রবিবার, ১ মে, ২০১৬ ০০:০০ টা

শ্রমিকের মজুরি কমপক্ষে ১৮ হাজার টাকা হওয়া উচিত

রুহুল আমিন রাসেল

শ্রমিকের মজুরি কমপক্ষে ১৮ হাজার টাকা হওয়া উচিত

ডা. ওয়াজেদুল ইসলাম খান

স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে দেশের অভূতপূর্ব উন্নতি হলেও এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে শ্রমিকের মজুরি সে হারে বাড়েনি। বর্তমান আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট ও অর্থনীতির আকার সঠিকভাবে বিবেচনা করা হলে সব ধরনের শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি সর্বসাকল্যে ১৮ হাজার টাকা হওয়া উচিত, যেখানে মূল বেতন ১০ হাজার টাকার কম হবে না বলে মনে করেন প্রখ্যাত শ্রমিকনেতা ডা. ওয়াজেদুল ইসলাম খান। গতকাল রাজধানীর তোপখানা রোডে নিজ কার্যালয়ে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে দেওয়া সাক্ষাত্কারে বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র—টিইউসির সাধারণ সম্পাদক ডা. ওয়াজেদুল ইসলাম খান আরও বলেন, মুক্তবাজার অর্থনীতির ফলে জিনিসপত্রের দাম যেভাবে বেড়ে যায়, তাতে শ্রমিকের প্রকৃত মজুরি কমে যায়। তাই প্রকৃত মজুরি নিশ্চিত করতে একদিকে যেমন মূল্যস্ফীতির ভিত্তিতে মহার্ঘভাতা প্রদান করতে হবে, অন্যদিকে সস্তা ও সুলভমূল্যে সব মেহনতি মানুষের জন্য রেশনিং প্রথা চালু করা উচিত। কারণ, বাংলাদেশের উন্নয়ন যেভাবে বাড়ছে, সে তুলনায় সারা দেশে শ্রমিকের মজুরি ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা তেমন বাড়ছে না। আমাদের এক জরিপে উঠে এসেছে, মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় নিয়ে চার সদস্যবিশিষ্ট প্রতিটি শ্রমিক পরিবারের জন্য ন্যূনতম মজুরি ১৮ হাজার টাকা হওয়া উচিত।

বর্তমানে মজুরিবৈষম্য একটি বড় বিষয় হয়ে আছে উল্লেখ করে এই শ্রমিকনেতা বলেন, কোথাও দেখা যায় এখনো মাত্র ৩ হাজার টাকার বিনিময়ে শ্রমিকরা কাজ করছেন। আবার সেই একই কারখানার কর্মকর্তারা লাখ টাকা বেতন পান। অথচ সবাই একই দামে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য ও অন্যান্য ন্যূনতম এবং প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণে বিভিন্ন সামগ্রী কেনেন। সুতরাং এ ক্ষেত্রে দাবি তুলছি, শ্রমিকদের ন্যূনতম মূল মজুরি (বেসিক) ১০ হাজার টাকা দিতে হবে। এর নিচে কোনো মজুরি হবে না তবে শ্রমিক-কর্মকর্তার মধ্যে বেতনের স্বাভাবিক পার্থক্য থাকবে। আজকের মহান মে দিবস শ্রমিক-শ্রমজীবী মানুষের কাছে অত্যন্ত তাত্পর্যময় বলে অভিহিত করে টিইউসির সাধারণ সম্পাদক বলেন, ১৩০ বছর আগের এই দিনে যুক্তরাষ্ট্রের ‘হে মার্কেটে’ এক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে শ্রমিকরা প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরে জাগ্রত হয়েছিল। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ৮ ঘণ্টা কাজ, ৮ ঘণ্টা বিশ্রাম ও ৮ ঘণ্টা বিনোদনের এই দাবিতে আন্দোলনের দায়ে সাতজন শ্রমিকের ফাঁসি হয়। সেই ধারাবাহিকতায় পরে ফ্রান্সে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় ইন্টারন্যাশনাল লেবার কনভেনশনে এই দিনকে আন্তর্জাতিক শ্রম দিবস বা মে দিবস ঘোষণা করা হয়। প্রতিষ্ঠিত হয় শ্রমিকদের অধিকার। তাই এই দিনটি শ্রমিকদের কাছে বিজয় ও অনুপ্রেরণার। শ্রমিকদের ন্যূনতম অধিকার প্রতিষ্ঠার সবচেয়ে বড় হাতিয়ার ট্রেড ইউনিয়ন উল্লেখ করে ডা. ওয়াজেদুল ইসলাম খান বলেন, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা—আইএলও সনদ অনুযায়ী সব শ্রমিকের ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার ও যৌথ দরকষাকষির বিষয় অনুসমর্থন করেছে সরকার। কিন্তু সে অনুযায়ী সব শ্রমিককে ট্রেড ইউনিয়নের আওতায় আনা হয়নি বাংলাদেশের শ্রম আইনে। অন্যদিকে শ্রম আইনে যতটুকু ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার আছে, তার ভিত্তিতে ইউনিয়ন করতে গেলে শ্রমিকরা মালিকদের দ্বারা চাকরিচ্যুতিসহ নানা ধরনের হয়রানির শিকার হচ্ছেন। আমরা মনে করি, শ্রমিকদের আস্থায় নিয়ে তার সমস্যা সমাধানের মাধ্যমে দেশীয় শিল্পের উন্নয়ন সম্ভব। তিনি বলেন, শ্রমিকদের ঘামের বিনিময়ে সৌন্দর্য সৃষ্টি হলেও আজ তারা বেঁচে থাকার মতো মজুরি, ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার ও সামাজিক বলয় থেকে বঞ্চিত। এমন প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে নিরাপদ কর্মসংস্থান একটি অন্যতম বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এজন্য বিদেশি ক্রেতাদের পক্ষ থেকে বিল্ডিং কোড ও ফায়ার সেফটির ব্যাপারে যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তা প্রশংসনীয়। এটা পোশাকশিল্পের মালিকদের আরও আগে চিন্তাভাবনা করা উচিত ছিল। কারণ, নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত না হলে, তা একটা মৃত্যুকূপের শামিল। অথচ মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত এই দেশের শ্রমিকশ্রেণি তথা শ্রমজীবী মানুষের অর্থনৈতিক ও সামাজিক মুক্তি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার স্বপ্ন ছিল। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে স্বাধীনতার আগেও শ্রমিকশ্রেণি যে অধিকার এবং সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেছে তার অনেক কিছু থেকে তারা আজ বঞ্চিত। ডা. ওয়াজেদুল ইসলাম খান মনে করেন, আজও কোনো কোনো ক্ষেত্রে শ্রমিক-কর্মচারীদের চাকরির নিরাপত্তা ও নিশ্চয়তা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। কৃষি, তামাক, নির্মাণ, চাতাল, পরিবহন, পোশাকশিল্পসহ সব অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মরত শ্রমিকের ৯০ শতাংশই মূলত অসংগঠিত। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাদের কোনো নিয়োগপত্র দেওয়া হয় না। তাদের কাজের সময়সীমা, ছুটির বিধান ইত্যাদি কোনো কিছুই নেই। ট্রেড ইউনিয়ন কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত হতে না পারায় অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের এই শ্রমিকরা ন্যায্য মজুরি ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নিয়ে দরকষাকষির সুযোগও পান না। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রসঙ্গে এই শ্রমিকনেতা বলেন, সরকার বলছে এবারে দেশের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি—জিডিপি ৭ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে। তবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটলেই সমতা, সামাজিক সূচকের উন্নয়ন এবং দারিদ্র্য বিমোচন হয় না। স্মরণ রাখতে হবে, এখন দেশের পাঁচ সহস্রাধিক মধ্যম ও বড় পোশাক কারখানায় প্রায় ৪০ লাখ মানুষ কাজ করে। এসব শ্রমিকের পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার বিষয়টি স্বাভাবিকভাবেই আলোচিত হতে হবে। রানা প্লাজা, তাজরিন কারখানা এবং অতিসম্প্রতি গাজীপুরের একটি কেমিক্যাল কারখানার ভয়াবহ আগুন আমাদের সব সময় তাড়িয়ে বেড়ায়। মে দিবসের মিছিলে এখন নারী শ্রমিকদেরও ব্যাপক উপস্থিতি উল্লেখ করে ডা. ওয়াজেদুল ইসলাম খান বলেন, শ্রমবাজারে প্রতিনিয়ত নারী শ্রমিকের অংশগ্রহণ বাড়ছে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এসব নারী শ্রমিক মারাত্মকভাবে মজুরিবৈষম্যের শিকার। কৃষিক্ষেত্রে নিয়োজিত প্রায় ৮০ লাখ নারী শ্রমিক হিসেবেই স্বীকৃত নয়। গৃহস্থালি কাজে নিয়োজিত নারী শ্রমিকরা অধিকার ও মর্যাদা থেকে বঞ্চিত। সবচেয়ে বড় ব্যাপার, কর্মক্ষেত্রে বা রাস্তাঘাটে তাদের যৌন হয়রানিসহ নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হতে হয়। আধুনিক সমাজব্যবস্থার এই যুগে একটি রাষ্ট্রের জন্য এ চিত্র মোটেও স্বস্তিকর নয়। তার মতে অভিবাসী প্রায় ১ কোটি শ্রমিক আমাদের জিডিপিতে ১২ শতাংশ অবদান রাখলেও তাদের জন্য নেই কোনো নীতিমালা। চাকরিচ্যুত বা দুর্ঘটনাকবলিত হয়ে দেশে ফেরার পর তাদের দেখভালের কেউ থাকে না।

সর্বশেষ খবর