শুক্রবার, ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা
টঙ্গীতে চলছে উদ্ধার কাজ

নিহতের সংখ্যা বেড়ে ৩৪

শেখ সফিউদ্দিন জিন্নাহ্ ও আফজাল হোসেন, টঙ্গী থেকে

নিহতের সংখ্যা বেড়ে ৩৪

টঙ্গীতে বিস্ফোরণে ধসে পড়া কারখানায় গতকাল উদ্ধার অভিযানে সেনা সদস্যরা —বাংলাদেশ প্রতিদিন

গাজীপুরের টঙ্গী বিসিক শিল্পনগরীর ট্যাম্পাকো প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে নিহতের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। আর এ সংখ্যা বেড়ে এখন ৩৪ হয়েছে। নিহত ৩৪ জনের মধ্যে ২৮ জনের পরিচয় পাওয়া গেলেও বাকি ৬ জনের পরিচয় মেলেনি। তবে এখনো নিখোঁজ রয়েছেন ১০ জন। ঘটনাস্থলে থাকা তথ্য কেন্দ্রে তাদের নামের তালিকা টানিয়ে দেওয়া হয়েছে। স্বজনরা তাদের খোঁজে দিন-রাত কারখানার আশপাশ এলাকা ও বিভিন্ন হাসপাতালে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। দিন যত যাচ্ছে ততই কারখানার আগুনের ঘটনার বিষয়ে নতুন নতুন তথ্য বেরিয়ে আসছে। কেউ বলছেন বয়লার বিস্ফোরণ, আবার কেউ বলছেন গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ। এ নিয়ে নানা প্রশ্ন জনমনে। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পরই বিসিক শিল্পনগরী টঙ্গী এক শোকাবহ নগরীতে পরিণত হয়েছে। ধ্বংসস্তূপের ভিতর থেকে শুধু পোড়া গন্ধ বের হচ্ছে। কেউ বলছেন এ দুর্গন্ধ মানুষের মৃতদেহের, আবার কেউ বলছেন কারখানার কেমিক্যালের। তবে ধ্বংসস্তূপে উদ্ধার করতে এসে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর দল কারখানার ভিতরের অবস্থা দেখে চমকে ওঠে। এ বিষয়ে গতকাল ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ এস এম মোহাম্মদ হাসান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘টঙ্গীর ট্যাম্পাকো কারখানার ঘটনা রানা প্লাজার চেয়েও ভয়াবহ। আমরা যা পেয়েছি তার মধ্যে কারখানার দুটি বয়লারই অক্ষত পাওয়া গেছে। তবে তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত অগ্নিকাণ্ডের সঠিক কারণ বলা যাবে না।’ অন্যদিকে তিতাস গ্যাস টঙ্গী জোনের ম্যানেজার অজিত চন্দ্র দেব বলেন, গ্যাস থেকে এত বড় বিস্ফোরণ ঘটার কোনো সম্ভাবনা নেই। অন্য কোনো মাধ্যম থেকে আগুনের সূত্রপাত হতে পারে।

ঘটনার ৩৫ ঘণ্টা পর আগুন কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এলেও রবিবার রাত ১০টার দিকে আগুনের লেলিহান শিখা পাশের পাঁচ তলা ভবনে ফের দাউ দাউ করে জ্বলতে দেখা যায়। রাতভর আগুনে পুড়তে থাকে ওই ভবনে থাকা মালামাল। এরপর ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা আগুন নিয়ন্ত্রণে চেষ্টা চালিয়ে যান। কিছুক্ষণ আগুনের লেলিহান শিখা কমতে দেখা গেলেও আবার এর তীব্রতা বেড়ে যায়। সোমবার সকালে ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি দল উদ্ধারকাজে যোগ দেয়। অন্যদিকে ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা শতভাগ আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে চেষ্টা চালিয়ে যান। বিকালের দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে এলেও কারখানার ভিতর থেকে এখনো থেমে থেমে কালো ধোঁয়া বের হতে দেখা যাচ্ছে। সোমবার থেকে গতকাল পর্যন্ত সেনাবাহিনী ও ফায়ার সার্ভিসের দল আরও বেশ কয়েকটি লাশ উদ্ধার করে। মৃতের সংখ্যা আরও বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। নিহত ৩৪ জনের মধ্যে ৬ জনের অবস্থা এমন যাদের শনাক্ত করতে হিমশিম খাচ্ছেন স্বজনরা। নিহতের স্বজনরা নিখোঁজের ছবি নিয়ে একবার ঘটনাস্থলে যাচ্ছেন, আরেকবার যাচ্ছেন হাসপাতালে। এমনকি জেলা প্রশাসনের কন্ট্রোলরুমেও ভিড় করতে দেখা যায় স্বজনদের।

এদিকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর আন্তবাহিনী গণসংযোগ পরিদফতরের (আইএসপিআর) পরিচালক লে. কর্নেল মোহাম্মদ রাশেদুল হাসান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, কারখানার ভিতর থেকে উত্কট গন্ধ বের হচ্ছে। এতে মনে হচ্ছে ভিতরে আরও মৃতদেহ রয়েছে। তবে কারখানার ভিতর থেকে এ পর্যন্ত ৮০টি ড্রাম উদ্ধার করা হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, এসব ড্রামে কেমিক্যাল রয়েছে। তিনি বলেন, সোমবার সকালে ভারী যন্ত্রপাতি নিয়ে সেনাবাহিনীর ১৪ স্বতন্ত্র ইঞ্জিনিয়ারিং ব্রিগেডের একটি দল উদ্ধারকাজে যোগ দেয়।

ট্যাম্পাকো কারখানাটিতে ফয়েল উৎপাদনের জন্য বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করা হতো। এখানে আনুমানিক ২৫ টন রাসায়নিক দ্রব্য যেমন ইথাইল অ্যাসিটেট ছিল, যা অতি দাহ্য পদার্থ। এতে যে কোনো সময় আরও দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। আর এ ঝুঁকির মধ্যেই সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে উদ্ধারকাজ এগিয়ে চলছে। তিনি বলেন, এ উদ্ধারকাজ কত দিন চলবে তা নির্দিষ্ট করে বলা যাচ্ছে না। তবে যথাসাধ্য চেষ্টা করা হবে, যেন এ কাজ দ্রুত সম্পন্ন করা যায়। তবে ঈদের দিনও উদ্ধারকাজ অব্যাহত ছিল। এ পর্যন্ত সেনাবাহিনীর ১০০ জনের বেশি জনবল ও একটি মেডিকেল টিম এ এলাকায় কাজ করছে। বিধ্বস্ত ভবনটিতে কাজ করার জন্য সেনাবাহিনীর ১৪ স্বতন্ত্র ইঞ্জিনিয়ারিং ব্রিগেডের তত্ত্বাবধানে প্রয়োজনীয় ইঞ্জিনিয়ারিং প্যান যেমন এক্সাভেটার, লোডার ড্রাম্পার, ক্রেন ইত্যাদি এবং ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্টের অন্য সরঞ্জামাদি নিয়োজিত রয়েছে।

১৪ স্বতন্ত্র ইঞ্জিনিয়ারিং ব্রিগেডের পাশাপাশি স্পেশাল অর্গানাইজেশন পশ্চিম, গাজীপুর সিটি করপোরেশন, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স, গাজীপুর জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনের সহায়তায় এ উদ্ধারকাজ পরিচালিত হচ্ছে।

ঘটনাস্থলটি পূর্ব-পশ্চিমে আনুমানিক ৬০০ ফুট, উত্তর-দক্ষিণে ৩০০ ফুট; যার মধ্যে চারটি বড় বড় বিল্ডিং রয়েছে। এর মধ্যে তিনটি বিল্ডিং ইতিমধ্যে ভেঙে পড়েছে। একটি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। সম্পূর্ণ এলাকা পর্যবেক্ষণ করে পূর্ব ও পশ্চিম উভয় দিক থেকে তিনটি স্থান দিয়ে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে এ অপারেশন কার্যক্রম শুরু হয়েছে। বিশেষ করে যে স্থানগুলোয় হতাহতের পরিমাণ বেশি হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে, সে স্থানগুলো দিয়েই কাজ শুরু হয়েছে।

এদিকে গাজীপুর জেলা প্রশাসন, সিটি করপোরেশন, জেলা পুলিশের উদ্যোগে ঘটনাস্থলের পাশে একাধিক কন্ট্রোলরুম করা হয়েছে। একটি তথ্য কেন্দ্রও রয়েছে। আর এখানে সার্বক্ষণিক নিহত, আহত, নিখোঁজ সংখ্যার সর্বশেষ তালিকা টানিয়ে রাখা হচ্ছে। এখানে দায়িত্বরত গাজীপুরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নাসরিন পারভীন বলেন, ‘ডিসি অফিসের পক্ষে আমরা তথ্য কেন্দ্র করেছি। এখানে নিহত, আহত ও নিখোঁজদের নামের তালিকা রয়েছে। প্রতিদিনই স্বজনরা এসে ভিড় করছেন তাদের নিহত ও নিখোঁজ ব্যক্তির খোঁজ নিতে।’

গতকাল বেলা আড়াইটার দিকে নিহত মামুনের স্বজনরা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মৃতদেহ না পেয়ে কন্ট্রোলরুমে খোঁজ নিতে আসেন। এ সময় মামুনের খালাতো ভাই ইরফান বলেন, ‘মামুন ট্যাম্পাকো কারখানার মেশিন অপারেটর ছিল। তার বাড়ি চট্টগ্রামের সন্দ্বীপের সারিকাইদ গ্রামে। আমরা পত্রিকায় নাম দেখে ঢামেক হাসপাতালে গিয়ে লাশ পাইনি। তাই এখানে এসেছি খোঁজ নিতে।’

এদিকে ঈদের দিন রাত ১০টার দিকে রাজধানীর ধানমন্ডি নর্দান হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আহত মনোয়ার হোসেন (৪২) নামে একজনের মৃত্যু হয়েছে। অন্যদিকে ট্যাম্পাকো কারখানার ঘটনায় আহত জীবন হাওলাদারের স্ত্রী তার অবুঝ শিশু সন্তান নিয়ে তথ্য কেন্দ্রে গিয়ে আর্থিক সাহায্য পাননি বলে জানান। এদিকে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নিহত শ্রমিক জুয়েলের পিতা আবদুল কাদের বাদী হয়ে আটজনের বিরুদ্ধে টঙ্গী থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। মামলা নম্বর ১৫। আসামিরা হলেন কারখানার চেয়ারম্যার মো. মকবুল হোসেন ওরফে লিচু (৬০), ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর হোসেন (৫৫), সার্বিক দায়িত্বে মকবুলের স্ত্রী পারভীন (৫০), জেনারেল ম্যানেজার সফিকুর রহমান, ডিএমডি আলমগীর হোসেন, ম্যানেজার মনির হোসেন, ম্যানেজার সমির হোসেন ও ম্যানেজার (নিরাপত্তা) হানিফ হোসেন। মামলা পর থেকে আসামিদের খোঁজা হচ্ছে বলে জানায় পুলিশ। তবে কাউকে এখনো গ্রেফতার করতে পারেনি।

গাজীপুর পুলিশ সুপার মোহাম্মদ হারুন-অর রশিদ ও টঙ্গী থানার ওসি ফিরোজ তালুকদার বলেন, ‘ট্যাম্পাকোয় ৩৪ জনের মৃত্যুর ঘটনায় ৮ জনের নাম উল্লেখসহ আরও অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। আইনের চোখে তারা অপরাধী। খুব শিগগিরই তাদের গ্রেফতার করা হবে।’ গাজীপুর-২ আসনেরে এমপি জাহিদ আহসান রাসেল বলেন, টঙ্গী তথা গাজীপুরে এত ভয়াবহ দুর্ঘটনা আর কখনো ঘটেনি। এটা রানা প্লাজার চেয়েও ভয়াবহ। ঈদ-পূর্ব মুহূর্তে এতগুলো মানুষের প্রাণহানির ঘটনা হৃদয়বিদারক। নিহতের স্বজনদের আহাজারি দেখে খুবই কষ্ট হচ্ছে। এ ঘটনার খবর পেয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শোকবার্তা পাঠিয়েছেন। এমনকি নিহতের পরিবারে ২ লাখ ও আহতদের ৫০ হাজার টাকা হিসেবে আর্থিক অনুদানের ঘোষণা দিয়েছেন।

সর্বশেষ খবর