মঙ্গলবার, ১৯ জুলাই, ২০১৬ ০০:০০ টা

ঝুলছে শতাধিক জঙ্গি মামলা

মামলা হয় বিচার শেষ হয় না
জামিনে ছাড়া পেয়ে বহু আসামি পলাতক
সাক্ষী আসে না
তাই থমকে আছে বিচার
গোঁজামিলের জন্য বারবার সময় চায় রাষ্ট্র পক্ষ

নিজস্ব প্রতিবেদক

ঝুলছে শতাধিক জঙ্গি মামলা

ঘটনা-১ : দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরিসহ নিষিদ্ধ-ঘোষিত সংগঠন হিযবুত তাহ্রীরকে গতিশীল করার অপরাধে রাজধানীর শেরেবাংলানগর এলাকার গণভবনের আরসিডি-৩-এর বাসিন্দা এ কে এম ওয়ালিউল্যাহর ছেলে নাওয়াত আশেকিনকে আটক করে পুলিশ। পরে এ ঘটনায় গুলশান থানার তত্কালীন উপ-পরিদর্শক (এসআই) মোস্তাজিরুর রহমান বাদী হয়ে সন্ত্রাসবিরোধী আইন, ২০০৯-এর ৮/৯(১)/১৩ ধারায় মামলা করেন। মামলায় অভিযোগ করা হয়, রাজধানীর বনানী জামে মসজিদের সামনের গেটে ২০১০ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি মুসল্লিদের মধ্যে হিযবুত তাহ্রীর উলাইয়্যাহ বাংলাদেশ ব্যানারে সরকারবিরোধী লিফলেট বিতরণের সময় জনসাধারণের সহায়তায় আশেকিনকে আটক করা হয়। এ সময় তার কাছ থেকে সরকারবিরোধী বেশ কিছু লিফলেট উদ্ধার করা হয়। আশেকিন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের (২০০৯-এ পাস করেছেন) আইদিদ ও সানির মাধ্যমে এই হিযবুতের সঙ্গে জড়িত হয়েছেন। ২০০৮ সালে হিযবুত তাহ্রীর আয়োজিত ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউটে এক সেমিনারে রনির (স্বেচ্ছাসেবক) সঙ্গে তার পরিচয় হয়। ঘটনার আগের দিন রনি মোবাইল ফোনে আশেকিনকে জুমার নামাজের আগে এসে হিযবুত তাহ্রীরের ৬৬টি লিফলেট নিয়ে সংগঠনের প্রচারের নির্দেশ পালন করতে বলেন। পরে তদন্ত শেষে কেবল নাওয়াত আশেকিনকে আসামি করে আদালতে ২০১০ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি অভিযোগপত্র দাখিল করে পুলিশ। আশেকিন যাদের মাধ্যমে হিযবুত তাহ্রীরের কর্মকাণ্ডে জড়িয়েছেন সেই আইদিদ, সানি ও রনির নাম মামলার এজাহারে থাকলেও রহস্যজনক কারণে অভিযোগপত্রে তাদের অভিযুক্ত করেননি তদন্ত কর্মকর্তা। অভিযোগপত্রে তিন পুলিশ সদস্যসহ মোট পাঁচজনকে সাক্ষী করা হয়েছে। মামলাটি কয়েকটি আদালত ঘুরে বর্তমানে ঢাকার পরিবেশ আপিল আদালতে বিচারাধীন আছে। এ মামলায় তারিখের পরে তারিখ পার হয়ে গেলেও তিন পুলিশ সদস্যসহ পাঁচ সাক্ষীর মধ্যে একজনও আদালতে সাক্ষ্য দিতে হাজির হচ্ছেন না। এ সুযোগে মামলার একমাত্র আসামি আশেকিন অনেক আগেই জামিন পেয়েছেন। মামলা নম্বর মহানগর দায়রা-২৭১৪/১০। এ মামলায় বিচারক মশিউর রহমান চৌধুরী আগামী ৩১ জুলাই সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য পরবর্তী দিন ধার্য করেছেন।

ঘটনা-২ : জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনের রাস্তায় ২০১০ সালের ১৭ জুলাই নৈরাজ্য ও দেশে অরাজকতা সৃষ্টি করে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার উদ্দেশ্যে মিছিল করার সময় হিযবুত তাহ্রীরের তিন সক্রিয় সদস্যকে সরকারবিরোধী পাঁচটি ব্যানারসহ আটক করে পুলিশ। এরা হলেন গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলার ঘুনসি এলাকার মুন্সি মোহাম্মাদ আলীর ছেলে আলী আহসান, চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ উপজেলার চিলাচো এলাকার আবদুল মান্নানের ছেলে ফরহাদ হোসেন ও মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার খারাকান্দি এলাকার আবদুল বারীর ছেলে ফজলে হাদী। পরে এ ঘটনায় রাজধানীর শাহবাগ থানার এসআই মো. শফিকুল ইসলাম বাদী হয়ে মামলা করেন। মামলায় অভিযোগ করা হয়, হিযবুত তাহ্রীর ব্যবহৃত ব্যানারসহ মিছিল করে ৪০ থেকে ৫০ জনের একটি দল কদম ফোয়ারা থেকে জাতীয় প্রেসক্লাবের দিকে মিছিলসহকারে আসতে থাকে। তখন সঙ্গীয় ফোর্সদের সহায়তায় আসামিদের গ্রেফতার করা হয়। অন্য আসামিরা দৌড়ে পালিয়ে যায়। পরে এ ঘটনায় তদন্ত করে ২০১০ সালের ৮ সেপ্টেম্বর তিনজনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা। এরই মধ্যে বিচার শুরুর আগেই মামলার তিন আসামি জামিন লাভ করেন।

ঘটনা-৩ : সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার অভিযোগে হিযবুত তাহ্রীরের সক্রিয় সদস্য আহম্মেদ রিয়াসাত হাসানকে সরকারবিরোধী ১৫০টি লিফলেটসহ রাজধানীর রামপুরার ওয়াপদা রোডের ডিআইটি এলাকা থেকে আটক করে পুলিশ। পরে খিলগাঁও থানার এসআই সুভাষচন্দ্র সরকার বাদী হয়ে মামলা করেন। এ মামলার আসামি রিয়াসাত জামিন নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে পলাতক। এ তো গেল মাত্র তিনটি উদাহরণ। এ ছাড়া ঢাকার বিভিন্ন আদালতে জঙ্গি সংগঠনের সদস্যদের বিরুদ্ধে করা সন্ত্রাসবিরোধী আইনের শতাধিক মামলা বছরের পর বছর ঘুরপাক খাচ্ছে। তারিখের পর তারিখ পার হলেও সাক্ষী আসে না আদালতে। সংশ্লিষ্টদের অসহযোগিতা ও সাক্ষী অনুপস্থিতির কারণে জঙ্গি-সংশ্লিষ্ট মামলা নিষ্পত্তি হওয়ার লক্ষণ প্রায় নেই বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন আইন বিশেষজ্ঞরা। তবে আইনজীবীরা জানান, সাক্ষী আদালতে হাজির না হওয়ার অপরাধে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান থাকলেও এ ব্যাপারে আদালতের কাছে আবেদন করেন না সরকারের আইন কর্মকর্তারা। বরং আদালতের কাছে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে বার বার উল্টো সাক্ষীদের জন্য সময় চেয়ে আবেদন করা হচ্ছে। এ ছাড়া আদালতে অনুপস্থিত থাকছেন আসামিদের জবানবন্দি রেকর্ডকারী বিচারক, ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক ও বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ। নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টি মাথায় রেখে জঙ্গিদের বিরুদ্ধে আদালতে সাক্ষ্য দিতে আগ্রহী হন না সাধারণ সাক্ষীরাও। এ ছাড়া আদালতের কর্মচারীরা আসামিদের মাধ্যমে প্রভাবিত হয়ে পরোয়ানা না পাঠিয়ে অনেক সময় গায়েব করে দেন। এ কারণে অনেক সময় সংশ্লিষ্ট সাক্ষীর কাছে আদালতের পরোয়ানা পৌঁছায় না বলেও অভিযোগ রয়েছে। আর এ দীর্ঘসূত্রতার সুযোগে অধিকাংশ আসামি জামিনে মুক্তি পেয়ে আদালতে আর হাজির হচ্ছেন না। আইন বিশেষজ্ঞ শাহ্দীন মালিক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘সাক্ষীরা উপস্থিত না হলে কোনো মামলারই বিচারকাজ সম্পন্ন করা সম্ভব নয় বিচারকদের। এজন্য আদালতে সাক্ষীদের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে। জঙ্গি-সংক্রান্ত মামলায় সাক্ষীরা আদালতে সাক্ষ্য না দিলে জঙ্গিরা উৎসাহিতই হবে। আর আতঙ্কের মধ্যে দিনাতিপাত করব আমরা সাধারণ মানুষ।’ আদালত সূত্র জানায়, ২০১২ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আইন অধিশাখা-১-এর তত্কালীন উপসচিব শেফিনা বেগম সন্ত্রাসবিরোধী আইনে করা ১১৮টি মামলা বিচারার্থে আমলে গ্রহণ করার নিমিত্ত রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে প্রজ্ঞাপন জারি করেন। পরে এই অনুমোদন পাওয়া ১১৮টির মধ্যে আবার কিছু মামলা উচ্চ আদালতের নির্দেশে স্থগিত হয়। এ ছাড়া সাক্ষী হাজির না হওয়ায় বাকি মামলাগুলোর বিচারকাজ শেষ করা যায়নি। তবে কিছু মামলা সাক্ষ্য গ্রহণের শেষ পর্যায়ে রয়েছে। এই সাক্ষীদের মধ্যে বেশির ভাগ পুলিশ সদস্য। পাশাপাশি রয়েছেন সাধারণ সাক্ষী। তবে আসামিপক্ষের আইনজীবীদের অভিযোগ, অনেক মামলায় মিথ্যা ঘটনা সাজিয়ে বিভিন্ন মানুষকে হয়রানি করার জন্য আসামি করা হয়েছে। এসব আসামির বিরুদ্ধে মামলায় সুনির্দিষ্ট অভিযোগও নেই। মামলার বিচার শেষ হলে আসামি হয়তো খালাস পেতে পারেন। এজন্য শুধু গোঁজামিল দিয়ে বার বার সময় চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষ বছরের পর বছর মামলার বিচার শেষ করতে দিচ্ছে না। এ সুযোগে আদালত থেকে আসামিরা জামিনে গিয়ে পলাতক থাকছেন। পরে আদালত থেকে জামিন বাতিল করে গ্রেফতারের নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে কিন্তু পুলিশ আসামিদের ঠিকানায় খুঁজে পাচ্ছে না। কারণ আসামিরা বার বার তাদের ঠিকানা ও নাম পরিবর্তন করে নতুনভাবে অন্য এলাকায় বসবাস করেন। এ কারণে তাদের শনাক্ত করে গ্রেফতার করা কঠিন হয়ে পড়ে। এ ছাড়া পলাতক আসামিদের অধিকাংশই ভাসমান। ভাড়া বাসায় থাকার কারণে বাসা পরিবর্তন করলে অধিকাংশ আসামিকে আর পাওয়া যায় না।

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর