শিরোনাম
শনিবার, ২৩ জুলাই, ২০১৬ ০০:০০ টা

সেই জঙ্গিদের কথা

নিজস্ব প্রতিবেদক

সেই জঙ্গিদের কথা

দুর্ধর্ষ সেই জঙ্গি নেতাদের দিকে নজর এখন গোয়েন্দাদের। প্রবাসী চার বাংলাদেশি ছাড়াও রয়েছেন এক জাপানি নাগরিক। এরাই বাংলাদেশের জঙ্গিদের সহায়তা করছেন। ব্যবস্থা করছেন অর্থ ও অস্ত্রের। সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র এসব তথ্য দিয়ে বলেছে, দেশি-বিদেশি একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা তাদের ব্যাপারে অনুসন্ধান শুরু করেছে। বিদেশি একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে বাংলাদেশকে এরই মধ্যে অবগত করা হয়। জঙ্গিদের এই পৃষ্ঠপোষকদের বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশে এদের কার সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে তা বের করার চেষ্টা চলছে। সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, দেশে সম্প্রতি জঙ্গিবাদের যে নতুন বিষবাষ্প ছড়িয়েছে তার নেপথ্যে ভূমিকা রেখেছেন প্রবাসী চার বাংলাদেশি। তারা হলেন তামিম আহমদ চৌধুরী, সাইফুল্লাহ ওজাকি, সাইফুল হক সুজন ও আবু তারেক মোহাম্মদ তাজউদ্দিন কাওসার। এ ছাড়া রয়েছেন জাপানি এক নাগরিক যিনি ধর্মান্তরিত মুসলিম। নিউইয়র্ক টাইমসেরও এক প্রতিবেদনে বলা হয়, এই প্রবাসী জঙ্গিদের সঙ্গে বাংলাদেশের ভিতরের জঙ্গি ও দেশের বাইরের সংগঠকদের মধ্যে যোগসূত্র হতে পারে। নিখোঁজের তালিকায় থাকা জাপানপ্রবাসী সাইফুল্লাহ ওজাকিকে বাংলাদেশি জঙ্গিবাদের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক বলে ধারণা করছেন গোয়েন্দারা। ১ জুলাই গুলশান হামলায় ঘরছাড়া যুবকদের জড়িত থাকার তথ্য প্রকাশের পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী থেকে দেওয়া নিখোঁজদের প্রথম তালিকায় সাইফুল্লাহ ওজাকির নাম রয়েছে। জানা গেছে, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলার জিনদপুর ইউনিয়নের কড়ইবাড়ী গ্রামের জনার্দন দেবনাথের ছেলে সুজিতচন্দ্র দেবনাথই এই সাইফুল্লাহ। সিলেট ক্যাডেট কলেজ থেকে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় মেধা তালিকায় স্থান নিয়ে উত্তীর্ণ হয়ে ২০০১ সালে বৃত্তি নিয়ে জাপানে গিয়ে ধর্মান্তরিত হন। এক জাপানি নারীকে বিয়ে করে জাপানের নাগরিকত্ব নেন। ধর্মান্তরের পর বাংলাদেশে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা সাইফুল্লাহ ২০১১ সালে পিএইচডি ডিগ্রি নেওয়ার পর রিসুমেকান ইউনিভার্সিটির ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে শিক্ষকতায় যোগ দেন। তবে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অনুপস্থিত থাকায় গত মার্চে তাকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বরখাস্ত করে বলে জাপান টাইমের খবরে বলা হয়। পত্রিকাটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাইফুল্লাহ ওজাকি ২০১৫ সালের ১৫ মে তুরস্ক হয়ে সিরিয়া যাওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। তখন জাপানে ফিরে আসার পর পুলিশ তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল। তার দুই মাস পর সিরিয়ার ‘শরণার্থীদের সহায়তা করার’ কথা বলে ইউরোপ যান সাইফুল্লাহ।

সূত্র জানায়, জঙ্গিবাদ উসকে দিতে সাইফুল হক সুজন নামে আরেকজন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা আবুল হাসনাতের দুই ছেলে সাইফুল হক সুজন ও আতাউল হক একসময় যুক্তরাজ্যে থাকতেন। বর্তমানে আতাউল স্পেনে রয়েছেন। আর সুজন সিরিরায় নিহত হয়েছেন বলে যুক্তরাজ্যের এক্সপ্রেস পত্রিকা ও বিবিসি খবর দিয়েছিল। সুজন যুক্তরাজ্যে কম্পিউটার সায়েন্সে পড়াশোনা করেন। তিনি হ্যাকিং কর্মকর্তা, নজরদারি প্রতিরোধ, প্রযুক্তির ওপর পারদর্শী।

জঙ্গিদের মদদদাতা হিসেবে সিলেটের বিয়ানীবাজারের তামিম চৌধুরীর নামও আলোচনায় রয়েছে। কানাডাপ্রবাসী তামিমের সঙ্গে তার পরিবারের যোগাযোগ নেই প্রায় পাঁচ বছর। র‌্যাব নিখোঁজের যে তালিকা প্রকাশ করেছে তাতে তামিমের নামও রয়েছে। গোয়েন্দারা বলছেন, তামিম চৌধুরী ২০১৩ সালে কানাডা থেকে দেশে আসেন। এর পর থেকে তার কোনো খোঁজ নেই।

পুলিশের একটি সূত্র জানায়, অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী তাজউদ্দিনের গ্রামের বাড়ি লক্ষ্মীপুর। তার পুরো নাম আবু তারেক মো. তাজউদ্দিন ওরফে এ টি এম তাজউদ্দিন ওরফে কাওসার। ২০০৪ সালে ঢাকার আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি থেকে কম্পিউটার সায়েন্সে পাস করেন। ২০০৬ সালে একই বিষয়ের ওপর মাস্টার্স করতে অস্ট্রেলিয়ায় যান। ২০০৮ সালে সেখানে ধর্মান্তরিত মুসলিম নোভা হাসানকে বিয়ে করেন। ২০০৯ সালে স্ত্রীকে নিয়ে দেশে আসে। এরপর ২০১০ সালেও একবার একা দেশে আসেন। সর্বশেষ ২০১৩ সালে দেশে এসে এক সপ্তাহ অবস্থান করে অস্ট্রেলিয়ায় ফেরত যান। ওই সময় দেশ থেকে যাওয়ার পর তাজউদ্দিনের সঙ্গে স্বজনদের তেমন একটা যোগাযোগ ছিল না। তবে মাঝেমধ্যে বিভিন্ন নম্বর থেকে মাকে ফোন করে ১-২ মিনিট কথা বলতেন। সম্প্রতি জঙ্গি হামলার পর দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে তাজউদ্দিনের নাম আলোচনায় আসে। এরপর তার মা লক্ষ্মীপুর থানায় ৯ জুলাই একটি জিডি করেন।

জাপানির প্রভাব আইএসে?: ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরের সুজিতকে মেধাবী ও শান্ত স্বভাবের বলেই চিনতেন স্থানীয়রা। তার জঙ্গিসম্পৃক্ততার খবরটি পরিবারসহ এলাকাবাসীর পুরোটাই অজানা। ১৪ মাস আগে বাংলাদেশে এসে গ্রামে গিয়ে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানের বাড়িতে বাবা-মার সঙ্গে দেখা করে গেলেও তখনো তাকে নিয়ে কোনো সন্দেহ হয়নি কারও। কিন্তু তালিকায় নাম আসার পর ব্যবসায়ী জনার্দন দেবনাথ জানতে পারেন তার ছেলে নিখোঁজ। ছেলের জন্য তার মা প্রতিদিনই কাঁদেন বলে জানান জনার্দন।

জাপানের আর্কাইভ ডট ওরাজি ওয়েবসাইটে সুজিতের নামে একটি গবেষণাপত্র পাওয়া গেছে। যোগাযোগ সাময়িকী ‘প্রোসিডা’র ২০১৫ সালের জুলাইয়ে তার একটি প্রবন্ধও প্রকাশিত হয়। এর পরই তিনি উগ্রবাদী গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের সংস্পর্শে আসেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। জাপানের গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জাপানের ডশিসা ইউনিভার্সিটির সাবেক অধ্যাপক হাসান নাকাতার সংস্পর্শে এসে আইএসে যুক্ত হন সাইফুল্লাহ। জাপানের জাতীয় পুলিশ সংস্থা (এনপিএ) বলছে, নাকাতা গা ঢাকা দিয়েছেন। তাকে খুঁজতে পুলিশ কাজ করছে।

১৯৭৯ সালে ইসলাম গ্রহণকারী হাসান নাকাতা আইএসের হয়ে কাজ করছেন বলে নিশ্চিত হওয়ার কথা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান। তিনি বলেন, নাকাতার সহযোগী হিসেবে সাইফুল্লাহ ওজাকিকেও জাপান পুলিশ খুঁজছিল। সৌদি আরবে জাপানের রাষ্ট্রদূত হিসেবে কাজ করে আসা নাকাতা এরপরই হিযবুত তাহ্রীরে যোগ দেন বলে গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদনে দেখা যায়। সংগঠনটির বিভিন্ন কার্যক্রমে তার যুক্ত থাকার প্রমাণ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও আছে।

সর্বশেষ খবর