শনিবার, ১৮ জুন, ২০১৬ ০০:০০ টা

করে ফাঁকি ফাঁকির কর

রেহাই মিলেনি অবসরভোগী জ্যেষ্ঠ নাগরিকদেরও

রুকনুজ্জামান অঞ্জন

মধ্যপ্রাচ্যে দীর্ঘ ২০ বছর চাকরি করে গত বছর দেশে ফিরেছেন জামিল সাহেব (ছদ্মনাম)। থাকেন মিরপুরে। দেশে ফিরে খোঁজখবর নিয়ে তিনি জানলেন, তার মোট আয়ের ৩০ শতাংশ বিনিয়োগের ওপর ১৫ শতাংশ হারে কর রেয়াত সুবিধা রয়েছে। সে অনুযায়ী তিনি সঞ্চয়পত্রে ১০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছেন। এখন নতুন বাজেট ঘোষণার পর তিনি শুনছেন, ওই বিনিয়োগের ওপর কর রেয়াত সুবিধা কমে গেছে। তাকে আসলে ২০ শতাংশ বিনিয়োগের ওপর ১০ শতাংশ রেয়াত দেওয়া হবে। তিনি আরও শুনেছেন, কর রেয়াত সুবিধা কমে যাওয়ায় তাকে যে অতিরিক্ত কর দিতে হবে, সেটি কার্যকর হয়েছে এক করবর্ষ আগে থেকে। অর্থাৎ তিনি এক বছর আগে যে সুবিধা জেনে বিনিয়োগ করেছেন, সেটি আর থাকছে না। নতুন কর প্রস্তাব অনুযায়ী তাকে আগের বিনিয়োগে অতিরিক্ত কর দিতে হবে।

তিনি হিসাব-নিকাশ করে দেখছেন, আগের নিয়মে তার ১০ লাখ টাকায় করমুক্ত আয়সীমা আড়াই লাখ টাকা বাদ দিলে বাকি সাড়ে ৭ লাখ টাকা তার করযোগ্য আয়। এর ওপর প্রথম চার লাখ টাকার জন্য ১০ শতাংশ হারে, পরবর্তী ৫ লাখ টাকার ওপর ১৫ শতাংশ হারে কর বহাল রয়েছে। সে ক্ষেত্রে সাড়ে সাত লাখ টাকার ওপর প্রথম চার লাখ টাকায় ১০ শতাংশ হারে, পরবর্তী ৫ লাখ টাকার ওপর ১৫ শতাংশ হারে কর বহাল রয়েছে। সে ক্ষেত্রে সাড়ে সাত লাখ টাকার ওপর প্রথম চার লাখ টাকায় ১০ শতাংশ হারে ৪০ হাজার এবং পরের সাড়ে ৩ লাখের ওপর ১৫ শতাংশ হারে ৫২ হাজার টাকাসহ মোট কর হবে ৯২ হাজার টাকা। এখন আগের হিসাবে বিনিয়োগের জন্য মোট আয়ের ৩০ শতাংশের ওপর ১৫ শতাংশ কর রেয়াত সুবিধা দিলে করছাড়ের পরিমাণ দাঁড়ায় ৪৫ হাজার টাকা। অর্থাৎ তাকে ৪৭ হাজার টাকা কর দিতে হতো। এখন নতুন ঘোষণায় আয়কর সীমা না বাড়িয়ে কর রেয়াত সুবিধা কমানোর কারণে তাকে আরও ১৫ হাজার টাকা বেশি কর দিতে হবে। আর এটি কেটে নেওয়া হবে ওই এক বছর আগের বিনিয়োগ থেকেই। কারণ আয়কর নীতি অনুযায়ী ঘোষিত করহার কার্যকর হয় এক বছর আগে থেকে। তাহলে জামিল সাহেব এক বছর আগে যে সুবিধা দেখে বিনিয়োগ করেছিলেন, তিনি সেই সুবিধা পাচ্ছেন না। এক বছর পরের একটি ঘোষণা অনুযায়ী তার কাছ থেকে বেশি কর কেটে নেওয়া হচ্ছে। বিষয়টিকে এক ধরনের ‘প্রতারণা’ বলে মন্তব্য করেন দীর্ঘদিন প্রবাসে থাকা ওই ভদ্রলোক। বাংলাদেশ প্রতিদিনকে তিনি বলেন, এ ঘোষণার মাধ্যমে করদাতাদের সঙ্গে এক ধরনের ‘ফাঁকিবাজি’ করা হয়েছে। এই ফাঁকিতে শুধু যে ওই প্রবাসী ভদ্রলোক পড়েছেন তা-ই নয়, শেয়ারবাজারে ধস নামার পর দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণি নিরাপদ বিনিয়োগের আশায় সঞ্চয়পত্রের ওপর ভরসা রেখেছিলেন, তারাও পড়েছেন ফাঁকিতে। সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবী, ছোট-বড় ব্যবসায়ী, শিল্পোদ্যোক্তা— সবার কাছেই এ বাজেটের করব্যবস্থায় ফাঁকির বিষয়টি উঠে এসেছে। বর্ধিত করের এ চাপ থেকে রেহাই মেলেনি অবসরভোগী কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং সিনিয়র সিটিজেন বা জ্যেষ্ঠ নাগরিকদেরও। সঞ্চয়পত্রে যারা বিনিয়োগ করেন, তাদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ অবসরভোগী ও সিনিয়র সিটিজেন। এই শ্রেণির ব্যক্তিরাও আয়করের এই বৈষম্যে পড়বেন বলে বিশেষজ্ঞরা জানান। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঘোষিত বাজেটে করহারে যে পরিবর্তন আনা হয়েছে, সেখানে শুধু কৌশলে ঢালাওভাবে করদাতাদের কাছ থেকে বেশি কর আদায়ের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু কারা কর দেবেন, কোন শ্রেণি করের আওতায় পড়ছেন, সে বিষয়টি ভাবা হয়নি। শুধু যে অতীতের বিনিয়োগ থেকে কর নেওয়া হবে তা-ই নয়, করদাতার ভবিষ্যৎ আয়ের ওপরও উেস কর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। নতুন বাজেটে ভবিষ্য তহবিল বা প্রভিডেন্ট ফান্ডের মুনাফার ওপর ৫ শতাংশ উেস কর আরোপ করা হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে একজন করদাতার ভবিষ্যৎ আয়ের ওপরও আসলে কর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে মনে করছেন করদাতারা। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক চিফ ইকোনমিস্ট ও বিআইডিএসের সাবেক মহাপরিচালক এম কে মুজেরি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, অবসরভোগী, সিনিয়র সিটিজেনসহ অনেক স্বল্প সঞ্চয়ভোগী আছেন, যাদের পরিবার এ আয়ের ওপর নির্ভরশীল। নতুন বাজেটে কর প্রস্তাবের কারণে তাদের ওপর যে অতিরিক্ত করভার চেপেছে, সরকারের উচিত হবে সেটি কোনোভাবে সমন্বয় করে দেওয়া। যেহেতু এখনো বাজেট পাস হয়নি, তাই সে সুযোগ রয়েছে। এটি করা হলে বাজেটে সমতা বিধানের যে বক্তব্য দেওয়া হয়েছে সেটি রক্ষা হবে।

বাজেটে প্রস্তাবিত করের এই ফাঁকিজুকি নিয়ে সমালোচনা করেছে ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউনটেন্ট অব বাংলাদেশ (আইসিএবি)। বুধবার রাজধানীতে সংস্থাটির এক সেমিনারে বলা হয়, প্রস্তাবিত বাজেটে আয়করের বিষয়ে বেশ কিছু অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এগুলো বাস্তবায়ন হলে ফাঁকি বাড়বে। উদাহরণ টেনে এবার করদাতার বিনিয়োগের বিপরীতে আয়কর রেয়াতের সুবিধা কমানোর ইস্যুটি উল্লেখ করে বলা হয়, এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলে করদাতার বিগত আয়বছরের ওপর প্রয়োগ করা হবে। অথচ ওই সময়ের বিনিয়োগ সুবিধা বিবেচনায় করদাতারা বিনিয়োগ করেছেন। এখন অনেক প্রতিষ্ঠানে চাকরিজীবীদের কাছ থেকেও বাড়তি কর কেটে নেওয়া হবে। এটি সঠিক বিচার নয়।

মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এমসিসিআই) সাবেক প্রেসিডেন্ট আবদুল হাফিজ চৌধুরী এফসিএ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আয়কর অর্ডিন্যান্সে বলা আছে, কর প্রস্তাবের এক বছর আগে থেকে এটি কার্যকর হবে। এখন কর রেয়াত ও বিনিয়োগ সুবিধা কমানোর যে প্রস্তাবটি এবার বাজেটে এসেছে, এটি যৌক্তিক হতো, যদি এর সঙ্গে সমন্বয় রেখে করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানো হতো। যেহেতু সেটি হয়নি তাই বিনিয়োগ সুবিধা ও কর রেয়াত কমানোর কারণে করদাতাদের এক বছর আগের বিনিয়োগ থেকে যে অতিরিক্ত কর কেটে নেওয়া হবে, সেটি নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। এটি উচিত হয়নি। সরকারের উচিত হবে বাজেট পাসের আগে এ বিষয়টি যৌক্তিকীকরণ করা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর