মঙ্গলবার, ২৬ এপ্রিল, ২০১৬ ০০:০০ টা

কাশিমপুরে গুলি করে হত্যা

কারা ফটকের সামনে সাবেক কারা সার্জেন্ট খুন

নিজস্ব প্রতিবেদক ও গাজীপুর প্রতিনিধি

কাশিমপুরে গুলি করে হত্যা

কাশিমপুর কারাগারের কাছে এই ওষুধের দোকানের সামনেই গুলি করে হত্যা করা হয় রুস্তম আলীকে —বাংলাদেশ প্রতিদিন

এবার গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারের মূল ফটকের ২০০ গজ দূরে সাবেক কারারক্ষীকে ফিল্মিস্টাইলে গুলি করে হত্যা করেছে তিন দুর্বৃত্ত। গতকাল দুপুর সোয়া ১১টার দিকে তিন দুর্বৃত্ত একটি মোটরসাইকেল যোগে এসে কাশিমপুর কারাগারের মূল ফটকের ২০০ গজ দূরে আহাম্মদ মেডিসিন কর্নারের সামনে চাঞ্চল্যকর এ হত্যাকাণ্ড ঘটায়। কারাফটকের সামনে একটি ওষুধের দোকানে ওষুধ কিনতে এসেছিলেন নিহত রুস্তম আলী। এ সময় তিনি কিছু বুঝে ওঠার আগেই দুর্বৃত্তরা গুলি করে পালিয়ে যায়। খবর পেয়ে পুলিশ ও কারা কর্তৃপক্ষের লোকজন রুস্তম আলীকে উদ্ধার করে শহীদ তাজউদ্দীন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। ঘটনার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে রুস্তম আলীর পালিত মেয়ে নাহিদা আক্তারের স্বামী সোহেল রানাকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। অন্যদিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ঘটনাস্থলের দোকানের মালিক মো. সাইফুল ইসলামসহ তিনজনকে আটক করেছে পুলিশ। চাঞ্চল্যকর এ ঘটনায় কারা এলাকা, কোনাবাড়ীসহ আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। ঘটনার পর পুলিশ, র‌্যাব, কারা পুলিশ, পিবিআই, ডিবিসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। রাতে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত নিহতের স্ত্রী নাসরিন আক্তার বাদী হয়ে জয়দেবপুর থানায় মামলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।

এ ঘটনা তদন্তে জেলা পুলিশ এবং কারা কর্তৃপক্ষ দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। গাজীপুরের দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার মো. দেলোয়ার  হোসেন জানান, ঘটনা তদন্তে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ  সোলাইমানকে প্রধান করে ৪ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির অপর সদস্যরা হলেন— এএসপি মো. মনোয়ার  হোসেন, গাজীপুর ডিবির ওসি মো. আমির হোসেন এবং জয়দেবপুর থানার ওসি (তদন্ত) মো. মাহফুজুর রহমান। অন্যদিকে গাজীপুর  জেলা কারাগারের জেল সুপার সুভাষ কুমার ঘোষ জানান, ডিআইজি প্রিজন গোলাম হায়দারকে প্রধান করে কারা কর্তৃপক্ষের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির অপর সদস্যরা হলেন— কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার  মো. মিজানুর রহমান, কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার ১-এর জেলার  দেওয়ান মো. তারিকুল ইসলাম। সাত কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা রয়েছে। নিহত রুস্তম আলী পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া থানার চরগাছিয়া এলাকার মৃত আবদুল মান্নানের ছেলে এবং তিনি গাজীপুর কেন্দ্রীয় কারাগার সংলগ্ন উত্তর পাশে দেওয়ালিয়া বাড়ি এলাকায় নিজ বাড়িতে সপরিবারে বসবাস করে আসছিলেন।

এদিকে গতকাল ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের কোনাবাড়ী বাজারসহ আশপাশের এলাকায় থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। কাশিমপুর কারাগারের মূল ফটকে যাওয়ার সড়কের দুই পাশের একটি দোকানও খোলা পাওয়া যায়নি। কারা ফটকে যাওয়ার ঠিক ২০০ গজ আগে (উত্তরে) রাস্তার পশ্চিম পাশে আহাম্মদ মেডিসিন কর্নারের মূল দরজার (সাটারের) সঙ্গেই ঘটনাটি ঘটে। ঘটনাস্থলে সুনসান পরিবেশ। দোকানের সামনে ছোপ ছোপ রক্তের দাগ পড়ে আছে। দোকানের ভিতরে চেয়ারগুলো যত্রতত্র অবস্থায় পড়ে আছে। এদিকে কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারের মূল ফটকের সামনে ও আশপাশে নেই তেমন কোনো নিরাপত্তার ব্যবস্থা। অনেকটা অরক্ষিত অবস্থায় দেখা যায় কারা ফটকের মূল সড়ক। সড়কের দুই পাশে যত্রতত্র গড়ে উঠেছে নানা ধরনের দোকান। পাশের দোকানদার নাজমুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, পরপর কয়েক রাউন্ড গুলির শব্দ পেয়ে দোকান থেকে বেরিয়ে দেখি রুস্তম আলী রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে পড়ে আছেন। দুজন লোক পাশেই একটি মোটরসাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অন্য একজন পিস্তল হাতে নিয়ে ওই মোটরসাইকেলে ওঠে দ্রুত পালিয়ে যায়। এ সময় দুর্বৃত্তরা কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছোড়ায় আমরা সাহস করে এগোইনি। তিনি বলেন, ঘটনার ৪-৫ মিনিট আগে রুস্তম আলী ওষুধের দোকানের সামনে আসেন। আর এর মধ্যেই ঘটনাটি ঘটে। প্রত্যক্ষদর্শী শরবত বিক্রেতা আল আমিন বলেন, কারাগারের সামনে ভ্যানে করে আমি শরবত বিক্রি করছিলাম। এমন সময় গুলির শব্দ শুনি। সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে এসে রুস্তম আলীকে রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে পড়ে থাকতে দেখি। একটু পরেই কারাগার থেকে লোকজন দৌড়ে এসে রুস্তম আলীকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। তিনি বলেন, একজন লোক হাতে একটি পিস্তল নিয়ে উপরের দিকে ফাঁকা গুলি ছুড়তে ছুড়তে দাঁড়িয়ে থাকা মোটরসাইকেলে ওঠে এবং পালিয়ে যায়। প্রত্যক্ষদর্শী ফাস্টফুড দোকানের মালিক জামাল উদ্দিন জানান, বেলা সোয়া ১১টার দিকে দোকানের একটি সাটার বন্ধ করে ভিতরে কাজ করছিলাম। হঠাৎ দুটি বিকট শব্দ শুনে বাইরে বেরিয়ে দেখি আহম্মদ মেডিসিন কর্নার ওষুধের দোকানের সামনে ভিড় দেখা যাচ্ছে। পরে দোকানে সামনে গিয়ে রুস্তম আলীর লাশ দেখতে পাই। লোকমুখে শুনতে পেলাম, কিছু বুঝে ওঠার আগে দুর্বৃত্তরা তাকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ে মোটরসাইকেল যোগে দ্রুত এলাকা ত্যাগ করে। ঘটনাস্থলে দুই রাউন্ড গুলির খোসা পড়ে ছিল। তার বুকে ও মাথায় গুলিতে জখমের চিহ্ন রয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয় এক ভাঙাড়ি দোকানের মালিক স্বপন মিয়া জানান, কাশিমপুর কারাগার সড়কের পাশে রুস্তম আলী ওই ওষুধের দোকান থেকে ওষুধ কিনছিলেন। এ সময় তিন আরোহীসহ একটি চলন্ত মোটরসাইকেল গতি কমিয়ে এক আরোহী কয়েক রাউন্ড গুলি ছুড়ে মোটরসাইকেলে করেই দ্রুত পালিয়ে যায়। ঘটনার পর এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে এবং ব্যবসায়ীরা শতাধিক দোকানপাট বন্ধ করে চলে যান। ঘটনাস্থল পুলিশ ঘেরাও করে রেখেছে। এ ছাড়াও ওই এলাকায় র‌্যাব, ডিবি, পুলিশ টহল দিচ্ছে। পাশাপাশি বিপুল পরিমাণ পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। কোনাবাড়ী পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ উপ-পরিদর্শক (এসআই) মোবারক হোসেন জানান, কোনাবাড়ী নতুনবাজার থেকে কাশিমপুর কারাগার লিংক রোডে কারাগারের মূল ফটক থেকে মাত্র ২৫০ গজ দূরে একটি ওষুধের দোকানের সামনে দাঁড়িয়েছিলেন অবসর প্রস্তুতিকালীন ছুটিতে থাকা সার্জেন্ট ইনস্ট্রাক্টর (অব.) রুস্তম আলী। এ সময় মোটরসাইকেল আরোহী তিন দুর্বৃত্ত তাকে লক্ষ্য করে কয়েক রাউন্ড গুলি ছুড়ে পালিয়ে যায়। ঘটনাস্থল থেকে দুই রাউন্ড গুলির খোসা উদ্ধার করা হয়েছে বলেও জানান কোনাবাড়ী পুলিশ ফাঁড়ির ইনচর্জ এসআই মো. মোবারক হোসেন। কাশিমপুর কারাগার ইউনিট-২ এর জেল সুপার প্রশান্ত কুমার বিশ্বাস বলেন, রুস্তম আলী বরিশালের বাসিন্দা হলেও সার্ভিস বুকে তার ঠিকানা কুমিল্লা লেখা রয়েছে।

কাশিমপুর কারাগার-১ এর ডেপুটি জেল সুপার মো. মমিনুল ইসলাম জানান, বেলা সাড়ে ১১টার দিকে খবর পাই রুস্তমকে তিনজন দুর্বৃত্ত এসে গুলি করে পালিয়ে গেছে। পরে দ্রুত ঘটনাস্থলে গিয়ে তাকে মৃত দেখতে পাই। রুস্তম কাশিমপুর মহিলা কারাগার থেকে সার্জেন্ট ইনস্ট্রাক্টর হিসেবে পদোন্নতি পেয়ে অবসরে যান। এখন তিনি অবসরকালীন ছুটি ভোগ করছেন। শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক ফারজানা জাহান জানান, রুস্তম আলীকে মৃত অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়েছিল। তার শরীরে ৩-৪টি গুলির চিহ্ন রয়েছে। হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. আবদুস সালাম বলেন, রুস্তম আলীর বাম গাল দিয়ে গুলি ঢুকে ডান গাল দিয়ে বের হয়ে যায়। আরেকটি বুকের বাম দিক দিয়ে ঢুকে হার্ট ছিদ্র হয়ে ভিতরে থেকে যায়। যা আমরা রুস্তম আলীর বুক থেকে উদ্ধার করি। তার বাম কাঁধে, বাম কনুইয়ে, ডান হাতের তর্জনীতে, পেটের বাম দিক দিয়ে ঢুকে ডান দিক দিয়ে গুলি বের হয়েছে। জয়দেবপুর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) খন্দকার রেজাউল হাসান জানান, ঘটনাস্থল পরিদর্শন করা হয়েছে। আসামিদের ধরার চেষ্টা চলছে। এ ঘটনায় আহাম্মদ মেডিসিন কর্নারের মালিক মো. সাইফুল ইসলাম ও রুস্তম আলীর মেয়ের জামাই সোহেলকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয়েছে। ঘটনাস্থল পরিদর্শনে এসে পুলিশ ব্যুরো ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) গাজীপুর জেলা এডিশনাল এসপি এআরএম আলিফ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, কাশিমপুর কারাগারে বিভিন্ন ধরনের কুখ্যাত সন্ত্রাসীদের রাখা হয়। রুস্তম আলীর দায়িত্ব পালনের সময় এসব সন্ত্রাসীদের সঙ্গে হয়তো কখনো কোনো কারণে শত্রুতা ঘটতে পারে অথবা পারিবারিক কোনো কারণেও এমন ঘটনা ঘটতে পারে। এদিকে গতকাল বিকাল ৫টার দিকে কারা মহাপরিদর্শক (আইজি প্রিজন) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ ইফতেখার উদ্দিন এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেন, ঘটনাস্থল ও অন্যান্য আলামত দেখে সম্প্রতি দেশের অন্যান্য হামলার ঘটনার সঙ্গে অনেকটা মিল পাওয়া যায়। এ জন্য বিষয়টি জোর দিয়ে তদন্ত করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর