মঙ্গলবার, ১৯ জুলাই, ২০১৬ ০০:০০ টা

বই ছাপার কাজ পাচ্ছে না দেশীয় প্রতিষ্ঠান

মুদ্রণের বড় অংশই যাচ্ছে ভারতে

নিজস্ব প্রতিবেদক

বই ছাপার কাজ পাচ্ছে না দেশীয় প্রতিষ্ঠান

এবার দেশীয় মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান প্রাথমিকের বই ছাপার কাজ পাচ্ছে না। ছাপার কাজের বড় অংশই চলে যাচ্ছে দেশের বাইরে। প্রায় অর্ধেক বই ছাপা হবে ভারতেই। টেন্ডারের সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে ভারতের প্রতিষ্ঠানগুলো এগিয়ে। সরকার প্রাথমিকের সাড়ে ১১ কোটি পাঠ্যবই ছাপানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

জানা যায়, সরকারের পক্ষ থেকে ২০১৭ শিক্ষাবর্ষে প্রাথমিকের ১১ কোটি ৫৭ লাখ বই ছাপার জন্য ৯৮টি লটে ভাগ করে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হয়। ৯৮টি লটের মধ্যে ভারত ৪৮টি লটে সর্বনিম্ন দরদাতা হয়েছে। এ ছাড়া চীন ৮ ও দক্ষিণ কোরিয়ার ৭টি প্রতিষ্ঠান সর্বনিম্ন দরদাতা হয়েছে। সব মিলিয়ে ৯৮টি লটের মধ্যে ৬৩টি লটে বিদেশি প্রতিষ্ঠান সর্বনিম্ন দরদাতা হয়েছে। মাত্র ৩৫টি লটে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠান সর্বনিম্ন দরদাতা হয়েছে। ভারতের যে ৪৮টি লটে সর্বনিম্ন দরদাতা হয়েছে তার মধ্যে শুধু পিতামব্রা বুকস প্রা. লি. একাই ৪২টিতে সর্বনিম্ন দরদাতা হয়েছে। এ ছাড়া ভারতের আরও ৩টি প্রতিষ্ঠান ৬টি লটে সর্বনিম্ন দরদাতা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিব মো. হুমায়ুন খালিদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘দরপত্র দেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে কাদের কাজ দেওয়া হবে তা টেকনিক্যাল ইভ্যালুয়েশন কমিটি বিবেচনা করছে। কমিটি এখনো রিপোর্ট দেয়নি। গেল বছর দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো কম মূল্যে দরপত্র দাখিল করেছিল। তখনো আমরা সন্দিহান ছিলাম যে তারা এ রেটে কাজ করে দিতে পারবে কিনা। কিন্তু তারা কাজ করেছিল।’ গণশিক্ষা সচিব আরও জানান, ‘গত বছর যারা খারাপ মানের কাজ সরবরাহ করেছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে। জরিমানা করা হয়েছে। কেউ কেউ ভালো কাজও করেছে। তাই এখনই বলা যাবে না যে, দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ভালো মানের কাজ করতে পারবে না। বিদেশের যারা সর্বনিম্ন দরদাতা হয়েছে তাদের যোগ্যতা প্রমাণিত হলে অফিশিয়াল হিসাব-নিকাশ মিলিয়ে দেখা হবে। বাজারমূল্য যাচাই-বাছাই করেই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’ সূত্রমতে, ভারতের পিতামব্রা বুকস ৪২টি লটে সর্বনিম্ন দরদাতা হলেও ওই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নানাবিধ অভিযোগ রয়েছে। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের একাধিক (এনসিটিবি) সূত্র জানিয়েছে, পিতামব্রা যে কাগজপত্র জমা দিয়েছে, তার মধ্যে একটি জাল সনদও রয়েছে। পিতামব্রা ভারতের নামকরা প্রতিষ্ঠান হলেও বাংলাদেশে এনসিটিবির বই ছাপার অভিজ্ঞতার যে সনদ জমা দিয়েছে তা জাল বলে অনেকটাই নিশ্চিত এনসিটিবি। আগের চেয়ারম্যানের বরাতে তারা এ জাল সনদ জমা দিয়েছে বলে জানা যায়। এ প্রসঙ্গে এনসিটিবির বর্তমান চেয়ারম্যান নারায়ণচন্দ্র সাহা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, ‘কম মূল্যে দরপত্র দাখিল করলেই কাজ পাবে এমনটা নয়। এ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটির আনুষঙ্গিক অন্য যোগ্যতাও থাকতে হবে। কাজের অভিজ্ঞতা, সঠিক সার্টিফিকেটসহ অন্য শর্তগুলো পূরণ করলেই যোগ্য দরদাতা হিসেবে বিবেচিত হবে। যোগ্য দরদাতাদের মধ্যে যারা সর্বনিম্ন রেটে দরপত্র দাখিল করেছেন, তাদেরই কাজ দেওয়া হবে। অনেকেই কম রেটে দরপত্র দাখিল করেছেন। তবে তাদের অনেকেরই বাংলাদেশে কাজ করার অভিজ্ঞতা নেই বা আমরা যে শর্তাবলি উল্লেখ করেছি সেগুলো পূরণ করছে না। সে ক্ষেত্রে তাদের কাজ দেওয়া হবে না।’ জানা যায়, গত বছর প্রাথমিকের সাড়ে ১১ কোটি বই ছাপার পুরো কাজ পেয়েছিল বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। এবার বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান সর্বনিম্ন দরদাতা হতে পারেনি। এর কারণ হিসেবে জানা গেছে, দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো গত বছরের তুলনায় এবার অনেক বেশি দাম উল্লেখ করেছে। যেমন গত বছর প্রতি ফর্মা বই ছাপার খরচ তারা উল্লেখ করেছিল, ১ টাকা ৫৫ পয়সা। এবার সে খরচ ধরা হয়েছে ২ টাকা ২৭ পয়সা। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রেস মালিকদের অভিযোগ, বই ছাপার ক্ষেত্রে ভারতের প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের দেশের শুল্কসহ যেসব সুযোগ-সুবিধা পায়, বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানগুলো তা পায় না। বাংলাদেশের কাগজ রফতানি থেকে শুরু করে আনুষঙ্গিক অন্যান্য জিনিসপত্র রফতানিতে ৬১ ভাগ পর্যন্ত ট্যাক্স দিতে হয়। ভারতের প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে তা প্রয়োজন হয় না। দেশীয় মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলোর অভিযোগ, ভারত থেকে যে পাঠ্যপুস্তক ছাপিয়ে আনা হয় তা আমদানিকৃত পুস্তক হিসেবে গণ্য করা হয়। আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান হলো এনসিটিবি। ভারত থেকে আনা বইয়ের ক্ষেত্রে এনসিটিবি ১২ ভাগ শুল্ক দেয়। ভারতীয় প্রতিষ্ঠানকে এ শুল্ক দিতে হলে তাদের বই ছাপার খরচ আরও অনেক বেশি পড়ত। তা ছাড়া দেশীয় কোনো প্রতিষ্ঠান এনসিটিবি থেকে কাজ পেলে তার ওপর শতকরা ৫ ভাগ ট্যাক্স কেটে রাখা হয়। এসব কারণে বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানগুলোকে অসম প্রতিযোগিতায় পড়তে হয়। জানা যায়, শুরু থেকেই আন্তর্জাতিক দরপত্রের তীব্র বিরোধিতা করে আসছেন দেশীয় মুদ্রণ শিল্প মালিকরা। কিন্তু তাদের দাবি উপেক্ষা করে আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে পাঁচ বছর ধরে ভারতের হাতে তুলে দেওয়া হয় দেশের পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণের কাজ। দেশীয় প্রতিষ্ঠানকে কাজ না দিয়ে প্রতি বছর ভারতে পাঠ্যপুস্তক ছাপার কাজ তুলে দেওয়ায় হতাশ দেশের প্রেস মালিকরা। দেশের বিকাশমান মুদ্রণ শিল্প রক্ষায় প্রেস মালিকরা বিদেশে পাঠ্যবই ছাপার অবসান দাবি করে আসছেন। এজন্য প্রধানমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রীর কাছে তারা লিখিত চিঠিতে এ বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন। বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতি আশা করছে, দেশীয় প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিতে সরকার সর্বোচ্চ ছাড় দেবে। এতে শুধু প্রেস মালিকরাই নন, হাজার হাজার শ্রমিকসহ দেশের অর্থনীতি আরও সচল হবে বলে মনে করেন তারা। বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতির সভাপতি শহীদ সেরনিয়াবাত বলেন, ‘বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো যে মূল্যে বিডিং করেছে, তাতে কোনোভাবেই মানসম্মত বই তারা সরবরাহ করতে পারবে না। এটি এনসিটিবি এখন যাচাই-বাছাই করে দেখছে যে দরপত্রদাতাদের যোগ্যতার কোনো ঘাটতি রয়েছে কিনা। যারা সর্বনিম্ন দরদাতা হয়েছে, তাদেরই কাজ দেওয়া হচ্ছে এমনটা এখনো বলা যাবে না। এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। আমি যতদূর জানি, এনসিটিবি বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোকে কাজ দিতে ভরসা পাচ্ছে না। অনেকেই মত প্রকাশ করেছেন যাতে দেশীয় প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়া হয়। গত বছর কম রেটে আমরা কাজ করে প্রমাণ করেছি, দেশীয় প্রতিষ্ঠান কাজ করে দিতে সক্ষম। যদিও কাজের মান নিয়ে একটু প্রশ্ন ছিল। তবে দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো তা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম। আমরা যে মূল্যে টেন্ডার সাবমিট করেছি, তাতে মানসম্মত বই সরবরাহ করতে পারব।’

সর্বশেষ খবর