শনিবার, ১৮ জুন, ২০১৬ ০০:০০ টা

সংখ্যালঘুরা হলো ঘরপোড়া গরু

জুলকার নাইন

সংখ্যালঘুরা হলো ঘরপোড়া গরু

রানা দাশগুপ্ত

বার বার নির্যাতনের শিকার সংখ্যালঘুদের বর্তমান পরিস্থিতিকে ঘরপোড়া গরুর সঙ্গে তুলনা করেছেন হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত। তিনি বলেন, সংখ্যালঘুরা হলো ঘরপোড়া গরু, সিঁদুরে মেঘ দেখলেই তারা ভয় পায়। গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি এ মন্তব্য করেন। নানান কারণে বর্তমানে সংখ্যালঘুদের মনে ভীতি ও শঙ্কা বাসা বেঁধেছে উল্লেখ করে এই নেতা বলেছেন, বড় পরিসরে সমন্বিত রাজনৈতিক ও নাগরিক উদ্যোগই পারে পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটাতে। মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত বলেন, এ দেশের সংখ্যালঘুরা পাকিস্তান আমলে রাষ্ট্রের বিমাতাসুলভ আচরণ পেয়েছে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে তারা নিজেদের ধ্বংসযজ্ঞ ও গণহত্যার শিকার হতে দেখেছে, ফলে বাধ্য হয়েছে দেশান্তরী হতে। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর তারা দেখেছে কীভাবে বাংলাদেশের সংবিধানকে ক্রমে সাম্প্রদায়িকীকরণ করা হলো। বাংলাদেশিরা একাত্তরে যে দ্বিজাতিতত্ত্ব প্রত্যাখ্যান করেছিল, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমে সেই দ্বিজাতিতত্ত্বকেই ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া দেখেছে সংখ্যালঘুরা। সংবিধানের এই সাম্প্রদায়িকীকরণের মাধ্যমে ধর্মনিরপক্ষ গণতান্ত্রিক বাংলাদেশকে তার প্রকৃত চরিত্র থেকে অনেক দূরে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। পাকিস্তানের সঙ্গে মিল করে রাষ্ট্রধর্মের অংশ সংবিধানে যুক্ত করা হয়েছে। ফলে সংখ্যালঘুদের অধিকারের দৃষ্টিকোণ থেকে একধরনের বড় সাংবিধানিক সংকট তৈরি হয়েছে। অন্যদিকে, আজকের ক্ষমতাসীন দল বিশেষত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংখ্যালঘুদের প্রতি আন্তরিক ও যথেষ্ট সদিচ্ছা পোষণ করেন। কিন্তু এখন রাষ্ট্রক্ষমতার বাইরে থাকা দল যারা আগে রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল তারা বিভিন্ন সময় সংখ্যালঘুদের নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা চালিয়েছে। তারা ২০১২ থেকে ২০১৪ সালে সংখ্যালঘুপ্রধান এলাকাগুলোয় একের পর হামলা ও লুটপাট চালিয়েছে। এরপর ২০১৪ সাল থেকে একের পর এক চলতে থাকা টার্গেট কিলিংয়ে আনুপাতিক হারে সংখ্যালঘুরাই বেশি হত্যার শিকার হয়েছেন। এখন পর্যন্ত ৫৩ জনের মতো টার্গেট কিলিংয়ের শিকার হয়েছেন, এর মধ্যে ৪০ জনের বেশিই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। লক্ষণীয় বিষয় হলো, টার্গেটের সাবজেক্ট ম্যাটার হলেন পুরোহিত, যাজক ও অন্য ধর্মগুরুরা। সর্বশেষ ঢাকার রামকৃষ্ণ মিশনের মহারাজকে আইএসের নামে চিঠি দিয়ে ধর্ম প্রচার থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে। এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সংগত কারণেই সংখ্যালঘুদের মনে আশঙ্কা, উদ্বেগ বেড়েছে এবং নিরাপত্তাহীনতাবোধ প্রবল হয়েছে। এ নিরাপত্তাহীনতাবোধের আরেকটি কারণ হলো, যারা হামলা করছে তারা চিহ্নিত হওয়ার পরও দায়মুক্তি ভোগ করছে। এ পর্যন্ত হাজার হাজার সংখ্যালঘু নির্যাতন বা হামলার ঘটনা ঘটলেও এখন পর্যন্ত মাত্র দুটি ঘটনা ছাড়া আর কোনোটির বিচার ও শাস্তি হয়নি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই হামলাকারীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকছে। ফলে নিরাপত্তাহীনতাবোধ বেড়ে যাচ্ছে।

রানা দাশগুপ্ত বলেন, ষাটের দশকে আইয়ুববিরোধী আন্দোলন যখন চলছিল তখন সেই আন্দোলন ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকেই সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছিল। তখনকার জননেতা আতাউর রহমান খান ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ রাজনৈতিক ও সুশীলসমাজের প্রতিনিধিরা প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। নব্বইয়ের পর বিশেষত ২০০১ সালে রাজনৈতিক ও সুশীলসমাজের প্রতিনিধিরা নির্যাতনের শিকার সংখ্যালঘুদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। কিন্তু আজকের বাস্তবতায় সেভাবে কাউকে নির্যাতিতদের পাশে পাওয়া যাচ্ছে না, প্রশাসনও দায়সারা আচরণ করছে। অবশ্য অতিসম্প্রতি ১৪ দলের সভা থেকে আগামী ১৯ জুন সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিরুদ্ধে সারা দেশে মানববন্ধন কর্মসূচি দেওয়া হয়েছে এবং তিন মন্ত্রী নির্যাতনের শিকার অসহায় মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। আমরা মনে করি, এ ধরনের রাজনৈতিক উদ্যোগ আরও ব্যাপকভাবে নিয়ে গোটা বাংলাদেশে ছড়িয়ে দিলে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বর্তমান আশাহীনতা ও শঙ্কা দূর করে আবারও তাদের মনের মধ্যে শান্তি ফিরিয়ে আনা সম্ভব।

রানা দাশগুপ্ত বলেন, সংখ্যালঘুদের অস্তিত্ব রক্ষা, সমঅধিকার ও সমমর্যাদা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গত বছরের ৪ ডিসেম্বর ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে লাখো নাগরিকের উপস্থিতিতে সাত দফা দাবি উপস্থাপন করা হয়। এ সাত দফা দাবির বিষয়ে মাসখানেক আগে ঢাকার সিরডাপ মিলনায়তনে এক জাতীয় সংলাপ করা হয়েছে। সংলাপে রাজনৈতিক নেতা ও সুশীলসমাজের প্রতিনিধিরা একবাক্যে বলেছেন, সংখ্যালঘুদের সমস্যাকে শুধু তাদের সমস্যা হিসেবে দেখলে হবে না, একে জাতীয় সমস্যা হিসেবে দেখতে হবে। এরপর এ সাত দফা বাস্তবায়নের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি দেওয়া হয়েছে। মূলত সাত দফা বাস্তবায়নের আন্দোলন দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত গণতান্ত্রিকভাবে আমরা চালিয়ে যাব। সম্প্রতি নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে সাক্ষাৎ ও পরবর্তী বিতর্ক সম্পর্কে রানা দাশগুপ্ত বলেন, প্রতিবেশী দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এখানকার সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তাবোধ নিয়ে জানতে আমাদের ডেকেছিলেন। আমরা আমাদের পরিস্থিতির কথা তাকে জানিয়েছি। আমরা সমন্বিত রাজনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেছি। কিন্তু মোদির হস্তক্ষেপ কামনার কথা ভারতের পিটিআই যেভাবে প্রকাশ করেছে, তা সম্পূর্ণ বাস্তবতাবিবর্জিত। আমরা কোনোভাবেই তার হস্তক্ষেপের কথা বলিনি। পিটিআইর যে সাংবাদিক আমাদের সঙ্গে কথা বলেছেন, তিনি লেখার সময় কোনো কারণে এ ধরনের বাক্য ব্যবহার করেছেন। পিটিআইর প্রতিবেদন প্রকাশের পরপরই আমরা ঢাকায় নিজেদের অবস্থান ব্যাখ্যা করেছি। ফলে নরেন্দ্র মোদির হস্তক্ষেপ চাওয়ার প্রসঙ্গ সম্পূর্ণ অবান্তর।

সর্বশেষ খবর