ মার্চ পাকিস্তানে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ড সকালে বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বর বাড়িতে একান্ত বৈঠকে বলেন, ‘পূর্ববাংলায় স্বঘোষিত স্বাধীনতা যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন করবে না।’ সামরিক বাহিনীর পক্ষ থেকে সাহেবজাদা ইয়াকুব বলে পাঠান, ‘একতরফা স্বাধীনতা ঘোষিত হলে শাসন করার জন্য এবং শাসিত হওয়ার জন্য কেউ থাকবে না।’ রাইফেল, কামান, ট্যাঙ্ক, ভারী অস্ত্র নিয়ে রমনা পার্কে আগেই বেলুচ রেজিমেন্ট অবস্থান নিয়েছিল। লে. জে. কামাল মতিনউদ্দীন-এর ভাষ্যনুসারে, প্রকৃতপক্ষে জেনারেল টিক্কার হাতে ছিল পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আসা ইউনিফর্ম পরিহিত ১২ হাজার সৈন্য, ইনফ্যান্টি ডিভিশন ও আর্মার্ড রেজিমেন্ট। ৪. ৭ মার্চের পূর্ব পর্যন্ত বাঙালি সেনা-অফিসার শপথ ও শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে ‘বিদ্রোহ’ করার মানসিকতার অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে। তাদের মধ্যে স্বাধীনতার স্পৃহা ছিল কিন্তু সামরিক শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি ওসমানী বলেছেন, ‘২৫শে মার্চ তাঁদের উপর আক্রমণ হলেই কেবলমাত্র তারা বিদ্রোহ করেন।’ জেনেভা কনভেনশন অনুসারে ৭ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষিত হলে প্রথম আক্রমণকারী হিসাবে বাঙালিদের চিহ্নিত করে নিশ্চিহ্ন করলে বিশ্ব জনমত পাকিস্তানের পক্ষেই থাকত। বঙ্গবন্ধু একজন ঋদ্ধ ও প্রাজ্ঞ দূরদৃষ্টিসম্পন্ন রাজনীতিক হিসেবে জানতেন একটি অখণ্ড রাষ্ট্র কাঠামোর অভ্যন্তরে আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার অর্জনে মূল শর্তই হলো সর্বপ্রথম আক্রমণকারী না হওয়া। নাইজেরিয়ার বায়াফ্রার বিদ্রোহ বিচ্ছিন্নতাবাদ হিসেবে বিশ্বে চিহ্নিত হয়, যার ফলে সেই বিদ্রোহ স্বাধীনতা অর্জনে ব্যর্থ হয়। পাকিস্তান বাহিনী যখন প্রথম আক্রমণ করল কেবল তখনই বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ৫. জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জানতেন জনগণ স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত, কিন্তু যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নেই। এমন কি বাঙালি সামরিক বাহিনীও না। মেজর জিয়ার কাছে ৭ মার্চের ভাষণ স্বাধীনতার ‘গ্রিন সিগন্যাল’ মাত্র। কিন্তু ‘রেড সিগন্যাল’ নয়। ৭ মার্চের ভাষণের পর বঙ্গবন্ধু যখন যুদ্ধ-পদ্ধতি, গেরিলা যুদ্ধে ও জনযুদ্ধের রূপরেখা ঘোষণা করলেন তারপর থেকে বাঙালি জাতি সশস্ত্র যুদ্ধ-প্রস্তুতি গ্রহণ করে। ৬. ৭ মার্চ সম্পর্কে বিদেশি সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু অফ দি রেকর্ডে বলেন, ‘তিনি যা বলবেন তা হবে স্বাধীনতার সমার্থক যা স্বাধীনতার বৃত্তে চলে যাবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নথিতে বলা হয়েছে, সম্ভবত মুজিব স্বাধীনতা ঘোষণা করবেন। হেনরি কিসিঞ্জার এক বৈঠকে এভাবে মূল্যায়ন করেন যে, তার মূল লক্ষ্য বাংলাদেশের স্বাধীনতা, যা তিনি প্রকারান্তরে ঘোষণা করেছেন।’ বঙ্গবন্ধু মার্ক টালিকে বলেন, আমি চাই স্বাধীনতা। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু বজ কণ্ঠে স্বাধীনতার সেই কাঙ্ক্ষিত-কাব্যিক বাণী উচ্চারণ করেন, ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।’

লেখক : ’৭২ সনের খসড়া সংবিধান প্রণেতা ও সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী।

সর্বশেষ খবর