রবিবার, ২৬ জুন, ২০১৬ ০০:০০ টা

যুক্তরাজ্যে ভাঙনের সুর

দ্রুত সরে যেতে বলল ইইউ, আবার গণভোট দাবি

কূটনৈতিক প্রতিবেদক

গণভোটে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে ব্রিটেনের বিচ্ছেদের সিদ্ধান্তের পর প্রকট হয়েছে যুক্তরাজ্যের বিভক্তি। যুক্তরাজ্যের চার অঙ্গরাজ্যের অন্যতম স্কটল্যান্ড ও উত্তর আয়ারল্যান্ড বেরিয়ে যেতে পারে যুক্তরাজ্য থেকে। ইতিমধ্যে স্কটল্যান্ডের ফার্স্ট মিনিস্টার নিকোলা স্টারজিওন স্বাধীনতার পক্ষে ফের গণভোট আয়োজনের ইঙ্গিত দিয়েছেন। ফের শঙ্কা দেখা দিয়েছে উত্তর আয়ারল্যান্ডের সশস্ত্র সংগ্রামের। গণভোটে অঙ্গরাজ্যগুলোর মধ্যে ইংল্যান্ডের বেশির ভাগ ও ওয়েলস ইইউ ছাড়ার পক্ষে এবং রাজধানী লন্ডন, স্কটল্যান্ড ও উত্তর আয়ারল্যান্ড ইইউতে থাকার পক্ষে রায় দেয়। অন্যদিকে ব্রিটেনের ইইউ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে নড়েচড়ে বসেছে ইউরোপ। ইইউর ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনার জন্য জোটের প্রতিষ্ঠাকালীন ছয় দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা গতকাল করেছেন জরুরি বৈঠক। বৈঠকে আমন্ত্রণ পায়নি ব্রিটেন। ইউরোপীয় কমিশনের প্রধান জ্যঁ ক্লদ-ইয়ুঙ্কার ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে দ্রুত বিচ্ছেদ প্রক্রিয়া শুরুর আহ্বান জানিয়েছেন।

বিবিসির খবরে বলা হয়, আগেই ধারণা করা হয়েছিল গণভোটে লড়াই হবে হাড্ডাহাড্ডি। ভোটে তার প্রতিফলনই ঘটেছে। পুরো যুক্তরাজ্যের উত্তরাংশ ইইউতে থাকার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। বিপরীতে দেশের দক্ষিণের প্রায় পুরো অংশ এ জোট ছাড়ার পক্ষে। ইংল্যান্ড ও ওয়েলসে বিচ্ছেদপন্থিরা জয়ী হলেও স্কটল্যান্ড ও উত্তর আয়ারল্যান্ডে দেখা গেছে উল্টো চিত্র। তবে সবখানেই ব্যবধান ছিল খুব কম। ইংল্যান্ডে ১ কোটি ৫২ লাখ মানুষ ইইউ ছাড়ার পক্ষে রায় দিয়েছেন। বিপরীতে থাকার পক্ষে ভোট পড়েছে ১ কোটি ৩৩ লাখ। এখানে ভোটের হার ৭৩ শতাংশ। ওয়েলসে ৭২ শতাংশ ভোটের মধ্যে ইইউ ছাড়ার পক্ষে সাড়ে ৮ লাখ, থাকার পক্ষে পৌনে ৮ লাখ ভোট পড়েছে। স্কটল্যান্ডে থাকার পক্ষে ভোট দিয়েছেন সাড়ে ১৬ লাখ, ছাড়ার পক্ষে ১০ লাখ। এখানে ভোটের হার ৬৭ শতাংশ। একইভাবে উত্তর আয়ারল্যান্ডের সাড়ে ৪ লাখ ভোটার ইইউতে থাকার পক্ষে ভোট দিয়েছেন। সাড়ে ৩ লাখ ভোট দিয়েছেন ছাড়ার পক্ষে। এখানে ৬৩ শতাংশ ভোটার ভোট দিয়েছেন। রাজধানী লন্ডনে ৬০ শতাংশ ভোট পড়েছে থাকার পক্ষে, বাকি ৪০ শতাংশ বিপক্ষে। ভোটচিত্রের এ বৈপরীত্যে শঙ্কা তৈরি হয়েছে যুক্তরাজ্যের অখণ্ডতা নিয়ে। স্কটল্যান্ড দুই বছর আগে স্বাধীনতার প্রশ্নে গণভোটের আয়োজন করেছিল। তা কোনোমতে উতরে গেলেও এবার স্বাধীনতাপন্থিদের অবস্থান আরও জোরালো হয়েছে। স্কটল্যান্ডের ফার্স্ট মিনিস্টার নিকোলা স্টারজিওন বলেছেন, স্কটিশরা ইইউতেই তাদের ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছে। স্বাধীনতার প্রশ্নে ফের গণভোটের বিষয়টিও বিবেচনায় রয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন তিনি। উত্তর আয়ারল্যান্ডের সবচেয়ে বড় জাতীয়তাবাদী দল শিনফেন বলেছে, আইরিশ প্রজাতন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার প্রশ্নে গণভোট করার পক্ষে এখন তাদের শক্ত যুক্তি রয়েছে। যুক্তরাজ্যকে দ্রুত সংগঠন ছেড়ে যাওয়ার আলোচনা শুরুর আহ্বান জানিয়েছে ইইউ। ইউরোপীয় কমিশনের প্রধান জ্যঁ ক্লদ-ইয়ুঙ্কার অবশ্য ক্যামেনের এমন সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে। তিনি চান যত দ্রুত সম্ভব ইইউ ছাড়ার আলোচনা শুরু করুক যুক্তরাজ্য। জ্যঁ ক্লদ-ইয়ুঙ্কার বলেন, গত দিন তারা (যুক্তরাজ্য) সংগঠন ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অক্টোবর পর্যন্ত আলোচনা শুরুর জন্য বসে থাকা অর্থহীন।

একই সময়ে ইইউর প্রতিষ্ঠাকালীন ছয় দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের জরুরি বৈঠক থেকেও ব্রিটেনকে দ্রুত ইইউ ছাড়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। গতকাল বার্লিনে জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি, বেলজিয়াম, লুক্সেমবার্গ ও নেদারল্যান্ডসের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠক শেষে আহ্বান জানানো হয়েছে ইইউর সঙ্গে আলোচনা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সেরে ফেলার। বৈঠক শেষে জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফ্রাঙ্ক ভাল্টার স্টাইনমায়ার বলেছেন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এ প্রক্রিয়া শুরু করা উচিত। কারণ তাদের ইউরোপের ভবিষ্যতের দিকে মনোযোগ দিতে হবে। ফরাসি পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ব্রিটিশ জনগণ তাদের রায় জানিয়ে দিয়েছে। সে কারণে এ বিষয়ে ‘ইঁদুর বিড়াল খেলার’ কোনো প্রয়োজন নেই। তবে জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা মের্কেলের কথা একটু ভিন্নরকমের। এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছেন, এর জন্য বছরের পর বছর সময় নেওয়া উচিত নয়, এটা সত্য। আবার ব্রিটেনের জন্য অল্প কিছু সময় বেঁধে দেওয়ার পক্ষেও তিনি নন। এ পরিস্থিতিতেই ইইউর শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে আগামী বুধবার। সেখানে অবশ্য ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন উপস্থিত থাকবেন না।

স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতার আইনি প্রস্তুতি : স্কটল্যান্ডের মন্ত্রিপরিষদ ব্রিটেন থেকে আলাদা হওয়ার জন্য দ্বিতীয় এক গণভোটের আইনি প্রস্তুতি গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। স্কটল্যান্ডের মুখ্যমন্ত্রী নিকোলা স্টারজিওন বলেছেন, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে স্কটল্যান্ডের অবস্থানকে রক্ষা করার জন্য তিনি খুব শিগগিরই ব্রাসেলসের সঙ্গে আলোচনা শুরুর উদ্যোগ নেবেন। নিকোলা স্টারজিওন তার মন্ত্রিসভার সদস্যদের সঙ্গে এক বৈঠকের পর বলেছেন, ইইউ ছেড়ে যাওয়ার জন্য স্কটল্যান্ডকে জোর করা যাবে না। এখন ব্রিটিশ জনগণের নতুন সিদ্ধান্তের পর স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতার প্রশ্নে দ্বিতীয় আরেকটি গণভোট অনুষ্ঠিত হতে পারে কিনা, তা নিয়ে কথাবার্তা হচ্ছে। কারণ স্কটল্যান্ডের বেশির ভাগ মানুষই, ৬২ শতাংশ ভোটার, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে থেকে যাওয়ার পক্ষে ভোট দিয়েছেন।

