শুক্রবার, ৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা
লেখকের অন্য চোখ

সবাইকে সব কথা বলতে নেই

সমরেশ মজুমদার

সবাইকে সব কথা বলতে নেই

এই যে আমি, চমৎকার বেঁচে আছি, কয়েক মাস ধরে দিন-রাত লিখে যাচ্ছি, কী লিখছি? এই লেখাগুলোর সঙ্গে আমার কী সম্পর্ক? এই যে চরিত্রগুলো, যারা আমার গল্পে তৈরি হয়ে যাচ্ছে একের পর এক, এদের কারও সঙ্গে আমার তো কোনো সম্পর্ক নেই। আমি ওদের তৈরি করছি কিন্তু ওরা ওদের মতো হয়ে যাচ্ছে।

মাঝে মাঝে আয়নার সামনে দাঁড়াতেই হয়। সকালে দাড়ি কামানোর সময়, চুল আঁচড়াতে গিয়ে আয়নায় প্রতিবিম্ব দেখি, বাস্তব মানলে সেটা আমারই। কিন্তু আজ থেকে তিরিশ বা চল্লিশ বছর আগে আয়নায় যে আমাকে দেখতে পেতাম এখন সে কী ভয়ঙ্কর পাল্টে গেছে! আর প্রতিবিম্ব পাল্টালে তো মানুষটা পাল্টাবেই। অর্থাৎ এই আমি তিরিশ চল্লিশ বছর আগের আমি নই। অ্যালবামের ছবি যেন অন্য সমরেশের।

কিন্তু কথাটা কতটা সত্যি? তিরিশ বছরের মধ্যে আমার জীবন-যাপনের ধারা একটুও বদলায়নি। সেই সকালে লেখা, দুপুরে বেরিয়ে রাত ১০টায় বাড়ি ফেরা। তিরিশ বছর আগে যে গান শুনলে আপ্লুত হতাম এখনো তাতে হই। কে দিল আবার আঘাত গানটি।

শোনা মাত্র তিরিশ বছর আগে প্রশ্ন জেগেছিল মনে, আবার আঘাত যখন এলো তখন নিশ্চয় এর আগেও আঘাত এসেছিল। সেই আঘাত কে দিয়েছল? রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞদের জিজ্ঞেস করে ঠিকঠাক জবাব পাইনি। তাই তিরিশ বছর পরেও উত্তরটা যখন খোঁজার চেষ্টা করি, তখন আমি মানে ভিতরের আমি, কি পাল্টে গিয়েছি? মুখ বদলেছে, মাঝখানে শরীরের ওজন বেড়েছিল, এখন আবার আগের জায়গায়, কিন্তু মন বদলায়নি।

এখনো শৈশবের চায়ের বাগানে বেড়াতে গেলে মনে পুলক জাগে। সেই ছোট্ট আংরাভাসা নদীর পাশে দাঁড়ালে তিরতিরিয়ে বয়ে যাওয়া জলের ধারার শব্দ আমাকে বয়েস ভুলিয়ে দেয়। ইচ্ছে করে তখন, যেমন জলে নেমে পাথরের আড়ালে লুকিয়ে থাকা লাল চিংড়ি ধরতাম, আজও তেমনভাবে ধরি। ইচ্ছে করলেই জলে নেমে পড়ি। একটা চিংড়ি আমার হাতে উঠে যখন ছটফটিয়ে মরে তখন শুনতে পাই সে বলছে, ‘এ কি করছ সমরেশ! আমাকে এভাবে ধরার বয়েস তোমার চলে গেছে।’

ঠিক তখনই হয়তো কোনো আগন্তুকের গলার স্বর কানে এলো। দ্রুত উঠে এলাম পাড়ে। আমার মন একটা মুখোশ পরে ফেলল। আগন্তুক বলল, --আপনি এখানে কী করছেন?

--নদীটাকে দেখছিলাম। শৈশবের নদী। ভাবছিলাম এটাকে নিয়ে কী করা যায়।

--কিন্তু ওদিকে কয়েকজন এসেছে আপনার সঙ্গে লাইব্রেরি নিয়ে কথা বলতে। চলুন। ওরা শুনলে খুব খুশি হবে, আপনি এখনো এই জায়গা নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করছেন বলে। --আগন্তুক বলল। যারা এসেছিল তাদের আবদার ছিল, লাইব্রেরির জন্য আমার বইগুলো যদি প্রকাশকদের বলে বিনামূল্যে ওদের দিই তাহলে ওরা খুব খুশি হয়। মনে মনে বিরক্ত হলেও মুখে হাসি এনে বললাম, --বলব, নিশ্চয় বলব। আমার জন্মস্থানের লাইব্রেরির জন্যে নিশ্চয় বলব । ওরা চলে যাওয়ার পর মুখোশটা খুলে ফেলেছি এক লহমায়। একশোটা বই-এর দাম যদি পনেরো হাজার হয় তাহলে প্রকাশকদের বললে নিশ্চয় পাঠাবেন কিন্তু খুব বিরক্ত হয়ে। কী দরকার! অর্থাৎ যতই বলি মন পাল্টায়নি কিন্তু তাতে মিথ্যে থেকে যাচ্ছে। আর কার কটা আছে আমি জানি না, আমার অন্তত গোটা ছয়েক মুখোশ আছে, যা মনের মুখে চমৎকার পরাতে পারি। খবর পেলাম, এক পরিচিত মানুষের, যার সঙ্গে অনেক আড্ডা রেখেছি, মেয়ের বিয়ে। বিয়ের ক’দিন বাকি কিন্তু যেখান থেকে তার টাকা পাওয়ার কথা ছিল সেটা পেতে দেরি হবে। মানুষটি খুব বিপদে পড়েছে।

শুনে খুব খারাপ লাগল। মনে হলো ওকে ফোন করে জিজ্ঞেস করি, কত টাকা এখন লাগবে? হাজার পঞ্চাশেক আমি দিতে পারি, প্রাপ্য টাকা পেলে ফেরত দিলেই চলবে। নাম্বার টিপে দেখলাম ফোনটা সুইচ অফ করা আছে। তার পরের দিন মোবাইল বাজলে ওর নাম্বার দেখতে পেলাম। ‘কেমন চলছে সব’ জিজ্ঞেস করতেই কাতর গলায় বলল, --দাদা, ভীষণ বিপদে পড়ে গেছি। মেয়ের বিয়ের টাকা জোগাড় হয়নি। পাঁচশো অতিথির জন্য ক্যাটারারকে অ্যাডভান্স দিতে হবে। লাখখানেক টাকা আপনার কাছে চাইছি।

শোনা মাত্র আমার মন মুখোশ পরে ফেলল। এই পরাটা একদম আমার অজান্তে। আমি বললাম, --ওহো! আমি তো এখন কুচবিহারে। সঙ্গে চেকবই বা এটিএম কার্ড আনিনি। কলকাতায় থাকলে ......। সরি ভাই। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। কিন্তু কালকের আমি যা ভাবেনি আজকের আমি তা কেন করল? বিশ্লেষণ করে মনে হলো, এই পাঁচশো লোককে খাওয়ানোর কথা শুনে কি আমার মন বিরক্ত হয়েছিল? হয়তোবা।

পণ্ডিতরা বলেছেন, সব কথা সবাইকে বলা উচিত নয়। স্ত্রী বা প্রেমিকাকে তো নয়ই। এক সময় যাদের সঙ্গে আড্ডা মারতাম তাদের কয়েকজন কথায় কথায় স্ল্যাং বলতেন। ঠিক রকের স্ল্যাং নয়, মার্জিত কিন্তু আদতে তা ভদ্রসমাজে বলাই যায় না।

একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম, --আপনারা মুখ খুললেই যে এসব বলেন, বাড়িতে কি বলে থাকেন? সবাই মাথা নেড়েছিলেন। একজন বলেছিলেন, --পেটে গুঁতো মারলেও বাড়িতে গেলে মুখ থেকে বের হবে না। ওটা তো ভাই জেলখানা। জেলার চোখ রাঙিয়ে বসে থাকেন। এই যে আমি বন্ধুদের সঙ্গে প্রতি শনিবার দুপুরের পর একটু পান করে সিনেমা দেখে জর্দাপান চিবিয়ে বাড়ি ঢুকি, পঁচিশ বছরেও টের পায়নি। অর্থাৎ মুখোশ আপনা আপনি চলে আসে। আমার এক বন্ধুর চমৎকার অভিজ্ঞতা হয়েছিল। তার ছেলে-মেয়েরা যখন বড় হয়ে গেছে, মেয়ে মায়ের সঙ্গে আলাদা ঘরে ঘুমোয়, তখন তার কুঁচকির পাশে বিষফোঁড়া হলো। ডাক্তার বললেন, --সেঁক দিন। কাকে বলবে সে? স্ত্রীকে বললে তিনি হয়তো রাজি হবেন, কিন্তু দরজা বন্ধ করতে দেবেন না। মেয়ে কি ভাববে! বৃদ্ধা মা তখনো বেঁচেছিলেন। শৈশবের স্মৃতি মনে করে তাকে বলতে গিয়েও বাধল। বাতের ব্যথায় হাত নড়ে না তার। অতএব সোজা নার্সিংহোমে। নার্স সেঁক দিতে লাগল। বন্ধু বলেছিল, --ফর এ চেঞ্জ, মন্দ লাগল না। তিন দিনে তিনজন নার্সের সেবা পেলাম। এই মন্দ না লাগার কথা অবশ্যই স্ত্রীকে বলেনি সে। মুখোশ পরে ফোঁড়ার যন্ত্রণার গল্প শুনিয়েছিল।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর