মঙ্গলবার, ২৬ এপ্রিল, ২০১৬ ০০:০০ টা

হত্যার পরিকল্পনা ৮ মাস আগে

অধ্যাপক রেজাউল হত্যায় বিক্ষোভ প্রতিবাদ

নিজস্ব প্রতিবেদক, রাজশাহী

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক এ এফ এম রেজাউল করিম সিদ্দিকীকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয় আট মাস আগে। এর পরই তিনি ছিলেন হত্যাকারীদের নজরদারিতে। হত্যায় অংশ নেয় বহিরাগত প্রশিক্ষিত কিলাররা। পুলিশের হাতে আটক শিবির নেতা হাফিজুর রহমান পুলিশের কাছে এ তথ্যই দিয়েছেন। তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে গতকাল দুপুরে আরও একজনকে আটক করা হয়েছে। এদিকে হাফিজুরের দেওয়া তথ্যের সব বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি মামলার তদারকি কমিটির প্রধান ও নগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার সরদার তমিজউদ্দিন আহমদ। তবে তিনি দাবি করেন, হত্যাকাণ্ডের রহস্য শিগগিরই উদ্ঘাটন হবে। তিনি শুধু বলেন, এ হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে চমকপ্রদ তথ্য পাওয়া গেছে। তথ্যগুলো যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। পরে সেগুলো প্রকাশ্যে নিয়ে আসা হবে। জানা গেছে, আটক হাফিজুর রহমান নগরীর ১৯ নম্বর ওয়ার্ড শিবিরের সেক্রেটারি। তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে পুলিশ গতকাল দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীকে আটক করেছে। হত্যাকাণ্ডে ওই শিক্ষার্থীর যোগসূত্র আছে বলে পুলিশের দাবি। তবে তদন্তের স্বার্থে পুলিশ ওই শিক্ষার্থীর নাম-পরিচয় বলছে না। নগর পুলিশ কমিশনার মো. শামসুদ্দিন জানান, আটক হাফিজুর রহমানকে এখনো জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে তাকে আটক করা হয়েছে। তার দেওয়া তথ্যের সঙ্গে অনেক কিছু মিলে যাচ্ছে। পুলিশের একটি সূত্র জানায়, রাবির এই জনপ্রিয় শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ফিকশন’ নামের একটি কোর্স পড়াতেন। তবে ধর্ম নিয়ে কোনো আলোচনা করে থাকলে সেই ক্লাসে হতো। ক্লাসের বাইরে তিনি কোথাও আড্ডা ও গল্প করতেন না। ফলে ধর্মকে কটাক্ষ করে তার কোনো বক্তব্য বাইরে আসার কথা নয়। ধর্ম নিয়ে তার বিরুদ্ধে যে প্রচারণা শুরু হয়েছে তা ইংরেজি বিভাগের ওই শিক্ষার্থীর কাজ। ফলে এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে আটক শিক্ষার্থী জড়িত বলে পুলিশ ধারণা করছে।

এমপি বাদশার ক্ষোভ : রাজশাহী সদর আসনের এমপি ফজলে হোসেন বাদশা বলেছেন, ‘রাজশাহীতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। একের পর এক হত্যা ছাড়াও বড় ধরনের ঘটনা ঘটছে।’ গতকাল দুপুরে সংবাদ সম্মেলন করে তিনি এ ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ‘পুলিশ এখন এমপির ঊর্ধ্বে চলে গেছে। তারা কোনো কথা শোনে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা হত্যার শিকার হলেও পুলিশের তত্পরতা দেখা যাচ্ছে না। এভাবে পুলিশ তাদের দায় এড়াতে পারে না। পুলিশ যদি তাদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়, তাহলে জনগণকে নিয়ে মাঠে নামা হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি চাই পুলিশ তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করুক।’

জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ হারিয়ে ফেললাম : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি জানান, ‘তোমরা এখনকার ছেলেমেয়েরা একদমই পড়ালেখা করতে চাও না। সকাল ৯টা-১০টা পর্যন্ত শুধু ঘুমাও।’ শাসনের সুরে এই কথাগুলো আমাকে আর কেউ বলবে না। আমি আর কখনো আব্বু বলে ডাকতে পারব না। আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ হারিয়ে ফেললাম। কান্নায় চেপে আসছে গলা, ঝাপসা চোখে প্রিয় বাবার স্মৃতিময় জীবনকে বর্ণনা করলেন নিহত শিক্ষক এ এফ এম রেজাউল করিম সিদ্দিকীর কন্যা রিজওয়ানা হাসিন শতভী। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ আয়োজিত শোকসভায় তিনি এসব কথা বলেন।

ব্লগে লেখালেখি বিষয়ে তিনি বলেন, ‘প্রযুুক্তি সম্পর্কে বাবার ন্যূনতম ধারণাও ছিল না। ব্লগে লেখালেখির তো কোনো প্রশ্নই আসে না। যারা এ গুজব ছড়িয়েছে তারাও খুনিদের চেয়ে কম অপরাধী নয়।’ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক এ এফ এম রেজাউল করিম সিদ্দিকীর হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে তৃতীয় দিনের মতো ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধসহ আন্দোলনে উত্তাল রয়েছে ক্যাম্পাস। গতকাল বিভিন্ন বিভাগ ও সংগঠনের পক্ষ থেকে মানববন্ধন, শোক-মিছিল, সভা, অবস্থান ধর্মঘট ও সমাবেশ কর্মসূচি পালন করা হয়। ক্যাম্পাস ঘুরে দেখা যায়, কোনো বিভাগে ক্লাস-পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়নি। বিভাগের অফিস খোলা ছিল এবং অধিকাংশ শিক্ষক-কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন। তবে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি ছিল খুবই কম।

ইংরেজি বিভাগের কর্মসূচি : ইংরেজি বিভাগ সকাল ১০টায় শহীদুল্লাহ কলা ভবনের সামনে থেকে শোক মিছিল শুরু করে ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করে। এরপর তারা শিক্ষক সমিতির মানববন্ধনে মিলিত হয়। পরবর্তীতে শহীদুল্লাহ কলা ভবনের ১৫০ নম্বর কক্ষে বিভাগের পক্ষ থেকে শোকসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় উপস্থিত ছিলেন রাবির উপাচার্য অধ্যাপক মুহম্মদ মিজানউদ্দিন, উপ-উপাচার্য অধ্যাপক চৌধুরী সারওয়ার জাহান, নিহত শিক্ষকের স্ত্রী হোসনে আরা, ছেলে রিয়াসাত ইমতিয়াজ সৌরভ, বিভাগের সভাপতি ড. এ এফ এম মাসউদ আখতারসহ বিভাগের শিক্ষক।

রাবি শিক্ষক সমিতির মানববন্ধন : সোমবার সকাল সাড়ে ১০টায় শিক্ষক হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবনের সামনে মানববন্ধন করে শিক্ষক সমিতি। সমাবেশে শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক শাহ্ আজম শান্তনুর সঞ্চালনায় বক্তব্য দেন ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক চিত্তরঞ্জন মিশ্র, সহকারী অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল্লাহ আল মামুন চৌধুরী, আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. হাসিবুল আলম প্রধান, ভূগোল ও পরিবেশ বিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক রকীব আহমেদ, কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ার বিভাগের সহকারী অধ্যাপক কাজী জাহিদুর রহমান প্রমুখ। মানববন্ধনে আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. হাসিবুল আলম প্রধান বলেন, আমরা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা অনেক দুর্ভাগা। ২০০৪ সালে ২৪ ডিসেম্বর রাবি শিক্ষক ইউনুস হত্যার মধ্য দিয়ে রাবিতে শুরু হয় শিক্ষক হত্যার ষড়যন্ত্র। গত ১২ বছরে একের পর এক সংস্কৃতিমনা, মুক্তবুদ্ধি চর্চা, প্রগতিশীল শিক্ষকদের হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু কোনো হত্যাকাণ্ডেরই সুষ্ঠু বিচার সম্পন্ন হয়নি। তবে কি এই বিশ্ববিদ্যালয়ে মুক্তবুদ্ধি চর্চা করা অপরাধ? মানববন্ধন শেষে রাবি উপাচার্য অধ্যাপক মুহাম্মদ মিজানউদ্দিনকে একটি স্মারক লিপি প্রদান করে রাবি শিক্ষক সমিতি।

বাগমারা থানা সমিতি : শিক্ষক হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় দুপুর সাড়ে ১২টায় শোক র‌্যালি ও মানববন্ধন করেছে বাগমারা থানা সমিতি। তারা এ হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত এবং জড়িতদের শাস্তি দাবি করে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, রাবি শিক্ষক হত্যার প্রতিবাদ ও ঐক্যবদ্ধ জাসদের দাবিতে গতকাল চাঁপাইনবাবগঞ্জে গণমিছিল ও সমাবেশ করেছে জেলা জাসদ। এ উপলক্ষে সোমবার দুপুর পৌনে ১২টায় শহরের নিমতলা কার্যালয় থেকে একটি গণমিছিল বের হয়ে শহরের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক প্রদক্ষিণ শেষে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে শহীদ নামফলক স্তম্ভে সমাবেশ করে। সমাবেশে বক্তব্য রাখেন, জেলা জাসদের সভাপতি আলহাজ রফিকুল ইসলাম, জাসদ ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সহ-সম্পাদক মাহবুব-উল-ইসলাম, জেলা শ্রমিক জোটের সভাপতি আবু বাক্কার, জাতীয় যুবজোট কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও জেলা সভাপতি হাবিবুর রহমান, শিবগঞ্জ উপজেলা জাসদ নেতা আজিজুর রহমান, জাসদ ছাত্রলীগের জেলা কমিটির সহসভাপতি আক্তার হামিদুজ্জামান, শিবগঞ্জ উপজেলা জাসদ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মো. অসিম প্রমুখ। বক্তারা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রেজাউল করিম হত্যার তীব্র প্রতিবাদ করেন ও হত্যাকারীদের চিহ্নিত করে তাদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার দাবি করেন। সেই সঙ্গে তারা কেন্দ্রীয় জাসদের অখণ্ডতা রক্ষা করে ঐক্যবদ্ধ জাসদের ব্যাপারে কেন্দ্রীয় নেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।

 

সর্বশেষ খবর