স্বাধীন হতে চায় লন্ডনও : ইইউতে গণভোটে লন্ডনের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটার ‘রিমেইন’ পক্ষেই ভোট দিয়েছেন। তারা ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গেই থাকতে চান। সে কারণেই এবার খোদ যুক্তরাজ্য থেকেই বিচ্ছিন্নতার দাবি উঠেছে লন্ডনে। মেয়র সাদিক খানের কাছে জমা পড়েছে ১ লাখ মানুষের স্বাক্ষরিত এক দাবি। টেলিগ্রাফের খবরে বলা হয়েছে, লন্ডনের মেয়র সাদিক খানের বরাবর এই পিটিশন দাখিল করেছেন ভোটাররা। মেয়রকে তারা অনুরোধ করেছেন, তিনি যেন লন্ডনকে স্বাধীন রাষ্ট্র ঘোষণা করে ইইউতে থাকার সিদ্ধান্ত নেন। লেবার পার্টির হয়ে মেয়র নির্বাচিত সাদিক খান নিজে ইইউতে থাকার পক্ষে প্রচারে ছিলেন। আবেদনকারীরা বলছেন, ‘লন্ডন একটি আন্তর্জাতিক শহর। আমরা ইউরোপের প্রাণ হিসেবে থাকতে চাই।’ অনলাইনে এ আবেদনে স্বাক্ষর সংগ্রহ চলছে এবং সমর্থন দ্রুতই বাড়ছে।

আবার গণভোটের জন্য পিটিশন : ইইউ থেকে ব্রিটেনের বের হওয়া-না হওয়ার সিদ্ধান্তের বিষয়ে দ্বিতীয় গণভোটের জন্য এক আবেদনে ১০ লাখেরও বেশি স্বাক্ষর জমা পড়েছে দেশটির নাগরিকদের। গণভোটের এক দিনের মাথায় নতুন এই পিটিশন। এ আবেদনটি বিবেচনা করে দেখবে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট। কারণ কোনো পিটিশনে ১ লাখের বেশি স্বাক্ষর থাকলে পার্লামেন্টে সে বিষয়ে আলোচনা হয়। এ পিটিশনটির উদ্যোগ নিয়েছেন উইলিয়াম অলিভার হিলে। তিনি বলছেন, ‘আমরা যারা এখানে সই করেছি তারা সরকারের কাছে আবেদন করছি এমন একটি আইন করতে যে কোনো পক্ষে যদি ৬০ শতাংশের বেশি ভোট না পড়ে এবং মোট ভোট গ্রহণের হার যদি ৭৫ শতাংশের বেশি না হয় তাহলে আরেকটি গণভোট অনুষ্ঠিত হবে।’ তবে ১৯৯২ সালের পর থেকে কোনো সাধারণ নির্বাচনেই ৭৫ শতাংশের বেশি ভোপ পড়েনি। হাউস অব কমন্সের একজন মুখপাত্র বলেছেন, পিটিশনে সই করার ব্যাপারে বহু মানুষের আগ্রহের কারণে সরকারি এ সাইটটি আপাতত ভেঙে পড়েছে।

ব্রিটেন বিচ্ছেদে আইএসের উল্লাস : উল্লাসের মাধ্যমে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভাঙন উদযাপন করছে মধ্যপ্রাচ্যের জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক  স্টেট (আইএস)। ইউরোপের জোট  থেকে যুক্তরাজ্যের সরে যাওয়া যে  গোটা ইউরোপের অর্থনীতিতে প্রভাব  ফেলবে, তা নিয়েও উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছে এই জঙ্গি সংগঠন। এর পাশাপাশি জার্মানি এবং বেলজিয়ামে হামলার হুমকি দিয়েছে জঙ্গি সংগঠনটি। গতকাল সকালে এক ভিডিও বার্তায় এই বিবৃতি দেয় আইএস। এদিকে যুক্তরাজ্যের  গোয়েন্দা সূত্রের বরাত দিয়ে রয়টার্স জানায়, ইইউ এর ভাঙনের পর  গোটা ইউরোপকে ধ্বংস করে দিতে হামলা চালান হবে বলে হুমকি দিয়েছে আইএস। যুক্তরাজ্যকে নিয়ে আলোচনার এই সময়ে সমগ্র ইউরোপকে নিজেদের কব্জায় আনতে অনুসারীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে জঙ্গি সংগঠনটি। আইএসের প্রকাশিত এক ভিডিও বার্তার বরাত দিয়ে বিবিসি জানায়, গোটা ইউরোপ ধ্বংস করে দিতে অনুসারীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে জঙ্গি সংগঠনটি।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর