সোমবার, ৪ জুলাই, ২০১৬ ০০:০০ টা

মুত্তাকি কারা

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

মাহে রমজানে সিয়াম সাধনাকে ‘ফরজ’ বা অবশ্য পালনীয় করণের অন্যতম কারণগুলোর মধ্যে একটি হলো— ‘লায়াল্লাকুম তাত্তাকুন’ অর্থাৎ যেন (রোজা পালনের) মাধ্যমে তোমরা আল্লাহতায়ালাকে ভয় করে চলতে পার। বস্তুত আল্লাহর ভয়ভীতি অন্তরে জাগিয়ে তোলার প্রশিক্ষণ লাভ ঘটে রোজা পালনের মাধ্যমে। তাকওয়া বা আল্লাহভীতি    রোজাদারের হৃদয়পটে জাগ্রত হওয়ার কারণে সে হৃদয় এই কঠিন ফরজ পালন করতে প্রস্তুত হয়ে যায়। আবার এই তাকওয়াই গুনাহর কাজ করে রোজা নষ্ট করা থেকে রোজাদারের মনমানসিকতা ও অন্তরকে পাহারা দিয়ে রাখে। তাফসিরে ফি যিলালিল কোরআনে সাইয়েদ কুতুব শহীদ এ প্রসঙ্গে ব্যাখ্যায় বলছেন— ‘আর যাদেরকে কোরআন সম্বোধন করেছে (তারা মুমিন) আল্লাহতায়ালার কাছে তাকওয়ার মর্যাদা কত বেশি তা তারা ভালো করেই জানেন, আল্লাহর দাঁড়িপাল্লায় এই তাকওয়ার ওজনই ভারী। এই তাকওয়া অর্জনই রোজার আসল উদ্দেশ্য যার দিকে তাদের আত্মা ধাবিত হয়। আত্মার এই উৎকর্ষ সাধনের উপায়গুলোর মধ্যে রোজা একটি এবং এ লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার জন্য অন্যতম পথ।’ তাকওয়া বা আল্লাহভীতি মানুষের নাফসের লাগামছাড়া খায়েশকে প্রদমিত রাখার মাধ্যমে তাকে এমন এক প্রতীতি দান করে যার দ্বারা তার মধ্যে সুনীতির সৌন্দর্য প্রকাশ পায়। লাগামছাড়া খায়েশ বা চাহিদা হচ্ছে যে কোনো অন্যায়, বিদ্রোহাত্মক কাজ ও সীমালঙ্ঘনের অন্যতম মদদ দাতা। কোনো ব্যক্তি যে কোনো অন্যায় কাজে অগ্রসর হওয়ার পূর্বে তার অন্তরে এর জন্য প্রবল একটা চাহিদা সৃষ্টি হয়। কেউ অজ্ঞতা কিংবা অনিচ্ছায় অন্যায়ে ধাবিত হলে তাকে ফেরানো যায় কিন্তু জেনে বুঝে কেউ অন্যায়ের প্রতি ধাবিত হলে সেটা তার জন্য এমন এক বিপদ হয়ে দাঁড়ায় যে তা সংশোধন করা বড়ই কঠিন।

হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণিত এবং বুখারি ও মুসলিম শরিফে সংকলিত হাদিসে আছে রসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন— যে দিন আল্লাহপাকের রহমতের ছায়া ব্যতীত অন্য কোনো ছায়া থাকবে না সেদিন আল্লাহপাক সাত শ্রেণির লোককে তার রহমতের ছায়া দান করবেন— (১) ন্যায় বিচারক, (২) ওই যুবক যে যৌবন বয়সেই অল্লাহর ইবাদতে মশগুল হয়েছে, (৩) একবার নামাজ আদায় করে বের হয়ে পুনরায় নামাজের সময়ের অপেক্ষায় যে ব্যক্তির মন মসজিদের প্রতি থাকে—এমনকি সে পুনরায় মসজিদে গমন করে, (৪) সে দুই ব্যক্তি যারা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য একে অপরকে ভালোবাসে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য তারা বিচ্ছিন্ন হয় না, (৫) যে ব্যক্তি নির্জনে বসে আল্লাহর জিকির করে অতঃপর তার চক্ষুদ্বয় অশ্রুতে ভাসায়, (৬) সে ব্যক্তি যাকে কোনো সম্ভ্রান্ত পরিবারের রমনী আহ্বান করেছে, কিন্তু সে এ বলে বিরত থাকে যে, আমি আল্লাহকে ভয় করি, (৭) সে ব্যক্তি যে সাদাকা করে এবং সাদাকাকে এমনভাবে গোপন করে যে, ডান হাতে যা কিছু সাদাকা করেছে তা তার বাম হাত পর্যন্ত জানে না। আল্লাহতায়ালার ভয় নাফসের কঠিন খায়েশকে দমন করার জন্য এক মজবুত ঢাল বা বর্ম হিসেবে কাজ করে। আল্লাহভীতি ব্যতীত অন্য কোনো জিনিস কদাচিত মানুষকে তার নফসের বাঁধনছাড়া চাহিদাকে রুখতে পারে। আল কোরআনে ৭৯ সংখ্যক সূরা আন নাজিয়াত এর ৪০ ও ৪১ আয়াতে ইরশাদ হয়েছে— ‘যারা এ কথায় ইমান এনেছিল যে, একদিন নিজের মালিকের সামনে এসে তাদের দাঁড়াতে হবে এবং দাঁড়ানোর ভয়ে তারা ভীত ছিল (এবং সেই ভয়ের কারণে) যে ব্যক্তি নিজের প্রবৃত্তিকে যাবতীয় গর্হিত কার্যকলাপ থেকে বিরত রেখেছে। তার (অবশ্যম্ভাবী) ঠিকানা হবে জান্নাত।’ বস্তুত আল্লাহরাব্বুল আলামীন সৃষ্টি করেছেন নফসকে, আর তিনিই ভালো করে জানেন মনের এ ব্যাধিকে, এ ব্যাধি কোন গোপন পথে অনুপ্রবেশ করে এবং কীভাবে তাকে প্রতিরোধ করা যাবে সবই তিনি জানেন। তিনি জানেন এটা মানুষের এক স্বাভাবিক প্রবণতা, একে নির্মূল করা মানুষের সাধ্যের বাইরে। তবে তিনি নির্দেশ দিয়েছেন একে নিয়ন্ত্রণ করতে, দমন করতে, লাগাম কষতে, আল্লাহর ভয় মনের মধ্যে রেখে তার নিকট সাহায্য প্রার্থনা করতে। এ ভয় পয়দা হবে একদিন আল্লাহর দরবারে হাজির হতে হবে এই অনুভূতি থেকে। তার নির্দেশের জন্য তাকে নিজ নফসের বিরুদ্ধে ভীষণ সংগ্রামে নামতে হবে, রোজা পালন তার সে সংগ্রামের পাথেয় এবং প্রশিক্ষণ এবং এর বিনিময়ে সে চিরস্থায়ী জান্নাত পাবে।

লেখক : সরকারের সাবেক সচিব ও এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর