শনিবার, ১৬ জুলাই, ২০১৬ ০০:০০ টা

সর্বত্রই ক্লোন আতঙ্ক

ঝুঁকিতে ১৩ কোটি মোবাইল ফোন গ্রাহক স্বস্তিতে নেই ফেসবুক ব্যবহারকারীরা

মানিক মুনতাসির

সর্বত্রই ক্লোন আতঙ্ক

প্রযুক্তির আশীর্বাদে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে পৃথিবী। মানুষের দৈনন্দিন জীবন সহজ থেকে সহজতর হচ্ছে প্রযুক্তির কল্যাণে। আর প্রযুক্তির অপব্যবহারে পিছিয়ে নেই অপরাধীরাও। ব্যাংক গ্রাহকের ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড ক্লোন করে জালিয়াতির মাধ্যমে বিপুল অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনা বেশ পুরনো। আর মোবাইল নম্বর ক্লোন করে নিরপরাধ মানুষের মোবাইল সিম ব্যবহার করে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করাটাও হয়ে আসছে ধারাবাহিকভাবে। এখন শুরু হয়েছে সামাজিক যোগাযোগের অন্যতম প্লাটফরম ফেসবুক ব্যবহারকারীদের অ্যাকাউন্ট ক্লোন করে তাদের সম্পর্কিত তথ্য হাতিয়ে নেওয়া। একটি কুচক্রী মহল সমাজে অস্থিতিশীলতা তৈরি করতে এ ধরনের কাজ করছে বলে মনে সরকার। এর সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হয়েছে লিফট ক্লোনিং। এই জালিয়াতির মাধ্যমে নিম্নমানের লিফট তৈরি করে বিক্রি করা হচ্ছে। ফলে লিফট দুর্ঘটনা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়লেও অপব্যবহারকারীদের ধরার উপযুক্ত কৌশল এখনো আবিষ্কার হয়নি। শুধু তা-ই নয়, বিভিন্ন ধরনের ভাইরাস (ক্ষতিকর সফটওয়্যার) তৈরি করে তা ছড়িয়ে দিচ্ছে একটি চক্র, যার মাধ্যমে ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড নকল করা হচ্ছে। পাশাপাশি এটিএম (স্বয়ংক্রিয় উত্তোলন মেশিন) বুথে স্কিমিং মেশিন বসিয়ে অহরহ ক্লোন করা হচ্ছে ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ড। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, বিভিন্ন ব্যাংকের লক্ষাধিক ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারকারীর তথ্য চুরি হয়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির পর কয়েকটি ব্যাংকের সার্ভারে আড়ি পেতে গ্রাহকদের এসব তথ্য হাতিয়ে নিয়েছে হ্যাকার গ্রুপ। যে কোনো সময় তারা যে কোনো ধরনের জালিয়াতি করতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

ঝুঁকিতে ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারকারীরা : প্রযুক্তির কল্যাণে মানুষকে অত্যাধুনিক সুবিধা দিতে দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ড। ব্যাংকে গিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে চেক দিয়ে টাকা উত্তোলনের দিন শেষ হয়ে গেছে বহু আগেই। স্বয়ংক্রিয় উত্তোলন মেশিন (এটিএম) থেকে কার্ডের মাধ্যমে টাকা তোলা বা যে কোনো ধরনের কেনাকাটা করতে মানুষ এখন অভ্যস্ত। এ ছাড়া বিভিন্ন ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় মানুষ এখন শপিংয়ে গেলেও পকেটভর্তি নগদ টাকা নিয়ে যায় না। শুধু শপিং মলই নয়, হোটেল-রেস্টুরেন্টেও ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে বিল পরিশোধ করা হচ্ছে। কিন্তু বিভিন্ন ব্যাংকের বুথে স্কিমিং ডিভাইস বসিয়ে এবং সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর সার্ভারে আড়ি পেতে গ্রাহক সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য চুরি করে নিয়েছে হ্যাকার গ্রুপ। চলতি বছরের শুরুতে ক্লোন করা ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ড দিয়ে এটিএম বুথ থেকে অর্থ তুলে নেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। সে সময় অবশ্য অপরাধীরা ধরাও পড়েছে। কিন্তু তথ্যপ্রযুক্তিবিদরা বলছেন, এ ধরনের ঝুঁকি কিন্তু শেষ হয়ে যায়নি। যে কোনো সময় আরও এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে। কেননা ব্যাংকগুলোর নিম্নমানের এটিএম বুথ ব্যবহার, কিংবা অদক্ষ কর্মকর্তাদের কারণে গ্রাহকদের তথ্য চুরি করতে সক্ষম হচ্ছে হ্যাকাররা। ফলে প্রতিনিয়তই গ্রাহকের তথ্য চলে যাচ্ছে দুষ্কৃতকারীদের হাতে। এ জায়গা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে ব্যাংকগুলোর প্রয়োজন শক্তিশালী আইটি ব্যবস্থাপনা ও দক্ষ জনবল। সেই সঙ্গে প্রয়োজন গ্রাহকের সচেতনতা।

ঝুঁকিতে ১৩ কোটি মোবাইল ফোন গ্রাহক : রফিকুল ইসলাম (ছদ্মনাম) কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা। প্রায় ১০ বছর ধরে গ্রামীণফোনের (০১৭১১ সিরিজের) একটি নম্বর ব্যবহার করছেন। সম্প্রতি তিনি নিজের আঙুলের ছাপ দিয়ে বায়োমেট্রিক যাচাইও করেছেন। কিন্তু কথা বলার সময় হঠাৎ হঠাৎ ফোনে তৃতীয় কোনো পক্ষের উপস্থিতি টের পান। পরে যোগাযোগ করেন কাস্টমার কেয়ারে। সেখান থেকে তাকে জানানো হয়, তার নম্বরটিতে কোনো একটি পক্ষ আড়ি পাতছে। পরে জানা যায়, তার জাতীয় পরিচয়পত্রের কপি দিয়ে অন্য কেউ তার ওই নম্বরটি ক্লোন করে ব্যবহার করছেন। পরে অবশ্য ক্লোন করা ওই নম্ববরটি বন্ধ করে দিয়েছে গ্রামীণফোন কর্তৃপক্ষ। এ ধরনের ঘটনা একটি নয়। জানা গেছে, ফোন কোম্পানিগুলোর কাছে প্রতিদিন এমন অসংখ্য অভিযোগ জমা পড়ছে। গ্রাহকরা বলছেন, তাদের অনেকেরই জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার করে অন্য কেউ কেউ নম্বর নিবন্ধন করেছেন। তা দিয়ে ওই দুষ্কৃতকারীরা চাঁদাবাজি বা সন্ত্রাসমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে। এতে ঝুঁকির মুখে পড়ছেন সাধারণ গ্রাহকরা। অথচ তারা নিরুপায়। শুধু তা-ই নয়, সম্প্রতি এয়ারটেলের সিম ব্যবহারকারী এক ব্যক্তির মোবাইল নম্বর ক্লোন করে সেই নম্বর ব্যবহার করে চাঁদা দাবির ঘটনাও ঘটেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে এয়ারটেল কর্তৃপক্ষ সব গ্রাহককে খুদেবার্তা (এসএমএস) পাঠিয়ে সচেতন করছে। আবার এদিকে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনও (বিটিআরসি) গ্রাহকদের খুদেবার্তা পাঠিয়ে বলছে, গ্রাহক, আপনার নামে নিবন্ধিত অযাচিত সিম বা রিম বন্ধের জন্য কাস্টমার কেয়ারে যোগাযোগ করুন। বিটিআরসির ওয়েবসাইটের তথ্যমতে, মে ২০১৬ পর্যন্ত দেশে ১৩ কোটি মোবাইল গ্রাহক রয়েছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এদের কেউই নিরাপদ নন। যেহেতু বায়োমেট্রিক যাচাই করার পরও মোবাইল নম্বর নকল হচ্ছে, সেজন্য মোবাইল ব্যবহারকারী সবাই ঝুঁকির মুখ রয়েছেন।

স্বস্তিতে নেই ফেসবুক ব্যবহারকারীরা : আগে ই-মেইল আইডি হ্যাক করে প্রতারক চক্র বিভিন্ন জনের কাছে মেইল পাঠিয়ে অর্থ জালিয়াতির ঘটনা ঘটাত। অথচ ই-মেইলের ওই প্রকৃত ব্যবহারকারী টেরই পেতেন না। এখনো তা হচ্ছে। তবে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ফেসবুক আইটি হ্যাক করা। কিংবা ক্লোন করে সব ধরনের তথ্য কপি করা। হ্যাকাররা ক্ষতিকর ভাইরাসের মাধ্যমে ফেসবুক অ্যাকাউন্টে থাকা ব্যবহারকারীদের সব ধরনের তথ্য চুরি করছে। পরবর্তী সময়ে নানা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে তা ব্যবহার করছে তারা। এদিকে ফেসবুক ব্যবহারকারীদের সতর্ক করে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) পক্ষ থেকে আট দফা নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। এর মধ্যে ব্যক্তিগত মোবাইল নম্বর, নিজের সন্তানের ছবি শেয়ার করা থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে। কোথাও বেড়াতে গিয়ে চেকইন না দেওয়ারও নির্দেশনা দিয়েছে ডিএমপি। এ ছাড়া কয়েক দিন ধরে ফেসবুকে একটি পোস্ট বার বার শেয়ার হচ্ছে। তা হলো ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ক্লোনিং-সংক্রান্ত। সেখানে বলা হয়েছে, সব ফেসবুক ব্যবহারকারীর তথ্য ক্লোন করে নিয়েছে একটি কুচক্রী মহল। এ থেকে সবাইকে সাবধানও থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। ফলে অস্বস্তিতে রয়েছেন ফেসবুক ব্যবহারকারীরা। বিটিআরসির তথ্যমতে, মে ২০১৬ পর্যন্ত দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ছয় কোটি। এর মধ্যে একটা বিরাট অংশ ফেসবুকের সঙ্গে জড়িত, যারা প্রতিদিন তাদের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড ফেসবুকে শেয়ার করে থাকেন। এদের অনেকেই তাদের ব্যক্তিগত তথ্যও ফেসুবকে ব্যবহার করে থাকেন, যা নিজেদের নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ।

আতঙ্ক লিফট ক্লোনিংয়ে : দেশে লিফট দুর্ঘটনা এখন নতুন আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজধানীর ধোলাইখালেই তৈরি হচ্ছে ক্লোন লিফট। আবার আমদানিও করা হচ্ছে নিম্নমানের লিফট। অপেক্ষাকৃত নিম্নমানের যন্ত্রাংশ সংযোজন করার মাধ্যমে কম দামে লিফট তৈরির অর্ডার দেওয়া হচ্ছে বিদেশে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আমদানিকারকরা চীন থেকে লিফট সংগ্রহ করলেও তাতে লেখা থাকছে মেড ইন কোরিয়া, জার্মানি কিংবা ফ্রান্স। মেয়াদ থেকে শুরু করে যেসব স্পেসিফিকেশন দেওয়া হয়, এর সঙ্গে বাস্তবতার কোনো মিল থাকছে না। জানা গেছে, অনেক ক্ষেত্রে আমদানিকারকরা খুচরা যন্ত্রাংশ এনে চট্টগ্রাম, ঢাকার ধোলাইখাল ও মিরপুরে নিজস্ব মেরামত কারখানায় অদক্ষ কারিগরদের দিয়ে লিফট ফিটিং করাচ্ছেন। সরকারি-বেসরকারি ভবনে এসব লিফট বসিয়ে জীবনের নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। সম্প্রতি উত্তরায় একটি মার্কেটে লিফট ছিঁড়ে দুর্ঘটনায় পতিত হয়ে একটি পরিবারের প্রায় সব সদস্যই মারা গেছেন। এর মাত্র বছর দুয়েক আগে রাজধানীর নয়াপল্টনে একটি আবাসিক হোটেলের লিফট ছিঁড়ে একজন মারা যান। এ ছাড়া মাত্র কয়েক দিন আগে একটি বেসরকারি টেলিভিশন ভবনে দুজন মন্ত্রী ও এক সাংবাদিক আহত হয়েছেন লিফট দুর্ঘটনায়। পরে লিফট কেটে তাদের বের করা হয়। জানা গেছে, বাংলাদেশে লিফট নির্মাতা কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। তাই বহুতল ভবনে লিফটের চাহিদা মেটাতে আমদানি করা হয়। আর এ সুযোগে অসাধু ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ লিফট ক্লোন করছেন। প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী, যে প্রতিষ্ঠান কোনো ভবনে ফিটিং করে দেয়, তারাই রুটিনমাফিক লিফট পর্যবেক্ষণ ও প্রয়োজনীয় সংস্কার করে থাকে। কিন্তু এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের চরম দায়িত্বহীনতার কারণে বছরের পর বছর লিফটগুলোর কোনো খোঁজখবর নেওয়া হয় না। এতে রাজধানীতে হামেশাই লিফট দুর্ঘটনা ঘটে, যার ফল প্রাণহানি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, যে কোনো ফেসবুক অ্যাকাউন্টের ক্লোন হতে পারে। এটা দুষ্কৃতকারীরা করছে। এর মাধ্যমে ক্লোন অ্যাকাউন্ট থেকে ভুল বার্তা পৌঁছে দেওয়া সম্ভব। এজন্য সবাইকে সজাগ থাকতে হবে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় কাজ করে যাচ্ছে। এ ধরনের কাজ যারা করে তাদের নজরদারিতে রাখা হয়েছে। এ ছাড়া ফেসবুকের মাধ্যমে কেউ জঙ্গিবাদের উসকানি দিলে বা জঙ্গিবাদ উসকে দেয় এমন ছবিতে লাইক দিলে, কমেন্ট করলে বা আপলোড করলে তার বিরুদ্ধে আইসিটি আইনের ৫৭ ধারায় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এজন্য নিজেদের নিরাপত্তায় সবার সচেতন হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর