মঙ্গলবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

কেন বাড়ছে সামাজিক অপরাধ

বিশেষজ্ঞ মত : মানুষ হয়ে উঠছে নিষ্ঠুর বাড়ছে বিকৃতি

জিন্নাতুন নূর

মানুষের ধৈর্যশক্তি আগের চেয়ে কমে এসেছে। অর্থের প্রতি তাদের মাত্রাতিরিক্ত লোভও বেড়েছে। সামাজিক অবস্থানে এগিয়ে যাওয়ার জন্য এখন মানুষের মধ্যে চলছে অসম প্রতিযোগিতা। নৈতিক মূল্যবোধেরও চরম অবক্ষয় ঘটেছে। সমাজে চারদিকে চলছে রাজনৈতিক, ব্যবসায়িক ও সাংস্কৃতিক অস্থিরতা। সব মিলিয়ে মানুষের মানসিক বিকৃতি বাড়ছে। তাদের কোমল অনুভূতি চলে যাচ্ছে। ক্রমেই পাশবিক হয়ে তারা আপনজনকেও হত্যা করতে দ্বিধা করছে না। সম্প্রতি ফরিদপুর ও চট্টগ্রামে সন্তানের হাতে মা-বাবা এবং রাজশাহী ও রংপুরে মা-বাবার হাতে সন্তানের হত্যাকাণ্ডের পেছনে কী কারণ থাকতে পারে সে সম্পর্কে জানতে চাইলে সমাজবিজ্ঞানী ও মনোবিজ্ঞানীরা এসব বিষয় উল্লেখ করেন। বৃহস্পতিবার ফরিদপুরে কমলাপুর ডিআইবি বটতলা এলাকার ফারদিন হুদা নামের এক তরুণ নতুন মডেলের মোটরসাইকেল কিনে না দেওয়ায় ক্ষুব্ধ হয়ে তার মা-বাবাকে আগুন লাগিয়ে হত্যার চেষ্টা করে। এতে ফারদিনের বাবা রফিকুল ইসলামের শরীরের ৫০ শতাংশের বেশি আর তার মায়ের পায়ের কিছু অংশ পুড়ে যায়। রফিকুল ইসলামের আত্মীয়রা জানান, নতুন মডেলের মোটরসাইকেল কেনা নিয়ে ফারদিন তার মা-বাবার সঙ্গে কয়েক দিন ধরে ঝগড়া করে আসছিল। এর ঠিক দুই দিন পরই চট্টগ্রামে ঘটে আরেকটি বর্বর ঘটনা। বন্দরনগরীতে সুমিত চৌধুরী নামে এক যুবক ধারালো বঁটি দিয়ে তার মা কুমকুম চৌধুরীকে হত্যা করে পরে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করে। পরিবারের লোকজনদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যে জানা যায়, সুমিত পরীক্ষায় পাস না করায় তাকে তার বড় ভাই শাসন করার দুই ঘণ্টা পরই সে এ হত্যাকাণ্ড ঘটায়। এরই মাঝে শনিবার রাজশাহীতে শাহরিয়ার আলম নামে সাত বছরের শিশুকে কুপিয়ে হত্যা করেন তার মা তসলিমা। জানা যায়, তসলিমার মানসিক সমস্যা আছে। এদিকে রংপুরে রবিবার আলিফা বেগম নামের ২২ মাস বয়সী কন্যাকে হত্যার অভিযোগ উঠেছে তার বাবা আলাল হোসেনের বিরুদ্ধে। ঘটনার পর থেকে আলাল পলাতক।

সমাজবিজ্ঞানী ও মনোবিজ্ঞানীরা এ বর্বর হত্যাকাণ্ডগুলোর পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করে বলেন, হিন্দি সিরিয়াল দেখে অন্য দেশের সংস্কৃতি অনুকরণ করে আমাদের পরিবারগুলোও তাদের মতো জীবনযাপনের চেষ্টা করছে। এর ফলে দাম্পত্য কলহ বাড়ছে। স্বামী-স্ত্রীর মাঝে তৈরি হচ্ছে বিশ্বাসহীনতা। আর এর খেসারত দিতে হচ্ছে সন্তানদের। সব মিলিয়ে এ বিষয়ে রাষ্ট্রের উদাসীনতা এবং মানুষের মধ্যে তৈরি হওয়া বিষণ্নতা ও মাদকাসক্তি সমাজের এই ন্যক্কারজনক হত্যাকাণ্ডগুলোর জন্ম দিচ্ছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষাবিদ ও কথাসাহিত্যিক অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এখন আর মানুষের আত্মশুদ্ধির বিষয় নেই। জীবনযাত্রা ক্রমেই জটিল হয়ে পড়ছে। শহরে অসচ্ছল মানুষজন একসঙ্গে গাদাগাদি করে ছোট জায়গায় থাকছে। ফলে মানুষের মন পরিশুদ্ধ হওয়ার উপায়ও নেই। চিত্তবিনোদনের সুযোগও তেমন নেই। এর ফলে মানুষের রুচি, স্বভাব ও জীবনযাত্রায় বিকৃতি বাড়ছে। তাদের কোমল অনুভূতি চলে যাচ্ছে, তারা ক্রমেই পাশবিক হয়ে আপন মানুষকে হত্যা করছে।

বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট এলিনা খান এই প্রতিবেদককে বলেন, যে সন্তানরা তাদের মা-বাবার হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনা ঘটাচ্ছে কিংবা যে অভিভাবকরা তাদের সন্তান হত্যা করছেন তাদের অনেকেই আর্থিক কারণে এ ঘটনাগুলো ঘটাচ্ছেন। কিছু ক্ষেত্রে অভিভাবকরা পরকীয়ার সম্পর্কে জড়িয়ে পারিবারিক কলহ থেকে সন্তানকে হত্যা করছেন। এ ক্ষেত্রে অবৈধ সম্পর্ক চালিয়ে নিতে হত্যাকারী কোনো বাধা পেলেই ক্রোধের বশবর্তী হয়ে হত্যার মতো গুরুতর অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন। এলিনা খান বলেন, ‘আমি মনে করি, অনৈতিক লোভ, প্রতিযোগিতা, পরচর্চা ও পরকীয়ার কারণেই পারিবারিক এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনাগুলো ঘটছে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ কামাল উদ্দিন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, প্রতিটি পরিবারেরই ভিন্ন ভিন্ন সমস্যা থাকে। আর অনেক কারণ একত্র হয়েই এ ধরনের পারিবারিক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। তবে এর পেছনে উল্লেখযোগ্য কারণ হচ্ছে হতাশা, পরকীয়া, আবেগ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা কমে যাওয়া, নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ইত্যাদি। মানুষের মধ্যে ক্রমে সুস্থ বিনোদনের অভাব হওয়ায় তাদের আচরণেও ক্রমাগত পরিবর্তন ঘটছে। এর ফলে তারা অন্যের কাছে নিজের আবেগ প্রকাশ করতে পারছে না। একই সঙ্গে প্রযুক্তির কারণে নর-নারীর মধ্যে এখন এক ধরনের অসুস্থ প্রতিযোগিতা কাজ করছে। আকাশ সংস্কৃতির কারণে মানহীন অনুষ্ঠান দেখে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার সম্পর্কে সন্দেহ তৈরি হচ্ছে। মানুষের আচরণ ক্রমেই সহিংস হয়ে পড়ছে। আর এ পরিস্থিতিতে অনেকেই হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে আপন মানুষটিকে হত্যা করছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ পরিস্থিতি সামাল দিতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার প্রয়োজন। কারণ এ সমস্যা এক দিনে তৈরি হয়নি। ক্যাবল টিভিতে বিভিন্ন বিদেশি চ্যানেলে প্রচারিত অনুষ্ঠান থেকে শিশুরা নেতিবাচক কিছু শিখছে কিনা তা অভিভাবকদের লক্ষ্য রাখতে হবে। এ ছাড়া বিভিন্ন এলাকায় স্বামী-স্ত্রী আশপাশের প্রতিবেশীদের নিয়ে সপ্তাহে এক দিন বৈঠকে বসে নিজেদের মধ্যকার সমস্যা নিয়ে আলোচনা করে এর সমাধান করতে পারেন। বাধ্যতামূলকভাবে প্রতি সিটি, পৌরসভা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ডের কাউন্সিলরদেরও পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধে কাউন্সেলিংয়ের উদ্যোগ নেওয়া উচিত। এ ব্যাপারে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে স্থানীয় সরকার ও মহিলাবিষয়ক মন্ত্রণালয়। অন্যদিকে পারিবারিক হত্যাকাণ্ডের জন্য রাজনৈতিক অস্থিরতাকেও দায়ী করেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, রাজনৈতিক কারণে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত একজন মানুষের ওপর চাপ পড়ে। পরে এর প্রভাব পরিবারেও পড়ে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সামাজিক অপরাধ প্রতিকারে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে। গণমাধ্যমগুলোরও এ বিষয়ে অনুষ্ঠান প্রদর্শনে এগিয়ে আসতে হবে।

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর