বৃহস্পতিবার, ২৮ জুলাই, ২০১৬ ০০:০০ টা

সন্তান যখন ভয়ঙ্কর জঙ্গি

অসহায় বিব্রত উদ্বিগ্ন বাবা-মা । লাশ নিতে চান না কেউ । নিখোঁজ হলে এখন জিডিও করেন না

সাখাওয়াত কাওসার

সন্তান যখন ভয়ঙ্কর জঙ্গি

ঘটনা-১ : গুলশানে হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় নিহত রোহান ইমতিয়াজ ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ নেতা ইমতিয়াজ খান বাবুলের একমাত্র সন্তান। রোহান স্কলাস্টিকা ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএর ছাত্র ছিলেন। চলতি বছর জানুয়ারি মাসের ৪ তারিখ থেকে নিখোঁজ ছিলেন তিনি। ঘটনা-২ : হলি আর্টিজানে নিহত আরেকজন মীর সামিহ মুবাশ্বের। তিনিও স্কলাস্টিকার ছাত্র ছিলেন। চলতি বছর ২৯ ফেব্রুয়ারি বেলা ৩টার দিকে কোচিংয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে গাড়িতে করে বাসা থেকে বের হয়েই নিখোঁজ হন মুবাশ্বের। পরিবারের সঙ্গে তিনি বনানী ডিওএইচএসের ৫ নম্বর সড়কের একটি ফ্ল্যাটে থাকতেন। তার বাবা মীর এ হায়াত কবির বলেন, নিখোঁজের দিনই তিনি গুলশান থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। এর বাইরে কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় নিহত জঙ্গি আবীর রহমান নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএ শেষ বর্ষের ছাত্র ছিলেন। তার বাবা ব্যবসায়ী সিরাজুল ইসলাম। গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার দেবীদ্বার। মার্চ থেকে নিখোঁজ ছিলেন আবীর। পরিবার জিডি করে রাজধানীর ভাটারা থানায়। শুধু সাব্বিরুল, রোহান, মুবাশ্বের কিংবা আবীর নন। এমন অনেক মেধাবী সন্তান এখন বাবা-মায়ের উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছেন। জঙ্গিবাদের মতো উগ্র পন্থায় সন্তান পা বাড়ানোর কারণে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছে নিগৃহীত হচ্ছেন অনেক বাবা-মা। মুহূর্তেই ধূলিসাৎ হয়ে যাচ্ছে তিলে তিলে গড়া সব স্বপ্ন। বুকের মানিকের এমন অবস্থা দেখে অনেক বাবা-মায়ের অবস্থা অনেকটা জীবন্ত লাশের মতো। চাপা কষ্ট কাউকে শেয়ার না করে নিজেরাই বয়ে বেড়াচ্ছেন। সামাজিক অবস্থানের কারণে তারা আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকেও অবহিত করছেন না। মনোবিজ্ঞানীদের মতে, মা-বাবা সন্তানকে ঠিকমতো সময় না দেওয়ায় নানা মানসিক জটিলতা সঙ্গী হচ্ছে তাদের। পরিবার কী এ জিনিসটাই তারা বুঝতে পারছে না। দীর্ঘদিন এভাবে চলতে থাকলে একসময় মাদকাসক্ত হওয়াসহ ভুল পথে পা বাড়াতে পারে সন্তান। অনেক পরিবারে বাবা-মায়ের দাম্পত্য কলহ সন্তানদের মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত করছে। মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, পরিবারের পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিবেশও শিক্ষার্থীদের মানসিক অবস্থার নেতিবাচক পরিবর্তনে ভূমিকা রাখে। এ জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিবেশের দিকেও খেয়াল রাখতে হবে কর্তৃপক্ষের। এর বাইরে শিশুর মানসিক বিকাশের জন্য খেলাধুলা ও সংস্কৃতি চর্চার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে রাষ্ট্রকেই। মনোবিজ্ঞানী ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর নূর মোহাম্মদ লিমন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বাবা-মায়ের উচিত হবে সন্তানকে পর্যাপ্ত সময় দেওয়া। এ জন্য দরকার পারিবারিক সচেতনতা। সন্তানের আবেগ-অনুভূতিকে গুরুত্ব দিতে হবে। সন্তানের আচরণে কোনো ধরনের পরিবর্তন দেখা দিলে প্রথমে নিজেরা, এতে কাজ না হলে কাউন্সেলর ও মনোবিজ্ঞানীদের শরণাপন্ন হতে হবে। এ ক্ষেত্রে কোনো সময় ক্ষেপণ করা উচিত হবে না। এতেও কাজ না হলে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সাহায্য নিতে হবে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে রাজধানীর আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির এক ছাত্র বলেন, ‘পরিচিতজনদের দেখেছি, মা-বাবাকে নিয়ে ঘুরতে যাচ্ছে। মজা করছে। ফেসবুকে সেসব ছবি আপলোড করছে। অথচ যখনই আমি মা-বাবাকে ঘোরার কথা বলেছি, তারা বলেছেন, এখন সময় নেই, কাজ আছে। তারা শুধু কাজটাই বুঝলেন, আমাকে বুঝলেন না।’ তবে সম্প্রতি জঙ্গি-সংক্রান্ত কর্মকাণ্ডে গ্রেফতার ও নিখোঁজ সন্তানদের বিষয়ে খোঁজ নিতে গিয়ে আঁতকে উঠেছেন তদন্ত-সংশ্লিষ্টদের অনেকে। তারা এ প্রতিবেদককে বলেছেন, সন্তানরা বিপথে চলে যাওয়ার জন্য অনেক ক্ষেত্রে বাবা-মা নিজেরাই দায়ী। নিজেদের কাজ নিয়ে অতিমাত্রায় ব্যস্ততা সন্তানকে বিপথে চলে যাওয়ায় উৎসাহিত করেছে। অনেক পরিবারে দাম্পত্য কলহ। আবার অনেক বাবা-মা সন্তানের মধ্যে বিশেষ পরিবর্তন দেখার পরও গোপন রেখেছিলেন। আবার খেলাধুলা ও মেধা বিকাশের জন্য অপর্যাপ্ততার কারণেও অনেক সন্তান বখে যাচ্ছে। র‌্যাবের গোয়েন্দা বিভাগের পরিচালক লে. কর্নেল আবুল কালাম আজাদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বর্তমানে অধিকাংশ মা-বাবাই সন্তানের শিক্ষার ক্ষেত্রে কোচিং ও গৃহশিক্ষকের ওপর বেশি মাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন। ওই শিক্ষকরা তার সন্তানকে কী পড়াচ্ছেন তারও খুব একটা খোঁজ নিচ্ছেন না তারা। এতে করে শিক্ষার ব্যাপারে সন্তান ও মা-বাবার দূরত্ব বেড়ে যাচ্ছে। অনেক অভিভাবক আকাশ সংস্কৃতির দিকে অতিমাত্রায় ঝুঁকে পড়ার কারণে সন্তানের দিকে সময়ই দিতে পারছেন না। এ সুযোগে সন্তানরা বিপথে পা দিচ্ছে। সন্তানের দিকে বাবা-মার আচরণের পরামর্শ হিসেবে তিনি বলেন, বাবা-মার উচিত হবে সন্তানদের টাচে থাকা। বিশেষ করে বয়ঃসন্ধিকালের সময়টাতে সন্তানের দিকে বিশেষ নজর দেওয়া উচিত তাদের। সন্তানের হঠাৎ কোনো পরিবর্তন দেখলে প্রথমে নিজেরা, তাতে কোনো কাজ না হলে মনোবিজ্ঞানী, এতেও কাজ না হলে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সহায়তা নেওয়া প্রয়োজন। একই সঙ্গে সন্তানরা ইন্টারনেটে কোন কোন সাইট ব্রাউজ করছে সেদিকে বিশেষ নজর রাখতে হবে। সন্তান বিতর্কিত সাইটগুলোতে ব্রাউজ করছে কিনা এর জন্য মনিটরিং জরুরি। নিহত জঙ্গি নিবরাস ইসলামের বিষয়ে তিনি বলেন, ক্রমাগতভাবে পরীক্ষার রেজাল্ট খারাপ করার কারণে গার্লফ্রেন্ড তাকে পরিত্যাগ করে। এতে আরও ভেঙে পড়তে থাকেন নিবরাস। তার ওই অবস্থাটাকেই কাজে লাগায় জঙ্গিরা। বয়ঃসন্ধিকালের সময় সন্তানের দিকে বিশেষ নজর দেওয়া উচিত। জানা গেছে, হলি আর্টিজানে নিহত জঙ্গি নিবরাস ইসলাম মালয়েশিয়ার মোনাস বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। এর আগে তিনি ঢাকার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। তবে পরিবার তার বিষয়ে খুব একটা কেয়ার করেনি। র‌্যাবের তালিকায় নাম আসা শেহজাদ রউফ অর্ক নিহত জঙ্গি নিবরাসের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। অর্কের আচরণে পরিবর্তনের বিষয়টি টের পাওয়ার পরও তার পরিবার যথাযথ ব্যবস্থা নেয়নি। এইচএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়ে হাসান ঢাকায় এসেছিল মেডিকেল কলেজে ভর্তির প্রস্তুতি নিতে। ঢাকায় এসেই হাসান বদলে যেতে থাকে। হাসানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু শিহাব ছাত্রশিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তিনি প্রায়ই হাসানের বাসায় আসতেন এবং তার সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ গল্প করতেন। বিষয়টি আঁচ করতে পারার পরও কোনো ধরনের উদ্যোগ নেননি মা রোকেয়া আকতার। সর্বশেষ ২৫ জুলাই দিবাগত রাতে রাজধানীর কল্যাণপুরে জঙ্গি আস্তানায় পুলিশি অভিযানে গুলিবিদ্ধ হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন হাসান। মনোরোগ চিকিৎসক ড. মোহিত কামাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, কিশোরদের তথা অপেক্ষাকৃত কম বয়সী তরুণদের মন হয় ‘কাঁচা মাটি’র মতো। তাদের ‘রিজোনিং পাওয়ার’ খুব কম থাকে। তাদের অনুভূতিও অন্যদের চেয়ে ভিন্ন। এ বয়সে তাদের যেভাবে বোঝানো হয় তারা ঠিক সেভাবেই বোঝে। এমনকি তাদের সহজেই ‘মোটিভেট’ করা যায়। আর এ সুযোগেই অসাধু ব্যক্তিরা নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য এই তরুণদের ব্যবহার করে। অথচ যারা এর শিকার হচ্ছে, অর্থাৎ সেই কিশোর-তরুণ জানেই না যে তারা কী করছে। পুলিশের তথ্যানুসারে, দেশের করপোরেট খাতের নিয়ন্ত্রণ করা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজনেস স্টাডিজ ফ্যাকাল্টিকে মূল টার্গেট করেছিল ইংরেজিতে প্রচারণা চালানো একটি নিষিদ্ধ জঙ্গিগোষ্ঠী। বিজনেস স্টাডিজ ফ্যাকাল্টির সিসিটিভিতে হিযবুত তাহ্রীরের নানা কর্মকাণ্ডে রত অবস্থায় দেখা গেছে এই ফ্যাকাল্টিরই ছয় শিক্ষার্থীকে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাদের আজীবন বহিষ্কার করা হয়েছে। ওই ফ্যাকাল্টির আরও ২৯ জন ছাত্রের হিযবুত তাহ্রীরে জড়িত থাকার প্রমাণ পেয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অফিস। এর মধ্যে ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন বিভাগের ২০ ও ২১তম ব্যাচের আটজন ছাত্র রয়েছেন। রয়েছেন ফিন্যান্স ও অ্যাকাউন্টিং বিভাগের চারজন করে এবং ম্যানেজমেন্ট বিভাগের দুজন ছাত্র। মার্কেটিং বিভাগের সবচেয়ে বেশি ছাত্র ১১ জনের বিরুদ্ধে হিযবুত তাহ্রীরে জড়িত থাকার প্রমাণ মিলেছে। তারা আর বিশ্ববিদ্যালয়ে যায়নি। ফলে শেষ হয়নি তাদের শিক্ষাজীবনও। তারা ঝরে পড়েছে স্বাভাবিক জীবন থেকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির ছাত্র নির্দেশনা ও পরামর্শদান দফতরের কাউন্সেলর সাইফুন্নেসা জামান সুমি বলেন, মা-বাবার অতিরিক্ত আদর কিংবা অতিরিক্ত শাসন দুটিই সন্তানের সর্বনাশের কারণ। আবার মা-বাবার টালমাটাল সম্পর্কও ছোট্ট মাথাগুলো বিষিয়ে তোলে। পরামর্শ হিসেবে তিনি বলেন, ‘সন্তানকে যা নিষেধ করেন, নিজেও তা করবেন না। সন্তানের বন্ধু হোন, হাত বাড়ান।’

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর