মঙ্গলবার, ২৬ এপ্রিল, ২০১৬ ০০:০০ টা

জোড়া খুন কলাবাগানে

মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সাবেক প্রটোকল কর্মকর্তা ও তার বন্ধুকে বাসায় ঢুকে কুপিয়ে হত্যা

নিজস্ব প্রতিবেদক

জোড়া খুন কলাবাগানে

রাজধানীর কলাবাগানের সাততলা ভবনের দোতলার একটি ফ্ল্যাটে ঢুকে দুজনকে কুপিয়ে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। পাঁচ-ছয়জনের একদল যুবক ফিল্মি কায়দায় ৫ মিনিটের মধ্যে তাদের হত্যার মিশন শেষ করে রক্তমাখা চাপাতি আর আগ্নেয়াস্ত্র হাতে বীরদর্পে ওই ভবন থেকে বেরিয়ে যায়। রাস্তায় এ সময় তাদের যারা বাধা দিতে গিয়েছে, উল্টো ধাওয়ার মুখে তারাই পালিয়েছে। তাদের হামলায় এ সময় ওই বাসার নিরাপত্তা রক্ষী আহত হন। রাস্তায় তাদের সামনে পড়া এক পুলিশ সদস্যও রেহাই পাননি। আহত হয়েছেন তাদের হাতে থাকা ধারালো অস্ত্রের আঘাতে। একইভাবে ডাকাত বলে চিৎকার করায় আইডিয়াল কলেজের এক শিক্ষার্থীর ওপর হামলা করে দুর্বৃত্তরা। ঘটনাস্থলের অদূরে পান্থপথের কনকর্ড টাওয়ারের সামনে গিয়ে তারা রক্তমাখা কাপড় পাল্টে ফেলে। এ সময় লোকজন তাদের আবারও ধাওয়া দিতে গেলে ফাঁকা গুলিবর্ষণ করতে থাকে তারা। গুলির শব্দে লোকজন ছোটাছুটি করতে থাকে। সুযোগ পেয়ে তখন তারা লাপাত্তা।

দুঃসাহসিক এই জোড়া খুনের ঘটনাটি ঘটে গতকাল বিকালে উত্তর ধানমন্ডির কলাবাগানের তেঁতুলগলি এলাকার ৩৫ নম্বর বাসায়। নিহতরা হলেন জুলহাজ মান্নান (৩৫) এবং তনয় মজুমদার (৩৩)। ‘আছিয়া নিবাস’ নামে ওই ভবনের দোতলার একটি ফ্ল্যাটে জুলহাজ মাকে নিয়ে থাকতেন। তার মা ছখিনা বেগম শেরেবাংলা সরকারি গার্লস স্কুলের সাবেক প্রধান শিক্ষিকা। ঘটনার সময় তিনি এবং গৃহকর্মী রেশমা আক্তার (১০) বাসায় ঘুমিয়ে ছিলেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছে, টি-শার্ট ও জিন্স প্যান্ট পরিহিত হামলাকারী যুবকরা খুনের পর ‘আল্লাহু আকবার’ বলতে বলতে আগ্নেয়াস্ত্র থেকে গুলি ছুড়ে পালিয়ে যায়। হত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষদর্শী বাড়ির সিকিউরিটি গার্ড পারভেজ মোল্লা (১৯) জানান, নিজেদের কুরিয়ার সার্ভিসের কর্মী পরিচয় দিয়ে ভবনের ভিতর প্রবেশ করে চার-পাঁচজনের একদল যুবক। তাদের হাতে দুটি প্যাকেটও ছিল। জুলহাজকে পৌঁছে দেওয়ার নাম করে খুনিরা সাততলার ওই বাড়িটিতে ঢোকে। ৫ মিনিটের মধ্যেই তারা বেরিয়ে যায়। পারভেজের ওপরও হামলা চালায় তারা। কিন্তু ভাগ্যের জোরে তিনি বেঁচে যান।  লেখক, শিক্ষক, অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট, ভিন্ন মতের ইসলামী ভাবধারা অনুসারী ও বিদেশির পর এবার দুর্বৃত্তের চাপাতির আঘাতে নিহত হলেন সমকামীদের অধিকার নিয়ে সোচ্চার কর্মী। রাজশাহীতে বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপক হত্যাকাণ্ডের দুই দিনের মাথায় রাজধানীতে ঘরে ঢুকে দুজনকে কুপিয়ে খুন করার ঘটনা ভাবিয়ে তুলেছে পুলিশ ও গোয়েন্দাদের। পুলিশ এখন ওই এলাকার সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহের চেষ্টা করছে।

মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা স্টিফেনস ব্লুম বার্নিকাট এক বিবৃতিতে বলেছেন, জুলহাজসহ দুজনের এই হত্যাকাণ্ডে আমি স্তম্ভিত। জুলহাজ মার্কিন দূতাবাসে শুধু আমাদের সহকর্মীই ছিলেন না, তিনি ছিলেন আন্তরিক বন্ধু। এই ঘটনায় জড়িতদের গ্রেফতারের জন্য আমরা বাংলাদেশ সরকারের কাছে জোর দাবি জানাচ্ছি।  পুলিশ কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়া ঘটনাস্থলে উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, পূর্ব শত্রুতা বা জঙ্গি সম্পৃক্ততা রয়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। মাত্র ৫ মিনিটের মধ্যে ঘাতকরা এই খুনের ঘটনাটি ঘটিয়ে পালিয়েছে।  যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক উন্নয়ন সংস্থা ইউএসএআইডির কর্মসূচি কর্মকর্তা জুলহাজ (৩৫) সমকামীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার সাময়িকী ‘রূপবান’ সম্পাদনায় যুক্ত ছিলেন। ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের সাবেক প্রটোকল কর্মকর্তা জুলহাজ সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক দীপু মনির খালাতো ভাই। জুলহাজের বাবা সাবেক উপসচিব আবদুল মান্নান মারা গেছেন বেশ কয়েক বছর আগে। জুলহাজরা দুই ভাই। বড় ভাইয়ের নাম ইমন। ইমনের ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন জুলহাজ।  জুলহাজের সঙ্গে নিহত ব্যক্তির নাম মাহবুব রাব্বী তনয় (২৬)। লোকনাট্য দলের কর্মী তনয় অধিকারকর্মী জুলহাজের বন্ধু ছিলেন। হামলায় দুজনে ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান। তনয় পিটিএ নামে একটি প্রতিষ্ঠানে ‘শিশু নাট্য প্রশিক্ষক’ হিসেবে কাজ করতেন বলে তার টুইটার অ্যাকাউন্টে বলা হয়েছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের গণমাধ্যম বিভাগের উপকমিশনার মো. মারুফ হোসেন সরদার বলেন, বিকালে কয়েকজন দুর্বৃত্ত পার্সেল দেওয়ার কথা বলে ওই বাসায় ঢুকে কুপিয়ে দুজনকে হত্যা করে। তবে ওই পার্শেলে পাওয়া যায় শুধু কাগজ।  রাত ১২টায় লাশ দুটি ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে নেওয়া হয়। পুলিশ, র‌্যাব, সিআইডিসহ বিভিন্ন সংস্থার পদস্থ কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন। তবে কারা এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত তা পুলিশ এখনো নিশ্চিত হতে পারেনি। ঘটনাস্থল থেকে খুনিদের ফেলে যাওয়া একটি কালো ব্যাগ ও চাপাতি উদ্ধার করে পুলিশ। তবে এখনো কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ।  কারা এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে, সে বিষয়ে তাত্ক্ষণিকভাবে কিছু জানায়নি পুলিশ। তবে গত কয়েক বছরে ব্লগার, অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট খুন যেভাবে হয়েছিল, জুলহাজ হত্যাকাণ্ডও ঘটেছে একইভাবে। গত শনিবার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও সংস্কৃতিকর্মী এ এফ এম রেজাউল করিম সিদ্দিকীকে একইভাবে কুপিয়ে হত্যার সঙ্গেও জঙ্গিদের দিকেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সন্দেহের তীর। আহত দারোয়ান পারভেজ মোল্লা সাংবাদিকদের বলেন, ‘বিকাল ৫টার দিকে ছয় যুবক পার্সেল দেওয়ার কথা বলে জুলহাজ মান্নানের ফ্ল্যাটে যেতে চান। আমি জুলহাজ সাহেবের অনুমতি নিতে দোতলায় যেতে থাকলে পিছু পিছু তিনজন দোতলায় চলে আসে। তিনজন নিচে রয়ে যায়। দরজা নক করলে জুলহাজ স্যার দরজা খোলেন। তাদের দেখে আবারও দরজা বন্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা করেন। তখন তারা বাসায় জোর করে ঢুকতে চায়। আমি তাদের বলি, স্যার যেহেতু ঢুকতে দিতে চান না, আপনারা চলে যান। এ কথা বলার পরই আমাকে আঘাত করে। আমি লুটিয়ে পড়ি। ওই যুবকরা জোর করে ঘরে ঢুকে জুলহাজ ও তার সঙ্গে থাকা অন্যজনকে (তনয়) কোপাতে থাকে। আমি চিৎকার করি, স্যারও চিৎকার করতে থাকেন। ওই সময় বাসার নিচে কয়েক রাউন্ড গুলির আওয়াজও পাই। এ পরিস্থিতিতে কখন তিনজন বাসা থেকে বের হয়ে যায়, বুঝতে পারিনি।’ ওই ভবনের আরেক নিরাপত্তা কর্মী সুমন জানায়, ‘ছয় যুবকের তিনজন পারভেজের পেছনে পেছনে উপরে চলে যায়। তাদের মধ্যে তিনজন নিচে আমাকে আর কেয়ারটেকার আবদুর রহিমকে সিকিউরিটি গার্ড রুমে নিয়ে আটকে রাখে। ৫ মিনিট পরই হাতে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে নিচে নেমে আসতে দেখি ওই তিন যুবককে।’ ঘটনার পরপরই জুলহাজের ঘরে ঢুকে দেখে আসা ওই ভবনের এক বাসিন্দা বলেন, ‘বাসায় ঢুকে দেখি বেডরুমে একজন ও দরজার কোনায় আরেকজন পড়ে আছে। জুলহাজের পরনে ছিল টি-শার্ট আর শর্টস। পুরো মেঝে তখন রক্তে ভেসে যাচ্ছিল।

সর্বশেষ খবর