শনিবার, ১৮ জুন, ২০১৬ ০০:০০ টা

বেহাল অঙ্গ-সহযোগী সংগঠন

পদ হারানোর ভয়ে বছরের পর বছর হয় না সম্মেলন

রফিকুল ইসলাম রনি

বেহাল অঙ্গ-সহযোগী সংগঠন

পদপদবি হারানোর ভয়ে সম্মেলনে আগ্রহ নেই আওয়ামী লীগের সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের বর্তমান নেতাদের। দশটি সংগঠনের মধ্যে সাতটিই চলছে দীর্ঘদিনের মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি দিয়ে। গঠনতন্ত্র লঙ্ঘন করে ১০ থেকে ১৬ বছর আগের কমিটি দিয়েই খুঁড়িয়ে-খুঁড়িয়ে চলছে। ফলে এসব সংগঠনের কাজকর্মে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। তবে বিভিন্ন ইস্যুতে রাজপথে যুবলীগ ও ছাত্রলীগের সরব উপস্থিতি দেখা যায়। বাকিগুলোর কার্যক্রম দিবস কেন্দ্রিক কর্মসূচির মধ্যে সীমিত হয়ে পড়েছে। কবে নাগাদ সম্মেলন হবে তা কেউ বলতে পারছে না। তবে নেত্রী (শেখ হাসিনা) যখনই চাইবেন তখনই সম্মেলন করতে প্রস্তুত বলে জানিয়েছেন দায়িত্বপ্রাপ্তরা। আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী সাতটি সংগঠন সহযোগী এবং অন্য তিনটি ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের মর্যাদা পায়। সহযোগী সংগঠনগুলো হলো যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, কৃষক লীগ, মহিলা আওয়ামী লীগ, যুব মহিলা লীগ, আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ ও তাঁতি লীগ। ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন তিনটি হলো ছাত্রলীগ, জাতীয় শ্রমিক লীগ ও স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ-(স্বাচিপ)। ২০০৩ সালের ১২ জুলাই মহিলা আওয়ামী লীগ, ২০০৪ সালের ১৫ মার্চ যুব মহিলা লীগ এবং ২০০০ সালের ২০ জুলাই আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের সর্বশেষ সম্মেলন হয়েছে। ২০০৪ সালের ৮ আগস্ট তাঁতি লীগের আহ্বায়ক কমিটি গঠনের পর একবারের জন্যও সম্মেলন করতে পারেনি তারা। প্রায় কাছাকাছি সময়ে সম্মেলন অনুষ্ঠানের পর ২০১২ সালের ১১ জুলাই স্বেচ্ছাসেবক লীগ, ১৪ জুলাই যুবলীগ এবং ১৯ জুলাই কৃষক লীগ আরেক দফা কেন্দ্রীয় সম্মেলন করে নতুন নেতৃত্ব নির্বাচিত করে। সেই হিসেবে তিন বছর মেয়াদি এই কমিটির মেয়াদোত্তীর্ণ হয়েছে গত বছর জুলাইয়ে। ফলে এই তিনটি সংগঠনের মেয়াদ পার হয়েছে, এক বছর হতে চলল। গঠনতন্ত্র অনুসারে সহযোগী সংগঠনের সম্মেলনের মেয়াদ তিন বছর। সেই হিসেবে মহিলা আওয়ামী লীগ ১৩ বছর, যুব মহিলা লীগ ও তাঁতি লীগ ১২ বছর এবং আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ ১৬ বছর পার করতে চলেছে। অবশ্য আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃ সংগঠন ছাত্রলীগ কমিটির মেয়াদ দুই বছর উত্তীর্ণের পর গত বছর ২৫ ও ২৬ জুলাই এবং চিকিৎসকদের সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ) গত বছরের ১৩ নভেম্বর এ সংগঠনটির সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। তবে এখনো পুরোপুরি কমিটি গঠন করা সম্ভব হয়নি। অভিযোগ উঠেছে, সংগঠনের বর্তমান নেতাদের বড় একটি অংশ পদপদবি আঁকড়ে রাখার প্রবণতায় ভুগছে। এ জন্য সংগঠনগুলোর মধ্যম সারির নেতাদের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে। নেতৃত্ব-প্রত্যাশীরা মনে করছেন, দীর্ঘ সময় ধরে সম্মেলন না হওয়ায় তারা বঞ্চিত হচ্ছেন। যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, কৃষক লীগ ও মহিলা আওয়ামী লীগসহ সহযোগী সংগঠনগুলোর কয়েকজন নেতার সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, নতুন সম্মেলন হলে বর্তমান নেতৃত্বে বড় ধরনের পরিবর্তন আসবে, এটাই স্বাভাবিক। এতে পদ পদবি হারাতে হবে বর্তমান নেতৃত্বকে। বিশেষ করে সংগঠনগুলোর শীর্ষ নেতৃত্বের মধ্যে এই ভয় বেশি কাজ করছে। যে কারণে তারা মনে করছেন, সম্মেলন ছাড়াই যতদিন চালিয়ে নেওয়া যায়, তাদের জন্য ততটাই ভালো। যার কারণে তারা নিজেরাই সংগঠনের কাজে গতি আনতে আগ্রহী নন বলে সংগঠনগুলোর মধ্যম সারির নেতারা মনে করেন। আওয়ামী লীগের ভ্যানগার্ড হিসেবে পরিচিত আওয়ামী যুবলীগ। সব সময় রাজপথে সক্রিয় ছিল। আওয়ামী লীগ যখন বিরোধী দলে তখন নানক-আজমের নেতৃত্বে সরকারবিরোধী আন্দোলনে প্রতিদিনই কর্মসূচি নিয়ে মাঠে ছিল। মোহাম্মদ ওমর ফারুক চৌধুরী ও হারুনুর রশিদ নেতৃত্বে আসার পর এবং দল ক্ষমতাসীন হওয়ায় রাজপথে সরকারবিরোধী কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামতে না হলেও হরতাল-অবরোধ বিরোধী কর্মসূচি নিয়ে মাঠে ছিল যুবলীগ। দিবসভিত্তিক কর্মসূচি ছাড়াও বিভিন্ন প্রকাশনা-পুস্তক বিভিন্ন মহলে সাড়া ফেলেছে। প্রায় দিনই বিভিন্ন ইস্যুতে আলোচনা-কর্মিসভা ও প্রকাশনা উৎসব করছে যুবলীগ। তবে মেয়াদোত্তীর্ণ বর্তমান কমিটি। এ প্রসঙ্গে যুবলীগের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ওমর ফারুক চৌধুরী বলেন, আমরা কংগ্রেস করতে সব সময় প্রস্তুত। আমাদের সাংগঠনিক নেত্রী রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা যখনই বলবেন, তখনই আমরা আয়োজন করব। তিনি বলেন, মেয়াদোত্তীর্ণ জেলাগুলোর সম্মেলন করছি। ঢাকা শহরের বিভিন্ন ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে সম্মেলন চলছে। মূলত আমরা এখন সম্মেলনের ট্রেনে আছি। তিনি বলেন, শুধু সম্মেলন করলাম, নতুন কমিটি গঠন করলাম, এতে যে সংগঠন গতিশীল হবে এটা ভাবার সুযোগ নেই। সংগঠনের কাজ কী সেগুলো দেখতে হবে। যেখানে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় সেখানে আমাদের কাজ তো আন্দোলন-সংগ্রাম করা নয়। আমাদের কাজ সরকারের উন্নয়নগুলো জনগণের সামনে তুলে ধরা। যুবলীগের দায়িত্বভার গ্রহণের পর থেকেই রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার বিশ্ব দর্শন প্রচারে যুবলীগ কাজ করে চলেছে। আমাদের প্রকাশনা ‘রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার দর্শন’ জাতিসংর্ঘেও গৃহীত হয়েছে। দিবসভিত্তিক কর্মসূচি ছাড়াও প্রায় প্রতিদিনই আমরা রাজপথে সক্রিয় রয়েছি। এখন যুবলীগ মানেই সৃষ্টিশীল। আর কেউ টেন্ডারবাজি করতে যায় না বলেও মন্তব্য করেন তিনি। বিগত সময়ে আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে থাকাবস্থায় রাজপথে আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আলোচনায় ছিল দলের সহযোগী সংগঠন ‘বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগ’। কিন্তু সরকার গঠনের পর এ সংগঠনটিও এখন অনেকটাই নিষ্ক্রিয়। দলের সভানেত্রীকে মাঠে পাওয়া গেলেও সাধারণ সম্পাদকসহ অন্য নেত্রীদের দেখা মেলে কালেভদ্রে। আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে থাকার সময় রাজপথে বিরামহীন সক্রিয় ভূমিকা নেওয়ায় দ্রুত পরিচিতি পায় যুব মহিলা লীগ। আওয়ামী লীগের সব মহলেই আলাদা কদর তৈরি হয় ২০০২ এ জন্ম নেওয়া সর্বকনিষ্ঠ সংগঠন যুব মহিলা লীগ নেতা-কর্মীদের। কিন্তু আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে এ সংগঠনের নেতা-কর্মীরা বলতে গেলে ‘বেকার’ হয়ে পড়েন। এ প্রসঙ্গে যুব মহিলা লীগের সভাপতি নাজমা আক্তার ও সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপিকা অপু উকিল বলেন, আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী যুব মহিলা লীগ গঠন করে দিয়ে আমাদের এই পদ দিয়েছেন। তার নির্দেশেই আমরা সংগঠন করেছি। কাজেই পদ ধরে রাখার কোনো আকাঙ্ক্ষা বা লোভ কোনোটাই আমাদের নেই। তিনি যেখানে কাজ করার সুযোগ দেবেন, সেখানেই আমরা কাজ করব। আমাদের আঁকড়ে রাখার কোনো বিষয় নেই। দীর্ঘদিন সম্মেলন না হওয়ার কারণ সম্পর্কে এই দুই নেত্রী বলেন, আমাদের হাতেই এই সংগঠনটার জন্ম হয়েছে। গঠনের পর থেকে প্রথম ৬টি বছর আমাদের আন্দোলন-সংগ্রাম নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয়েছে। ফলে আমরা খানিকটা পিছিয়ে পড়েছি। তবে এখন আমরা সংগঠনটা গুছিয়ে এনেছি। নেত্রী চাইলে যে কোনো সময়ে সম্মেলন করতে পারব। কৃষক লীগের সাধারণ সম্পাদক খন্দকার শামসুল হক রেজা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, কৃষি ও কৃষকের কল্যাণে সরকারের গৃহীত বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়ে আমরা রাজপথে মাঠে সক্রিয়। এখন গ্রাম পর্যায়ে ফলদ-বৃক্ষ ও ঔষধি গাছের চারা রোপন করছি। কাজেই মাঠে নেই এমন কথা সত্য নয়। তিনি বলেন, সম্মেলনের জন্য কোনো চাপ নেই। তবে নেত্রী যখন চাইবেন তখনই আমরা সম্মেলন করতে প্রস্তুত। দলীয় সূত্রমতে, নিয়মিত সম্মেলন না হওয়ায় সংগঠনের নেতৃত্বপ্রত্যাশী অনেক যোগ্য ও দক্ষ নেতা-কর্মী যেমন হতাশ হয়ে পড়েন, তেমনি ‘বয়সের ফাঁদে’ পড়েও অনেকে ঝরে গেছেন। আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি দলকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করার পাশাপাশি সব সহযোগী-ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনকে সম্মেলন করার নির্দেশ দিয়েছেন। এরই ধারাবাহিকতায় শিগগিরই এসব সংগঠনের সম্মেলন হতে পারে। জুলাই মাসের শেষভাগে অনুষ্ঠিত ছাত্রলীগের সম্মেলনের পথ ধরে অন্য সহযোগী-ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনগুলোর সম্মেলনের সম্ভাবনাও দেখছেন আওয়ামী লীগের নীতি-নির্ধারক নেতারা। মহিলা আওয়ামী লীগ সভাপতি আশরাফুন্নেসা মোশাররফ, স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক পংকজ দেবনাথ, আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আবদুল্লাহ আবু ও শ্রমিক লীগের সভাপতি শুক্কুর মাহমুদ অভিন্ন ভাষায় বলেছেন, শিগগিরই সংগঠনগুলোর কেন্দ্রীয় ফোরামের বৈঠকে বসবেন তারা। এরপর মূল দলের নির্দেশনা অনুযায়ী সম্মেলনের তারিখ ও সময় ঠিক করা হবে। তবে নেত্রীর (শেখ হাসিনা) সময় দেওয়ার ওপরই সবকিছু নির্ভর করছে।

সর্বশেষ খবর