শুক্রবার, ১ জুলাই, ২০১৬ ০০:০০ টা
ঈদুল ফিতরে ৯ দিনের ছুটি

পথে পথে মৃত্যুফাঁদ

সাঈদুর রহমান রিমন

পথে পথে মৃত্যুফাঁদ

ঈদে বাড়ি ফেরা, যাতায়াতে দুর্ঘটনাসহ জানমাল ক্ষয়ক্ষতির আগাম শঙ্কা ভাবিয়ে তুলছে সবাইকে। সড়কপথে পদে পদে দুর্ঘটনার ফাঁদ। লক্কড়-ঝক্কড় বাস-মিনিবাস রংচঙে সাজিয়ে তৈরি হয়েছে জীবনঘাতী পরিবহন। নৌপথে রয়েছে ত্রুটিপূর্ণ নৌযান, সীমাহীন অবহেলা আর প্রতি পদে আইন ভঙ্গের প্রবণতা। অন্যদিকে রেলপথ আরও বেশি বিপজ্জনক। নিয়মিত রেললাইন পরিদর্শন ও রক্ষণাবেক্ষণ না করা, দক্ষ চালকের অভাব, লোকবল সংকট, উন্মুক্ত রেলক্রসিংয়ের কারণে অনিরাপদ যানবাহন হয়ে উঠেছে রেল।

প্রতিবছর দেশবাসী ঈদযাত্রায় উপর্যুপরি দুর্ঘটনা আর লাশের দীর্ঘ মিছিল দেখতে পান। আনন্দ উৎসব প্রতিবারই হয়ে ওঠে শোকের মাতম। কখনো সড়ক দুর্ঘটনা, কখনো লঞ্চডুবি, আবার কখনো রেল দুর্ঘটনায় বিপুল প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। নানা ত্রুটি-বিচ্যুতি, অদক্ষ চালকের অবজ্ঞা-অবহেলা, অত্যধিক যাত্রীবহনের মাত্রাতিরিক্ত বাণিজ্যিক প্রবণতা, সড়ক ও রেলপথ সংস্কারহীনতায় বারবারই হানা দেয় মৃত্যু। গত তিন বছরের ছয়টি ঈদযাত্রায় বিভিন্ন দুর্ঘটনায় চার শতাধিক লাশ গুনতে হয়েছে। বছর ঘুরে আবার এসেছে ঈদ আনন্দ। বাড়িমুখো হবেন লাখ লাখ যাত্রী। সড়ক, নৌ, রেলপথ কি যথাযথ নিরাপদ? তা নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্ন আর উদ্বেগ-আতঙ্ক দেখা দিয়েছে।

সড়ক দুর্ঘটনার ৯ কারণ : পিপিআরসি ও ব্র্যাক সড়ক দুর্ঘটনা বিষয়ে একটি যৌথ গবেষণায় সড়ক দুর্ঘটনার নয়টি কারণ চিহ্নিত করেছে। এগুলো হচ্ছে—বেপরোয়া গাড়ি চালানো, চালকের উপযুক্ত প্রশিক্ষণের অভাব, ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, বিভিন্ন গতির যানের একই সড়কে চলাচল, সড়কের ধারে ঝুঁকিপূর্ণ কর্মকাণ্ড, সড়কের নকশায় ত্রুটি, ট্রাফিক আইনের দুর্বল প্রয়োগ, সড়ক নিরাপত্তার বিষয়ে সচেতনতার অভাব ও পথচারীর ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ এবং দুর্ঘটনা ঘটিয়ে চালকদের পার পেয়ে যাওয়ার সংস্কৃতি ও অপ্রতুল শাস্তির বিধান। হাইওয়ে অ্যাক্ট অনুযায়ী মহাসড়কের উভয় পাশে ১০ মিটারের মধ্যে কোনো স্থায়ী অবকাঠামো থাকা যাবে না। ২০১২ সালে ইন্টারন্যাশনাল রোড অ্যাসেসমেন্ট প্রোগ্রামের আওতায় একটি টেকনিক্যাল রিপোর্ট তৈরি করে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। সেই প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশের ৯৬ শতাংশ মহাসড়ক দুই লেনের এবং সেগুলোতে কোনো সড়ক বিভাজন নেই। ৯৫ শতাংশ মোড়ে কোনো ধরনের সিগন্যালিং ব্যবস্থা নেই। এ ছাড়া ৯৮ শতাংশ সড়কে যানবাহনের গতিসীমা উল্লেখ থাকলেও গতি ব্যবস্থাপনা বা নিয়ন্ত্রণের কোনো ব্যবস্থা নেই।

আনফিট লঞ্চে স্পেশাল সার্ভিস : ঢাকা-বরিশাল, চাঁদপুর, পটুয়াখালীসহ বিভিন্ন রুটে যতগুলো লঞ্চ চলে, এবার এর চেয়েও বেশি স্পেশাল লঞ্চ চালুর উদ্যোগ নিচ্ছেন মালিকরা। এ নিয়ে রূপগঞ্জ, কেরানীগঞ্জসহ বিভিন্ন ডকইয়ার্ডে লঞ্চে রং করা ও মেরামতের কাজ শুরু হয়েছে। রাত-দিন খেটেখুটে এসব লঞ্চ প্রস্তুত করা হবে দক্ষিণবঙ্গের ঘরমুখী মানুষদের জন্য। কিন্তু ঈদের এই ঘরে ফেরা কতটা নিরাপদ হবে এ নিয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে। নৌ-সংরক্ষণ ও পরিচালন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া, নৌযানের মালিক কর্তৃক অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই করতে মাস্টারকে বাধ্য করা, ত্রুটিপূর্ণ নৌযান, আনাড়ি যাত্রীদের অসতর্কতা, পাইলটের ভুল (অনভিজ্ঞতা), নৌপথের নাব্যতা হ্রাস, দ্রুত নৌপথ পরিবর্তন ও অপর্যাপ্ত মার্কিংয়ের কারণে ২ হাজার ১২২টি নৌ-দুর্ঘটনা ঘটে। এসব দুর্ঘটনায় প্রায় ১ হাজার তদন্ত কমটি গঠিত হয়। কমিটি তদন্ত শেষে প্রতিবেদন দাখিল করে। আর এসব তদন্ত প্রতিবেদনে প্রায় ৩০০ সুপারিশে মামলা হয়েছে প্রায় ২০ হাজার। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনো মামলায় শাস্তি হয়নি। সুপারিশমালা অনুযায়ী নৌ-পথ সুরক্ষায় আজ পর্যন্ত কার্যকর পদক্ষেপও গ্রহণ করা হয়নি। অভিযোগ রয়েছে, নিয়ম-নীতি ছাড়াই মেঘনার ডেঞ্জার জোনসহ বিভিন্ন রুটের নৌযানগুলো যাত্রী নিয়ে বেপরোয়া চলাচল করে। যাত্রী পরিবহনকারী ছোট লঞ্চের মধ্যে অর্ধেকেই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মাস্টার, ড্রাইভার নেই। লঞ্চগুলো চালান খালাসি ও হেলপাররা। অদক্ষ মাস্টার-ড্রাইভার দিয়ে লঞ্চ চালাতে গিয়ে অধিকাংশ দুর্ঘটনা ঘটলেও কর্তৃপক্ষ নির্বিকার।

অবহেলা-অব্যবস্থাপনায় বিপজ্জনক রেল : রেল কর্তৃপক্ষের অবহেলা ও দুর্বল ব্যবস্থাপনার জন্যই শতকরা ৮০ ভাগ দুর্ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে ৬৩ ভাগই লাইনচ্যুতি আর ১৭ ভাগ লেভেল ক্রসিংজনিত। কখনো ঝুঁকিপূর্ণ সেতু ভেঙে নদীতে পড়ছে ট্রেন। আবার কখনো লাইনের নিচের মাটি সরে গিয়ে কাত হয়ে পড়ছে ইঞ্জিনসহ বগি। আবার লাইনের দুই পাশে বাজারসহ অবৈধ স্থাপনার কারণেও বাড়ছে দুর্ঘটনা। লেভেলক্রসিংগুলোতে দুর্ঘটনার চিত্র অনেক পুরনো। রেলওয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, অনুমোদনহীন লেভেলক্রসিং, রেল-সংশ্লিষ্টদের কর্তব্যে অবহেলা, বর্ষায় লাইনের নিচের মাটি সরে যাওয়া, ড্রাইভারদের ওভারটাইমের ক্লান্তি এবং লাইনের ত্রুটির কারণে এসব দুর্ঘটনা ঘটছে। ট্রেন দুর্ঘটনার ধরন প্রধানত লাইনচ্যুতি, লেভেলক্রসিং, ইঞ্জিন বিকল, সিগন্যাল অমান্য করা। ঘন ঘন ট্রেন লাইনচ্যুতির ফলে একদিকে হতাহতের ঘটনা বাড়ছে। এর প্রধান কারণ, রেলপথ পাহারা দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় ওয়েম্যান নেই কিংবা যারা আছেন তারা নিয়মিত দায়িত্ব পালন করছেন না। এদিকে ট্রেন দুর্ঘটনার জন্য রেলওয়ের গাফিলতিকে দায়ী করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের অভিযোগ, রুটিন চেকআপ ছাড়াই চলছে ট্রেন। ফলে প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা। এতে হারাতে হচ্ছে মূল্যবান জীবন। অথচ এর জন্য দায়ী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। ঈদে ঘরমুখো মানুষের নিরাপদ যাতায়াতে রেললাইন সার্বক্ষণিক মনিটরিং ও রক্ষণাবেক্ষণের পরামর্শ দিয়েছেন তারা।

সর্বশেষ খবর