রবিবার, ২৪ জুলাই, ২০১৬ ০০:০০ টা

জঙ্গি তালিকা নিয়ে বিভ্রান্তি অনেক পরিবারে বিস্ময়

পালিয়ে বিয়ে করা, অভিমানে ঘর পালানো, কারাগারে আটক, মোবাইলে চার্জ না থাকা ব্যক্তি, মানসিক রোগীর নামও তালিকায়

নিজস্ব প্রতিবেদক

জঙ্গি তালিকা নিয়ে বিভ্রান্তি অনেক পরিবারে বিস্ময়

ঢাকার মগবাজারের মুদি দোকানদার ছানাউল্লাহ। চলতি বছরের শুরুতে সন্ত্রাসীরা তাকে ধরে নিয়ে যায় চাঁদার দাবিতে। ছানাউল্লাহর বাবা রমনা থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। দুই দিন পর ছানাউল্লাহ বাসায় ফিরে আসেন। র‌্যাবের প্রকাশ করা নিখোঁজ তালিকায় তার নাম ৪৩ নম্বরে। এতে আতঙ্কিত ছানাউল্লাহ। তাকে জঙ্গি বানানো হয় কি না এ নিয়েই এখন আশঙ্কা তার।

অ্যাম্বুলেন্স চালক আবদুর রহিমের বাসা চট্টগ্রামের চকবাজার চট্টেশ্বরী এলাকায়। ৩০ মে বাসা থেকে বেরোনোর পর তিনি দেখতে পান, তার মোবাইল ফোনে চার্জ নেই। তার পরিবার কোনো যোগাযোগ করতে না পারায় থানায় জিডি করে। অ্যাম্বুলেন্স চালক রহিমের নাম উঠে আসে র‌্যাবের নিখোঁজের তালিকায়। এ দুটি ঘটনা শুধু নয়, বিগত ছয় মাসের নানা ঘটনায় লিপিবদ্ধ করা নিখোঁজ জিডির সঙ্গে মিলিয়ে ফেলা হয়েছে প্রকৃত জঙ্গি নিখোঁজের তালিকা। বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে র‌্যাবের নিখোঁজ তালিকা নিয়ে। পালিয়ে বিয়ে করা, অভিমানে ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়া, কারাগারে আটক, এমনকি মোবাইল ফোনে চার্জ না থাকায় পরিবারের সঙ্গে সাময়িক বিচ্ছিন্ন হওয়া ব্যক্তির নাম উঠে এসেছে র‌্যাবের সেই তালিকায়। র‌্যাবের ২৬২ জনের নিখোঁজ তালিকার মধ্যে এমন শতাধিক ব্যক্তি রয়েছেন নিজ বাড়িতেই। এদের প্রত্যেকের মধ্যে এখন যেমন আতঙ্ক বিরাজ করছে, তেমনি তাদের পরিবারও বিস্মিত। তারা বলছেন, নিজ বাড়িতে তারা অবস্থান করলেও র‌্যাবের জঙ্গি তালিকায় তাদের নাম উঠে গেছে। তাদের আবার জঙ্গি বানানো হয় কি না এ নিয়েও তারা শঙ্কিত। জিডি প্রত্যাহার করছেন অনেকেই। নিখোঁজের এই তালিকা প্রকাশের পর আতঙ্ক এখন বিরোধী রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের মধ্যে। তারা বলছেন, রাজনৈতিক মামলার কারণে অনেক নেতা-কর্মী ঘরছাড়া আগে থেকেই। অনেকের পরিবার থানায় জিডি করেছিলেন। আবার অনেকে করেননি। তাদের জঙ্গি বানানো হয় কি না এ নিয়েই তাদের দুশ্চিন্তা এখন। জানা গেছে, র‌্যাবের তালিকাভুক্ত ‘নিখোঁজ’ ব্যক্তিদের মধ্যে শুক্রবার পর্যন্ত ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় শতাধিক ব্যক্তির সন্ধান পাওয়া গেছে, যারা এখন বাড়িতে থেকেও নিখোঁজের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। উল্লেখ্য, মঙ্গলবার রাতে র‌্যাব নিখোঁজ ২৬২ জনের নাম প্রকাশ করে। চট্টগ্রামের মো. রিয়াজ পরিবারের অমতে বিয়ে করে ৪ জুন বাড়ি থেকে পালিয়ে যান। তিন সপ্তাহ পর ফিরে আসেন। এরই মধ্যে পরিবারের পক্ষ থেকে থানায় জিডি করা হয়। তার নামও রয়েছে র‌্যাবের সেই তালিকায়। জাহের সুপার মার্কেটের হক বিরানি হাউসের কর্মচারী এনামুল হক ৩ জানুয়ারি নিখোঁজ হন বলে থানায় জিডি হয়েছিল। পরে তিনি বাসায় ফিরে আসেন। তার নামও ওই তালিকায় রয়েছে। মোহাম্মদ শাহজালাল শামীম ২৬ জানুয়ারি নিখোঁজ হলেও তিন দিন পর তাকে ষোলশহর রেললাইনের ওপর পাওয়া যায়। তার ভাগনে আরিফুর রহমান বলেন, ‘মামা মানসিক রোগী। তাকে এখন নোয়াখালীর গ্রামের বাড়িতে রাখা হয়েছে।’ তার নামও আছে ওই তালিকায়। চট্টগ্রামের আজিউর রহমান ৩০ মার্চ একা একা ঢাকায় যান। এ ব্যাপারে পরিবার থানায় জিডি করলেও ফিরে আসেন তিন দিন পর। তার নামও রয়েছে তালিকায়। চট্টগ্রামের সদরঘাট এলাকার মানিক হোসেন, মো. সবুজ, মো. জুয়েল ও আজিজুর রহমান ফেব্রুয়ারি থেকে মে মাসের মধ্যে নিখোঁজ হন। এসব ঘটনায় পৃথক জিডি হয়। এদের মধ্যে মানিক একটি মাদক মামলায় গ্রেফতার হয়ে কারাগারে আছেন। বাকি তিনজন বাড়ি ফিরে এসেছেন। একইভাবে ডবলমুরিং থানার মোজাফফর হোসেন পরিবারের কাছে ফিরে এসেছেন। পতেঙ্গার বাসিন্দা জানে আলম ও পাহাড়তলীর নুরুল হুদাও আছেন বাসায়। উত্তর কাট্টলীর হাসান কাউসার, মো. মিলাদ ও ওমর ফারুক যথাক্রমে  ১৪ জানুয়ারি, ১৭ ফেব্রুয়ারি ও ২৬ ফেব্রুয়ারি নিখোঁজ হন। পরে তিনজনই বাসায় ফিরেছেন বলে তাদের পরিবার ও পুলিশ নিশ্চিত করেছে। পূর্ব ফিরোজ শাহ এলাকার আসিফ ইকবাল ১২ মার্চ নিখোঁজ হন বলে ছোট ভাই শাহবাজ খান থানায় জিডি করেন। কয়েক দিনের মধ্যেই আসিফ ফিরে আসেন। তিনি এখন শ্বশুরবাড়িতে থাকেন। ইমরান হোসেন প্রেমঘটিত কারণে বাড়ি ছেড়েছিলেন। পরে ফিরে আসেন। বাসায় রয়েছেন সুজন ও মো. আবু সালেহ রাসেল। পরিবারের সঙ্গে রাগ করে ১৬ জুন ঘর ছেড়ে চলে যান হামজারবাগ এলাকার আবু তাহের পলাশ। ১০ জুলাই বাড়ি ফেরেন তিনি। গত বছর ১৪ ডিসেম্বর মুরাদপুরের বাসা থেকে বেরিয়ে যান নির্মাণশ্রমিক মো. মামুন। ঝগড়া করে মামুন বাড়ি ছেড়ে চলে যান। তিনি এখন বউয়ের সঙ্গে আলাদা বাসায় থাকছেন। নিখোঁজ তালিকায় ২১৫ নম্বরে রয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রহমতউল্লাহর নাম। ১৪ মে রাতে রাজশাহী নগরীর মতিহার থানায় রহমতউল্লাহর নিখোঁজ হওয়ার তথ্য জানিয়ে জিডি করেছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রপ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক নুরুল আলম। জিডিতে তিনি বলেছিলেন, ১৩ মে সন্ধ্যায় রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অসুস্থ এক স্বজনকে দেখতে যাওয়ার কথা বলে হল থেকে বের হয়ে যান রহমতউল্লাহ। রাতে তিনি আর হলে ফেরেননি। এর পর থেকে তার মোবাইল ফোনও বন্ধ। বিশ্ববিদ্যালয়ের মাদার বখ্শ হলের ১০৭ নম্বর কক্ষের আবাসিক শিক্ষার্থী রহমতউল্লাহকে নিয়ে জিডি করার তিন দিন পর ১৭ মে শিক্ষক রেজাউল করিম হত্যা মামলার তদন্তের অগ্রগতি জানাতে গিয়ে তৎকালীন মহানগর পুলিশ কমিশনার মো. শামসুদ্দিন এ শিক্ষার্থীকে গ্রেফতারের বিষয়টি জানান। রাজশাহী মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, ১৭ মে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এ এফ এম রেজাউল করিম সিদ্দিকী হত্যা মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে রহমতউল্লাহকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়। তিনি বলেন, ‘এরপর তাকে তিন দিন রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়েছে। বর্তমানে তিনি রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে রয়েছেন।’ র‌্যাবের নিখোঁজের তালিকায় ঢাকার ৭৮ জনের নাম রয়েছে। এ পর্যন্ত ঢাকার ‘নিখোঁজ’ হওয়া মোট ১৬ জনের খোঁজ পাওয়া গেছে। র‌্যাবের তালিকায় ঢাকার তেজগাঁও থানার অধীন ১১ জনের নিখোঁজের জিডির কথা উল্লেখ আছে। এদের নয়জনই নিখোঁজ হওয়ার পর বিভিন্ন সময় বাড়ি ফিরে এসেছেন বলে জানিয়েছেন তেজগাঁও থানার ওসি মাজহারুল ইসলাম। তিনি বলেন, এদের মধ্যে কেউ প্রেম করে পালিয়েছিলেন, আবার কেউ বাবা-মায়ের সঙ্গে রাগ করে বাড়ি ছেড়েছিলেন। পরে তারা ফিরে এসেছেন। ওসি মাজহারুল বলেন, নিখোঁজ ব্যক্তিদের মধ্যে জিডি হওয়া দুজন এখনো ফেরেননি। তারা হলেন মো. রাকিবুল ইসলাম ও মো. জুবায়ের হোসেন ফারুক। জুবায়েরের স্ত্রী থানায় জিডি করেছিলেন। তিনি পুলিশকে বলেছেন, জুবায়ের মালয়েশিয়ায় আছেন, তার সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে। তবে রাকিবুল জঙ্গি তৎপরতার সঙ্গে যুক্ত হয়ে থাকতে পারেন বলে তার ভাই রিয়াজুল পুলিশকে জানিয়েছেন বলে ওসি জানান। নিখোঁজের তালিকায় রয়েছেন যুক্তরাজ্যে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজে বোমা পেতে রাখার দায়ে সাজাপ্রাপ্ত রাজীব করিমের ভাই তেহিজব করিম। ব্যাংকক থেকে ১৭ মে ঢাকায় নামার পর হজরত শাহজালাল বিমানবন্দরের ভিতর থেকে তিনি নিখোঁজ হন বলে তার পরিবার জানিয়েছে।

নিখোঁজ পাইলট : গত বছর ১৯ জুলাই বিকালে ঢাকার আদাবরের বাসা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন পাইলট মো. মাহমুদুল আহসান রাতুল। ওই দিন রাত ৮টা ৩৫ মিনিটে মুঠোফোনে মায়ের সঙ্গে তার শেষ কথা হয়। জানিয়েছিলেন ফিরতে একটু দেরি হবে। এরপর এক বছর পেরিয়ে গেলেও আর ফেরেননি মাহমুদুল। তালিকার ১ নম্বর ক্রমিকে থাকা বগুড়ার ধুনট উপজেলার সাইদুল ইসলাম ঢাকায় তার কর্মস্থলে রয়েছেন বলে জানা গেছে। ধুনট উপজেলার মাধবডাঙ্গার মৃত হায়দার আলীর ছেলে সাইদুল ইসলাম বলেন, স্থানীয় সন্ত্রাসীরা তাকে ধরে নিয়ে গেলে ১৪ জুন তার স্ত্রী হোসনে আরা বনানী থানায় জিডি করেছিলেন। তবে দুই দিন পরই সন্ত্রাসীরা তাকে ছেড়ে দেয়। তালিকায় নাম প্রকাশের পর সাইদুল বনানী থানায় গিয়ে গতকাল জিডি প্রত্যাহার করেন। তিনি বলেন, এখনো তিনি তার কর্মস্থল পল্টনের ব্যাংক এশিয়ায় পিয়ন হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। র‌্যাবের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা আসলে নিখোঁজের এ তালিকা তৈরি করেছি বিভিন্ন থানা থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে। এখন যদি কেউ ফিরে আসে কিংবা কারও সন্ধান পাওয়া যায়, তা জেনে আমরা সংশ্লিষ্ট থানায় যোগাযোগ করে তালিকা হালনাগাদ করব।’

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর