মঙ্গলবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

বিজিএমইএ ভবন সরবে কবে

রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন করা হবে আরও সময় চায় সংগঠনটি

রুহুল আমিন রাসেল

বিজিএমইএ ভবন সরবে কবে

হাতিরঝিল প্রকল্পের সৌন্দর্যে ক্যান্সার হিসেবে চিহ্নিত বিজিএমইএ ভবন ভাঙতে উচ্চ আদালতে আপিলের চূড়ান্ত রায়ের পর এবার তা পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন করে নতুন সুযোগ খুঁজতে চান পোশাকশিল্প মালিকরা। উত্তরায় নতুন ভবন নির্মাণে ক্ষতিপূরণ হিসেবে বিজিএমইএ বিনামূল্যে ৯ বিঘা জমি চাইলেও তাতে আপত্তি তুলেছে সরকার। পাশাপাশি ভবন ভাঙতে যৌক্তিক সময়ও চায় দেশের প্রধান রপ্তানি খাতের এই সংগঠনটি। তবে সব শেষে সবার জিজ্ঞাসা— বিজিএমইএ ভবন সরবে কবে?

কবে ভাঙা হবে এই ভবন, জানতে চাইলে বিজিএমইএর সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশের প্রতি আমরা শ্রদ্ধাশীল এবং চূড়ান্ত রায়ের নির্দেশনা মেনে চলব। তবে উচ্চ আদালতের রায়ের রিভিউ আবেদন করবে বিজিএমইএ।’

প্রায় দুই দশক আগে বেগুনবাড়ী খালের ওপর নির্মিত বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতি—বিজিএমইএর ১৬ তলাবিশিষ্ট ভবন ভাঙতে হাইকোর্টের দেওয়া নির্দেশ গত ২ জুন বহাল রেখেছে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ। ২০১১ সালের ৩ এপ্রিল হাইকোর্ট ভবনটি ভাঙার নির্দেশ দেয়। চলতি বছরের ১৯ মার্চ ওই রায়ের পূর্ণ অনুলিপি প্রকাশিত হয়। পূর্ণাঙ্গ রায়ে বলা হয়, বিজিএমইএ ভবন সৌন্দর্যমণ্ডিত হাতিরঝিল প্রকল্পে একটি ক্যান্সারের মতো। এ ধ্বংসাত্মক ভবন অচিরেই বিনষ্ট না করা হলে এটি শুধু হাতিরঝিল প্রকল্পই নয়, পুরো ঢাকা শহরকে সংক্রামিত করবে। তা ছাড়া হাতিরঝিল প্রকল্প একটি জনকল্যাণমূলক প্রকল্প। কাজেই সরকার ও অন্যান্য কর্তৃপক্ষের ওপর নির্দেশ হলো, ভবনটি ৯০ দিনের মধ্যে ভেঙে ফেলতে হবে। বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটের সাবেক সভাপতি স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এই ভবন দ্রুত সরানো উচিত। এটা ভাঙতে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ—রাজউকেই অর্ডার দিয়েছে আদালত। তবে পোশাকশিল্প খাতের ব্যবসায় বিজিএমইএ বিশেষ অবদান রাখছে, তাই তাদের প্রতীকী বা নামমাত্র মূল্যে সরকার জমি দিতে পারে। জানা গেছে, আপিল বিভাগের রায়ের পর হাতিরঝিলের বিজিএমইএ ভবন রক্ষার আশা ছেড়ে দিয়েছেন এই খাতের উদ্যোক্তাদের শীর্ষ নেতারা। তার পরও ভবন রক্ষায় সর্বশেষ আইনি লড়াইয়ের সঙ্গে সঙ্গে নতুন করে ভবন নির্মাণের ওপর গুরুত্ব দিয়েছে বিজিএমইএ। জমিও দেখা শেষ পর্যায়ে। সব দিক বিবেচনায় উত্তরায় নতুন ভবন তৈরিতেই আগ্রহী পোশাকশিল্প মালিকরা। এজন্য উত্তরার ১৩ নম্বর সেক্টরে সাড়ে ৯ বিঘা সরকারি খাস জমিও পছন্দ করে রেখেছেন। এখন তারা বিজিএমইএর নতুন ভবন নির্মাণ ও সরানোর ক্ষতিপূরণ হিসেবে সরকারের কাছে ওই জমি বিনামূল্যে চেয়েছেন। তবে সরকার তাতে আপত্তি জানিয়েছে। এজন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে দৌড়ঝাঁপও করছেন বিজিএমইএর কর্তাব্যক্তিরা। এর আগে ২০১১ সালে তৎকালীন বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী ও বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ জমির স্বত্ব না থাকা ও জলাধার আইন লঙ্ঘন করে বিধিবহির্ভূতভাবে নির্মাণ করায় বিজিএমইএ ভবন ভাঙার রায় দেয়। এর বিরুদ্ধে বিজিএমইএ আপিল করে। চলতি বছরের ২ জুন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার নেতৃত্বে চার সদস্যের বেঞ্চ বিজিএমইএর আপিল আবেদন খারিজ করে দেয়।

১৯৯৮ সালে আওয়ামী লীগের শাসনামলে বিজিএমইএ ভবন নির্মাণের কাজ শুরু হয়। তখন এ ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তৎকালীন ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আর বিএনপি শাসনামলে নির্মাণ শেষে ২০০৬ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ভবনটি উদ্বোধন করেন। পরিবেশবাদী বিভিন্ন সংগঠনের দাবি— উন্মুক্ত স্থান ও প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন-২০০০ লঙ্ঘন করে প্রাকৃতিক জলাধারের শ্রেণি বা প্রকৃতি পরিবর্তনের জন্য গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অনুমতি ছাড়াই বিজিএমইএ ভবন নির্মাণের জন্য হাতিরঝিলের বেগুনবাড়ী খালের একাংশ ভরাট করে ফেলা হয় এবং এতে খালের গতিপথ পরিবর্তিত হয়েছে, এটি পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর।

বিজিএমইএ ভবন ভাঙতেই হবে : বিজিএমইএ ভবন ভাঙতে হাইকোর্টের দেওয়া নির্দেশ বহাল রেখেছে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগও। জমির স্বত্ব না থাকা এবং জলাধার আইন লঙ্ঘন করে রাজধানীর হাতিরঝিলের দৃষ্টিনন্দন প্রকল্প এলাকায় নির্মিত বিজিএমইএ ভবনটি ভাঙতে পাঁচ বছর আগে নির্দেশ দেয় হাইকোর্ট। ওই রায়ের পর বিজিএমইএ লিভ টু আপিল করে। আপিলের সেই আবেদন খারিজ করে ২ জুন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে আপিল বিভাগের চার বিচারপতির বেঞ্চ এ রায় দেয়। এর ফলে এ ভবনটি ভাঙতে আইনগত আর কোনো বাধা থাকল না। আপিল বিভাগের রায়ের পর এ মামলায় হাইকোর্টের অ্যামিকাস কিউরি মনজিল মোরসেদ সাংবাদিকদের বলেছিলেন, এই ভবনের কারণে হাতিরঝিল প্রকল্পের সৌন্দর্য নষ্ট হচ্ছে। আপিল বিভাগের রায়ের পর এ ভবনটি এখন ভাঙতে হবে।

অন্যদিকে বিজিএমইএর আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক রায়ের পর বলেছিলেন, হাইকোর্ট বলেছিল বিজিএমইএ ভবনটি ভেঙে দিতে হবে। অ্যাপিলেট ডিভিশন তা কনফার্ম করেছে। তার মানে বিল্ডিংটা ভেঙে দিতে হবে। তার মতে, ভবন ভেঙে দিলে অর্থনীতিতে অত্যন্ত নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

মামলার পূর্বাপর : রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ—রাজউকের অনুমোদন ছাড়া হাতিরঝিলে বিজিএমইএ ভবন নির্মাণ করা হয়েছে বলে ২০১০ সালের ২ অক্টোবর একটি ইংরেজি দৈনিকে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ওই প্রতিবেদনটি আদালতের দৃষ্টিতে আনেন সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ডি এইচ এম মুনিরউদ্দিন। এর পরিপ্রেক্ষিতে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রুল জারি করে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ। রুলে বিজিএমইএ ভবন ভাঙার নির্দেশ কেন দেওয়া হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়। রুলের শুনানিতে অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, ইকবাল কবির (বর্তমানে হাইকোর্টের বিচারপতি) ও মনজিল মোরসেদের বক্তব্য গ্রহণ করে আদালত। এ রুলের ওপর চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০১১ সালের ৩ এপ্রিল বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী (পরে তিনি আপিল বিভাগের বিচারপতি হিসেবে অবসর নেন) ও বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ বিজিএমইএ ভবন অবৈধ ঘোষণা করে তা ভাঙার নির্দেশ দেয়।

হাইকোর্টের রায়ে স্থগিতাদেশ চেয়ে বিজিএমইএ কর্তৃপক্ষ আপিলে যায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ওই বছরের ৫ এপ্রিল আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারপতি হাইকোর্টের রায়ের ওপর ছয় সপ্তাহের স্থগিতাদেশ দেন। পরে এ সময়সীমা বাড়ানো হয়। ২০১৩ সালের ১৯ মার্চ ভবনটি ভেঙে ফেলতে হাইকোর্টের দেওয়া ৬৯ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। এরপর ওই বছর ২১ মে বিজিএমইএ কর্তৃপক্ষ সুপ্রিমকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় লিভ টু আপিল (আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন) করে। বিজিএমইএ ভবনটি ভেঙে ফেলতে হাইকোর্টের দেওয়া ৬৯ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়ে আরও বলা হয়, বিজিএমইএ যাদের কাছে ওই ভবনের ফ্ল্যাট বা অংশ বিক্রি করেছে, দাবি পাওয়ার এক বছরের মধ্যে তাদের টাকা ফেরত দিতে হবে। হাইকোর্ট বলেছে, ক্রেতাদের সঙ্গে ওই চুক্তি ছিল বেআইনি। কারণ, ওই জায়গায় ভবন নির্মাণ বা কোনো অংশ কারও কাছে বিক্রির কোনো অধিকার বিজিএমইএর ছিল না। তবে ক্রেতারা যেহেতু নিজেরাও জানত বা তাদের জানা উচিত ছিল যে, এই জমির ওপর বিজিএমইএর কোনো মালিকানা নেই এবং ভবনটি বেআইনিভাবে নির্মাণ করা হয়েছে; সুতরাং তারা কোনো ইন্টারেস্ট পাওয়ার দাবিদার নয়। এই ভবনের বিষয়ে রায়ে বলা হয়, ‘আর্থিক পেশিশক্তির অধিকারী বলে’ শক্তিশালী একটি মহলকে ‘আইনের ঊর্ধ্বে রাখতে হবে’ এমন যুক্তি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। একটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা হিসেবে বিজিএমইএর আইনের প্রতি আরও বেশি শ্রদ্ধাশীল হওয়া বাঞ্ছনীয় ছিল। তারা তা না করে আইনকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছে। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ, অর্থাৎ যাদের প্রয়োজনে জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছিল, তারাই মোট ৬ দশমিক ২১ একর জমি অপ্রয়োজনীয় বিবেচনায় ছেড়ে দেয় একই বছরে, অর্থাৎ ১৯৬০ সালে। পরে ১৯৯৮ সালে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো—ইপিবির ওই জমি একটি স্মারকের মাধ্যমে বিজিএমইএকে বেআইনিভাবে প্রদান করে। অথচ ইপিবি ২০০৬ সালের আগ পর্যন্ত আদৌ ওই জমির মালিক ছিল না। প্রসঙ্গত, ১৯৯৮ সালে বিজিএমইএ তাদের প্রধান কার্যালয় ভবন নির্মাণের জন্য প্যান প্যাসিফিক হোটেল সোনারগাঁওয়ের পাশে বেগুনবাড়ী খালপাড়ের এ জায়গাটি নির্ধারণ করে এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিয়ে ইপিবির কাছ থেকে ৫ কোটি ১৭ লাখ টাকায় জমিটি কেনে। ওই বছরের ২৮ নভেম্বর ভবনটি তৈরির কাজ শুরু হয়। ভবনটি নকশা অনুযায়ী করা হয়নি বলে রাজউক বলে আসছিল। পরিবেশবাদী বিভিন্ন সংগঠনও ভবনটি ভাঙার দাবি জানিয়ে আসছিল।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর