বুধবার, ১৩ জুলাই, ২০১৬ ০০:০০ টা

চোখ মোনাস নর্থ সাউথে

মির্জা মেহেদী তমাল ও সাইদুর রহমান রিমন

চোখ মোনাস নর্থ সাউথে

ঢাকার আইনশৃঙ্খলা প্রয়োগকারী সংস্থার চোখ এখন মালয়েশিয়ার মোনাস বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে। একই সঙ্গে ঢাকার নর্থ সাউথ, মানারাত ইন্টারন্যাশনাল, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়, স্কলাস্টিকা, সানিডেলসহ নামিদামি বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দিকে রয়েছে সন্দেহের তীর। তদন্ত করা হবে, কী করে নামিদামি এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো থেকে কিছু ছাত্র জঙ্গি হয়ে বেরোচ্ছে। এ ক্ষেত্রে কোনো শিক্ষকের সংশ্লিষ্টতা আছে কিনা তাও খতিয়ে দেখা হবে। বিশেষ করে নর্থ সাউথের সব শিক্ষকের বায়োডাটা নিয়ে কাজ করবে বিভিন্ন সংস্থা। সেখানকার মসজিদে নামাজের পর কোনো বয়ান ও মজলিস বসে কিনা, তাও দেখা হচ্ছে। সেই মজলিসে কারা বয়ান করেন, তাদেরও খোঁজ নেওয়া হবে।

সরকারি একটি সূত্র এসব তথ্য দিয়ে বলেছে, ঢাকার নির্দিষ্ট কয়েকটি নয়, সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রতি নজর রাখা হবে। একই সঙ্গে চট্টগ্রাম, রাজশাহী, সিলেট, বগুড়া, গাইবান্ধা, রংপুর, দিনাজপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, কক্সবাজারের প্রতিষ্ঠানগুলোর তত্পরতা নিয়ে খোঁজ নেওয়া হচ্ছে। এসব প্রতিষ্ঠানে বিশেষ কোনো ছাত্র-শিক্ষকের নামে রেমিট্যান্স আসে কিনা তা তদন্ত করা হবে। জঙ্গি তত্পরতা নিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে দেখানো হবে জিরো টলারেন্স। এদিকে নর্থ সাউথের কতিপয় ছাত্রের অবস্থান দেখে কর্তৃপক্ষ বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছে। একজন শিক্ষক বলেন, ‘নর্থ সাউথের ছাত্র-ছাত্রী চলাফেরায় প্রশ্নবিদ্ধ বলে এত দিন প্রচার ছিল। এখন ঠিক উল্টোটা শুনছি। ধারণা করা হচ্ছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই ছাত্রদের ব্রেন ওয়াশ করা হয়েছে। অথবা নামাজ পড়ার পর মজলিসের নামে ধীরে ধীরে তাদের বিপথগামী করা হয়েছে। বুঝে ওঠার আগেই ভয়ঙ্কর মরণনেশায় জড়িয়ে ধ্বংস করা হয়েছে সম্ভাবনাময় এই তরুণদের।’ গুলশান ও শোলাকিয়ায় জঙ্গি হামলার পর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে জঙ্গি বিষয়ে পাঠদানের বিষয়টি সামনে চলে আসে। গুলশানে নিহত পাঁচ জঙ্গির তিনজনই নামিদামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র। শোলাকিয়ায় নিহত জঙ্গিও ছিল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের। তাদের অধিকাংশই নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিল। নিখোঁজ নতুন ১০ জনের মধ্যে বাশারুজ্জামানও নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। সূত্র জানায়, গোয়েন্দারা নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও ৪০ জন ছাত্রের বিষয়ে খোঁজখবর নিচ্ছেন। যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশ কিছুদিন ধরে অনুপস্থিত রয়েছেন, গোয়েন্দাদের চোখ তাদের দিকেই বেশি। দেশের নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও মালয়েশিয়ার বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে, যেখানে বাংলাদেশি ছাত্ররা পড়ছেন। গোয়েন্দারা সন্দেহ করছেন, মালয়েশিয়ার মোনাস বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করা বাংলাদেশি ছাত্ররা উগ্রপন্থিদের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশি কতজন ছাত্র লেখাপড়া করছে, এর খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। গুলশানে নিহত পাঁচ জঙ্গির একজন নিবরাস সেখানেই লেখাপড়া করত। এ ছাড়া এই পাঁচজনই একাধিকবার মালয়েশিয়ায় গিয়েছে। যে ছয় মাস এরা নিখোঁজ ছিল, সেই সময়ে একাধিকবার তারা মালয়েশিয়া সফর করেছে বলে গোয়েন্দারা জানতে পেরেছেন। শোলাকিয়ায় নিহত আবীর বাসা থেকে বেরিয়ে গেছে তাকে মালয়েশিয়ায় পাঠানো হয়নি বলে।

মাদ্রাসা থেকে বিশ্ববিদ্যালয় : দেশের চিহ্নিত মাদ্রাসাগুলোতে জঙ্গিবাদের সূত্রপাত ঘটলেও এখন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো জঙ্গিদের আস্তানা হয়ে উঠেছে। এ দেশে সাধারণ শ্রেণির জঙ্গিরা পয়লা বৈশাখে রমনা বটমূলে বোমা হামলার নাশকতা দিয়ে জঙ্গিবাদ শুরু করেছিল। কিন্তু সময় বদলের সঙ্গে সঙ্গে অতি উচ্চবিত্ত, শিক্ষিত শ্রেণির মধ্যে জঙ্গিবাদের ভয়ঙ্কর প্রবণতা ছড়িয়ে পড়েছে। দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে টার্গেট করে সক্রিয় হয়ে ওঠে নিষিদ্ধ-ঘোষিত উগ্রপন্থি সংগঠনগুলো। সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, অকার্যকর মনিটরিং সেল, দুর্বল প্রশাসনিক কাঠামো, যথাযথ গোয়েন্দা নজরদারির অভাবসহ নানা কারণে জঙ্গি সংগঠনগুলো দিন দিন সক্রিয় হচ্ছে উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলোতে।

শহুরে শিক্ষিত পরিবার থেকে আসা আর স্বনামধন্য ইংরেজি মিডিয়াম স্কুল এবং বাংলাদেশের নামকরা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া টগবগে তরুণ ছেলেগুলো বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গিয়ে সবার অজান্তে জঙ্গি হয়ে উঠছে। প্রায়ই হিযবুত তাহ্রীর, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম ও অন্যান্য নিষিদ্ধ সংগঠনের সঙ্গে ছাত্রদের জড়িত থাকার অভিযোগে দেশের বিভিন্ন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম চলে আসে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চবিত্তদের ছেলেমেয়েরাই পড়ার সুযোগ পায়। এদের আর্থিক সংকট নেই বললেই চলে। বর্তমান সময়ের জঙ্গিবাদে অর্থ সবচেয়ে বড় নিয়ামক। উচ্চবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েরা বাবা-মায়ের প্রত্যক্ষ ‘টেইক কেয়ার’ থেকে বঞ্চিত থাকে। অনেক পরিবারেই বাবা-মা উভয়েই কর্মব্যস্ত থাকায় তাদের খোঁজ রাখা সম্ভব হয়ে ওঠে না। তাই বাবা-মায়ের চোখের আড়ালেই সন্তানের এমন কুকর্মে জড়িয়ে পড়া সম্ভব হয়। জানা যায়, উচ্চশিক্ষার ক্যাম্পাসগুলোতে সবচেয়ে বেশি সক্রিয় হিযবুত তাহ্রীর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষক অধ্যাপক মহিউদ্দিন আহমেদ ও অধ্যাপক গোলাম মাওলার হাত ধরে বাংলাদেশে এ সংগঠনের আত্মপ্রকাশ। ২০০০ সালের শুরুর দিকে ‘লিবারেটেড ইয়ুথ’-এর ব্যানারে কার্যক্রম শুরু হলেও ২০০৬ সালে ‘ছাত্রমুক্তি’ ও ‘আলোকিত ছাত্রী ফোরাম’ নামে আলাদা দুটি সংগঠনের মাধ্যমে ঢাবিতে যাত্রা করে হিযবুত তাহ্রীর। ২০০৯ সালের ২২ অক্টোবর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক হিযবুত তাহ্রীরকে জঙ্গি সংগঠন আখ্যা দিয়ে জননিরাপত্তার স্বার্থে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। কিন্তু এর পরও থেমে নেই সংগঠনটির কার্যক্রম। মাঝেমধ্যে ক্যাম্পাসের দেয়ালগুলোতে সাঁটানো হচ্ছে পোস্টার। বিলি করা হচ্ছে লিফলেট। সূত্র জানায়, বর্তমানে নিষিদ্ধ সংগঠন হিযবুত তাহ্রীরের শক্তিশালী আস্তানায় পরিণত হয়েছে বেসরকারি পর্যায়ের শীর্ষস্থানীয় নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়। এর পেছনে শক্তি হিসেবে কাজ করছেন বিশ্ববিদ্যালয়েরই শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন শিক্ষক-পরিচালনা পরিষদ কর্মকর্তা। ইতিপূর্বে র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার জঙ্গিকে জিজ্ঞাসাবাদে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির চারজন শিক্ষক নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হিযবুত তাহ্রীরের সঙ্গে জড়িত থাকার তথ্য ফাঁস হয়। শীর্ষস্থানীয় একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে হিযবুত তাহ্রীরের বীজ ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে।

গোয়েন্দা নজরদারিতে ৩৯ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান : গুলশান ও শোলাকিয়ায় ভয়াবহ জঙ্গি হামলার পর গোয়েন্দা নজরদারিতে এসেছে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষক ও ছাত্রদের গতিবিধি নজরদারিতে রাখতে সরকারের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে গোয়েন্দা সংস্থাকে। এর পরিপ্রেক্ষিতে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়সহ রাজধানীর ৩৯টি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গোয়েন্দা নজরদারিতে রয়েছে, এর মধ্যে মানারাত, ব্র্যাক, দারুল ইহসানসহ মোট ১৪টি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়, নয়টি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল-কলেজ এবং তিনটি বেসরকারি কলেজ রয়েছে। এর আগেও এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র-শিক্ষকদের জঙ্গি বা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষক, শিক্ষার্থী, ট্রাস্টি ও মালিকপক্ষের সম্ভাব্য নামসহ সন্দেহভাজনদের তালিকাও তৈরি করা হয়েছে। শিক্ষকদের পাশাপাশি ছাত্রদের গতিবিধিও নজরদারিতে রাখা হবে। ছাত্ররা কাদের সঙ্গে মিশছে, কোন কোন সংগঠনের সঙ্গে জড়িত, সংগঠনগুলোর কার্যক্রম কী তা খতিয়ে দেখবেন গোয়েন্দারা। এ ছাড়া ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষা কার্যক্রমের পাশাপাশি কী ধরনের কার্যক্রম পরিচালিত হয় তাও নজরে রাখা হবে। সূত্র জানায়, শুধু তা-ই নয়, কোন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিক কে, এদের অর্থের জোগানদাতা কারা, ট্রাস্টি বোর্ডে বা মালিকপক্ষ কারা কারা রয়েছেন, বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করছেন কারা, সেখানে শিক্ষক-কর্মকর্তারা কোন আদর্শের, কোথায় লেখাপড়া করেছেন ও তাদের রাজনৈতিক কোনো মতাদর্শ আছে কিনা এসব বিষয়ে বিস্তারিত খোঁজখবর নেওয়া শুরু হয়েছে।

উগ্রপন্থায় বহিষ্কৃতরা কোথায় : বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র ও শিক্ষকদের মধ্যে জঙ্গি তত্পরতা দেখা যাচ্ছে। বিশ্লেষকদের মতে, একশ্রেণির শিক্ষকের মাধ্যমে ছাত্রদের মধ্যে উগ্রপন্থা ছড়িয়ে পড়ছে। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উগ্রপন্থা কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে বহিষ্কৃত ছাত্র-শিক্ষকদের পরবর্তী কার্যক্রম মোটেও তদারকির আওতায় নেওয়া হয়নি। ফলে এসব শিক্ষক-ছাত্র বর্তমানে জঙ্গি কার্যক্রম পরিচালনা করছেন, তাদের ব্যাপারে গোয়েন্দাদের কাছে কোনো রকম তথ্য নেই বলে জানা গেছে।

তবে সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, কারও বিরুদ্ধে ঢালাও অভিযোগ নেই। কারণ জঙ্গি তত্পরতায় অংশগ্রহণকারীদের সংখ্যা এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে খুবই কম। তবু নাম এসে যাওয়ায় যাচাই করে দেখা হচ্ছে।

সর্বশেষ খবর