মঙ্গলবার, ১৯ জুলাই, ২০১৬ ০০:০০ টা
লেখকের অন্য চোখ

সম্পর্ক তৈরি হয় দুভাবে

সমরেশ মজুমদার

সম্পর্ক তৈরি হয় দুভাবে

সম্পর্কহীন হয়ে মানুষ বাঁচতে পারে? কতদিন? ধরা যাক, জাহাজডুবি থেকে বেঁচে যাওয়া একজন নাবিক কোনোরকমে ভাসতে ভাসতে একটি নামহীন দ্বীপে গিয়ে উঠলেন। এরকম ঘটনার কথা আমরা অনেক শুনেছি। কোনো মানুষ দূরের কথা, পশু বা পাখিও সেই দ্বীপে নেই। কতদিন বাঁচবেন তিনি ফল-পাতা-শেকড় খেয়ে। একাকী? দু-চার বছর পরে যদি তাকে উদ্ধার করা হয় তাহলে দেখা যাবে সম্পূর্ণ পাগল হয়ে গেছেন তিনি। আমি জানি না হিমালয়ের গুহাগুলোতে এখনো সাধু-সন্ন্যাসীরা একাকী তপস্যা করেন কি না। এত অভিযাত্রী প্রতি বছর হিমালয়ে অভিযানে যাচ্ছেন, ফিরে এসে তারা তো তেমন কোনো সন্ন্যাসীকে দেখেছেন বলে জানান না। নিজে গিয়ে দেখেছি, সেখানে একা থাকা মুশকিল। আমাদের ওই পাহাড়ের জঙ্গলে মানুষের খাওয়ার মতো ফলটল সারা বছর পাওয়া যায় না। সংসারে যেসব মানুষ সন্ন্যাসীর মতো থাকেন তাদের খাদ্যদ্রব্য কিনতে দোকানে যেতে হয়। তাহলে তার একা থাকা হলো কী করে? একবার খবর হয়েছিল, এক বৃদ্ধ দম্পতি কন্যাশোকে পাথর হয়ে নিজেদের বাইরের জগৎ থেকে প্রায় সরিয়ে নিয়েছিলেন। নিতান্ত প্রয়োজনে কাজের লোকের সাহায্য নিতেন। ওঁদের ভয় হলো, একজন চলে গেলে অন্যজন থাকবেন কী করে? মানুষ কোন মানসিক স্তরে পৌঁছলে প্রিয়জনের ভবিষ্যৎ-একাকিত্ব সহ্য করতে না পেরে অন্যজনকে হত্যা করে নিজে আত্মঘাতী হন, তা আমার জানা নেই। আমাদের সম্পর্কগুলো তৈরি হয় দুভাবে। রক্তের সূত্রে এবং অর্জন করে। বাবা-মা, ভাই-বোন, জ্যাঠা-কাকারা প্রথম শ্রেণিতে পড়েন। এই সম্পর্ক শৈশব থেকে শুরু হয়ে যায় বলে এর ভিত সহজে নড়ানো যায় না। একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে যাওয়ার পরেও ভাই-বোনের সঙ্গে সম্পর্ক শিথিল হয়ে গেলেও একটা অদৃশ্য সুতো জড়িয়ে থাকে, যাকে অস্বীকার করা যায় না। আর যাই হোক, সম্পর্ক যত তিক্ত হোক, বাবা-মাকে তো আইনত ত্যাগ করা যায় না। কিন্তু দ্বিতীয় সম্পর্ক মূলত বিবাহ-বন্ধন থেকেই তৈরি। এর আয়ু নির্ভর করছে দুটি মানুষ কীভাবে তাকে লালন করে তার ওপর। আবার কোনো কোনো সম্পর্ক, যা রক্ত এবং বিবাহ থেকে তৈরি নয়, তা এত নিবিড় হয়ে উঠে— যার কোনো ব্যাখ্যা সম্ভব নয়। ক্রমশ সভ্যতার এই গভীর সংকটকালে, মানুষ দ্রুত একাকী হয়ে যাচ্ছে। একই বাড়িতে স্বামী-স্ত্রী, ছেলে, ছেলের বউ অবস্থান করছে এক-একজন আলাদা দ্বীপ হয়ে। কোনো ঝগড়া নেই কিন্তু কেউ কারও ব্যাপারে আগ্রহী নয়। কেউ চায় না তার ব্যক্তিগত ব্যাপারে অন্যেরা কথা বলুক। সামাজিক উৎসবে বা বাইরের লোকের সঙ্গে মতবিনিময়ের সময়ে এ ছবিটা যাতে ধরা না পড়ে তাতে চেষ্টা থাকে। এই সম্পর্কহীন সম্পর্ক এই সময়ের ফসল।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর