বৃহস্পতিবার, ২৩ জুন, ২০১৬ ০০:০০ টা

হঠাৎ চিনির বাজারে অস্থিরতা

অভিযোগের তীর সিটি গ্রুপের দিকে

নিজস্ব প্রতিবেদক

হঠাৎ চিনির বাজারে অস্থিরতা

পবিত্র রমজানকে পুুঁজি করে সংঘবদ্ধ ব্যবসায়ী চক্র চিনির বাজার অস্থির করে তুলেছে। রোজাদারদের জিম্মি করে তারা ব্যবসা করছে। নানা অজুহাতে দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে। ওভারহোলিংয়ের নামে মিল বন্ধ রাখা, মিলগেটে দিনের পর দিন ট্রাক দাঁড় করিয়ে রাখা, শুল্ক বৃদ্ধি, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়ে যাওয়ার মতো অজুহাতের শেষ নেই তাদের। প্রায় প্রতিবছরই এমন ঘটনা ঘটে কিন্তু দৃষ্টান্তমূলক কোনো শাস্তি এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবসায়ীকে দেওয়া হয়নি। বরাবরের মতো এবারও কারসাজির বিরুদ্ধে সরকার ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করছে। কিন্তু কোনো কিছুই কানে তুলছে না ব্যবসায়ী চক্রটি। বরং এ চক্রটির কারণে রোজায় বাড়ছে ক্রেতাদের দুর্গতি। বাংলাদেশে চিনি মিলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় সিটি গ্রুপের মিল। তারাই চিনির বাজার নিয়ন্ত্রণে বড় ভূমিকা রাখে। এ গ্রুপটির দেখানো পথেই হাঁটেন অন্য মিলমালিকরা। আর সময়মতো চিনি সরবরাহ না করার বেশি অভিযোগও সিটি গ্রুপের বিরুদ্ধেই। এবার রোজার কয়েক দিন আগেও খুচরা দোকানে চিনি বিক্রি হতো প্রতি কেজি ৫২ থেকে ৫৪ টাকায়। সেই একই চিনির দাম এখন দোকানগুলোতে ৬৫ টাকা। সরকারি বিক্রয় সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবমতে, ২৪ মে ঢাকায় প্রতি কেজি চিনির খুচরা দর ছিল ৫৬ টাকা। ২৯ মে রোজা শুরুর সপ্তাহখানেক আগে হঠাৎ তা বেড়ে হয় ৬০ টাকা। আর ১৯ জুন থেকে গতকাল বুধবার পর্যন্ত খুচরা বাজারে চিনির দর আরও বেড়ে ৬২ থেকে ৬৫ টাকায় উঠেছে। খুচরা দোকানিরা বলছেন, পাইকারি বাজার থেকে প্রতি কেজি চিনি কিনতে তাদের ৬২ টাকা পড়ছে। পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন মিল থেকে চিনির সরবরাহে ঘাটতির কথা। মিল থেকে এক ট্রাক চিনি আনতে তাদের ক্ষেত্রবিশেষে কয়েকটি ট্রাকের ভাড়া গুনতে হয়। কারণ দিনের পর দিন বসে থেকেও চিনি পাওয়া যায় না। ঢাকায় ভোগ্যপণ্যের বৃহত্তম পাইকারি আড়ত মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক গোলাম মাওলা বলেন, ‘১০ ট্রাক চিনি চাইলে পাওয়া যায় দুই ট্রাক। তাও অপেক্ষা করতে হয় দিনের পর দিন। মিলগেটে ট্রাক দাঁড়িয়ে থাকে লম্বা লাইনে। মিল থেকে চিনি না পেলে আমরা বাজারে দেব কীভাবে!’

দামের বিষয়ে গোলাম মাওলা বলেন, মিলগেটেই চিনির দাম পড়ে ৫০ টাকা কেজি। এর সঙ্গে যুক্ত হয় পরিবহন খরচ। সরবরাহে দেরির জন্যও খরচ বাড়ে তাদের। ট্রাক বসিয়ে রেখে প্রতিদিন গুনতে হয় বাড়তি ভাড়া। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, দেশে চিনির কোনো সংকট নেই। চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (এপ্রিল পর্যন্ত) দেশে মোট চিনি আমদানি হয়েছে সাড়ে ১৭ লাখ টন। এ ছাড়া সরকারি মিলগুলোয়ও রয়েছে এক লাখ টন চিনি। আর পুরো বছরে চিনির চাহিদা মাত্র ১৫ লাখ টন। বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, দেশীয় চিনিশিল্প রক্ষায় সরকার আমদানি শুল্ক বাড়িয়েছিল। তবে এর পরও চিনির কেজি ৬০ টাকার নিচে থাকার কথা। আকস্মিকভাবে কেউ কেউ কারসাজি করে দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। তারা ধরাও পড়ছে। মিলগুলো ৪৮ টাকা কেজিতে চিনি বিক্রি করে। পাইকাররা কেজিতে দু-তিন টাকা ব্যবসা করলে, খুচরা বিক্রেতা পাঁচ টাকা লাভ করলে, প্রতি কেজির দাম ৫৭-৫৮ টাকার বেশি হওয়া উচিত নয়। কেউ কারসাজি করে দাম বাড়ালে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি দেন তিনি। ঢাকার চেয়ে চট্টগ্রামে বেশি দামে চিনি বিক্রি করার অভিযোগ উঠেছে সিটি গ্রুপসহ দুটি মিলের বিরুদ্ধে। ঢাকায় পাইকারি বাজারে সিটি গ্রুপ ৪৮ টাকা ৭৬ পয়সা কেজি দরে চিনি বিক্রি করলেও চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের পাইকারি মার্কেটে চিনির দর নিচ্ছে সবচেয়ে বেশি। গতকাল খাতুনগঞ্জে সিটি গ্রুপ প্রতি মণ চিনি বিক্রি করেছে দুই হাজার ১৩০ টাকায়। অন্য গ্রুপগুলো প্রতি মণ চিনি বিক্রি করেছে এক হাজার ৮৫২ টাকা থেকে দুই হাজার ১০০ টাকায়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সিটি গ্রুপ চিনির বাজার নিয়ন্ত্রণে বড় ভূমিকা রাখে। তাদের দেখানো পথেই হাঁটেন অন্য মিলমালিকরা। সময়মতো চিনি সরবরাহ না করার বেশি অভিযোগও তাদের বিরুদ্ধে। তবে এ অভিযোগ সম্পূর্ণ ভুয়া বলে উড়িয়ে দেন সিটি গ্রুপের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) বিশ্বজিৎ সাহা। বাজারে অন্য গ্রুপের চিনির চেয়ে সিটি গ্রুপের চিনির দর বেশি হওয়ার কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমরা কারখানা থেকে ৪৮ টাকা ৭৬ পয়সা কেজি দরে চিনি বিক্রি করছি। চট্টগ্রামে কেন এত বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে তা জানি না। প্রতিদিন আমরা দুই হাজার ৮০০ থেকে তিন হাজার টন চিনি সরবরাহ করছি। একটি ট্রাকে ১০ টন চিনি সরবরাহ করলে প্রতিদিন ৩০০ ট্রাক লাগে। আর চিনির জন্য এসে পাইকারি ব্যবসায়ীদের যদি ১০ দিন করে অপেক্ষা করতে হয়, তাহলে এত ট্রাক কোথায় অপেক্ষা করে?’ এ ছাড়া প্রতিদিন নিজস্ব ট্রাকে বিভিন্ন দোকানে ৫০ টাকা কেজি দরে ৯০০ টন থেকে এক হাজার টন চিনি সিটি গ্রুপ সরবরাহ করছে বলে তিনি জানান। গত বছর আগস্টে চিনি আমদানির ওপর ২০ শতাংশ সংরক্ষণমূলক শুল্ক আরোপ করে সরকার। এ ছাড়া গত ডিসেম্বরে চিনি আমদানির ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। এত আগে আরোপিত শুল্ককরের কারণে রমজান মাসে চিনির দর বৃদ্ধির কারণ সম্পর্কে বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, ‘নতুন করে শুল্ককর আরোপের আগে আমদানি করা চিনি রোজার আগ পর্যন্ত আমরা সরবরাহ করেছি। ফলে তখন দাম কম ছিল। রোজার সময় থেকেই বর্ধিত ট্যারিফে আমদানি করা চিনি বিক্রি শুরু হয়েছে। ফলে দাম কিছুটা বেড়েছে।’ এস আলম গ্রুপের চিনির একমাত্র বিক্রয় প্রতিনিধি মীর গ্রুপের কর্ণধার আবদুস সালাম বলেন, ‘ভ্রাম্যমাণ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী ৮ জুন থেকে আমরা ৫০ টাকা কেজি দরে পাইকারি বাজারে চিনি বিক্রি করছি। কিন্তু ঢাকার কারখানাগুলো (বিশেষ করে সিটি গ্রুপ) বিক্রি করছে এর চেয়েও অনেক বেশি দামে। ফলে চট্টগ্রামের চিনি ঢাকায় চলে যাচ্ছে।’ তবে প্রতিবছর রোজায় চিনির মূল্য অস্বাভাবিক বৃদ্ধির পরও দোষী মিলমালিকদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার নজির নেই সরকারের। মোহাম্মদ ফারুক খান বাণিজ্যমন্ত্রী থাকাকালে রোজায় চিনির দাম আকাশ ছুঁয়েছিল। ওই সময়ও সিটি গ্রুপসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান মিল বন্ধ রেখেছিল ওভারহোলিংয়ের নাম করে। তখন মিলমালিকদের শোকজ করা হলেও শুধু একটি চিনিমিলের আমদানি লাইসেন্স স্থগিত করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এ বছরও রোজার শুরুতে সিটি গ্রুপসহ আরও কয়েকটি মিলমালিক ওভারহোলিংয়ের নাম করে উৎপাদন বন্ধ রেখে বাজারে সরবরাহ সংকট সৃষ্টি করে। তবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ ও পূর্বাভাস সেলের প্রধান মাসুদুল মান্নান বলেন, দর নিয়ন্ত্রণে এবার সরকারি মিলের গুদামে থাকা এক লাখ টন চিনি বাজারে ছাড়ার উদ্যোগ নিচ্ছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশনের প্রতি কেজি চিনির দর ৪৮ টাকা। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ভাবছে, এখনই ওই চিনি বিক্রির উপযুক্ত সময়। এতে বেসরকারি মিলমালিকরা চাপে পড়ে সরবরাহ বাড়াবেন। ভোক্তারাও এর সুফল পাবেন। এ বিষয়ে শিগগিরই সিদ্ধান্ত হবে।

সর্বশেষ খবর