শুক্রবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

বাড়ি ও ৫০ একর জমি বাজেয়াপ্ত

রাজনৈতিক হেয় করা হচ্ছে, দেশে ফিরে আপিল : খোকা

মাহমুদ আজহার

বাড়ি ও ৫০ একর জমি বাজেয়াপ্ত

গুলশানে ছয় তলা বাড়িতে টাঙানো হয়েছে বাজেয়াপ্তের নোটিস

ক্যান্সারের চিকিৎসায় যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করছে সরকার। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দায়ের করা এক মামলায় গত বছরের ২০ অক্টোবর আদালত এ নির্দেশ দেয়। সম্প্রতি তার ১০ কোটি ৫ লাখ টাকার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেছে সরকার। এর মধ্যে গুলশানে ৬ তলা একটি বাড়িও রয়েছে। একই মামলায় তাকে ১৩ বছরের সাজাও দেওয়া হয়েছে। আইনি ভাষায় সাদেক হোসেন খোকা এখন পলাতক। চিকিৎসকরা অনুমতি দিলে আগামী ডিসেম্বরের শেষ দিকে খোকা দেশে আসতে পারেন। দেশে ফিরেই আইনিভাবে মামলা মোকাবিলা করবেন বিএনপির এই প্রভাবশালী নেতা। নিউইয়র্কে চিকিৎসাধীন সাদেক হোসেন খোকার দাবি, উচ্চ আদালতের অনুমতি নিয়েই চিকিৎসা করাতে যুক্তরাষ্ট্রে গেছেন। এখন তিনি কী করবেন— এ নিয়ে দলের ভিতরে-বাইরে চলছে নানা আলোচনা। দেশে ফিরলে সাজার মামলায় তাকে আত্মসমর্পণ করে জেলে যেতে হবে। এরপর জামিনে মুক্তি পেলে তাকে সম্পত্তি উদ্ধারে আইনিভাবে লড়তে হবে। সরকার কঠোর হলে এটা খুবই কঠিন। জটিল রোগে আক্রান্ত খোকা এখন বিষয়টি নিয়ে বেকায়দায় পড়েছেন বলেও তার ঘনিষ্ঠজনরা জানিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে নিউ ইয়র্কে অবস্থানরত অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, ‘এটা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যমূলক মামলা। ন্যায়বিচার পেলে এ মামলায় আমি নির্দোষ প্রমাণিত হব। উচ্চ আদালতের অনুমতি নিয়েই আমি যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসাধীন আছি। আমার অনুপস্থিতিতেই এই মামলার রায় হয়েছে। আইনজীবীও নিয়োগ করতে পারিনি। তবে সাজা ও সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হওয়ার ঘটনায় আইনজীবীদের সঙ্গে পরামর্শ করেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’ এর আগে গত বছরের ২০ অক্টোবর অবৈধ সম্পদ অর্জন এবং তথ্য গোপনের ওই মামলায় সাদেক হোসেন খোকাকে ১৩ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত। ঢাকার তৃতীয় বিশেষ জজ আদালতের বিচারক আবু আহমেদ জমাদার এ রায় ঘোষণা করেন। মামলার রায়ে তিনি (খোকা) অবৈধভাবে ১০ কোটি ৫ লাখ ২১ হাজার ৮৩২ টাকার সম্পদের মালিক হয়েছেন ঘোষণা করে ওই সম্পদ রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্তের নির্দেশ দেওয়া হয়। এরপরই আদালতের নির্দেশে স্থানীয় প্রশাসন খোকার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার উদ্যোগ নেয়।

১০ কোটি ৫ লাখ ২১ হাজার ৮৩২ টাকা মূল্যের স্থাবর-অস্থাবর যেসব সম্পত্তি রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে সাদেক হোসেন  খোকার মালিকানাধীন গুলশান ২ নম্বর  সেক্টরের ৭২ নম্বর সড়কের ৯ নম্বর  হোল্ডিংয়ের পাঁচ কাঠা জমি এবং তার ওপর নির্মিত ছয়তলা ভবন, যার মূল্য ২ কোটি ৪৭ লাখ ৬০ হাজার টাকা। মেসার্স বুড়িগঙ্গা ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের নামে গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার বিভিন্ন মৌজায় ২৭ খণ্ড কৃষিজমি, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন মৌজায় ৩৪ খণ্ড কৃষিজমিসহ মোট ৬১টি দলিলে ১৩৩ দশমিক ৬ একর জমি রয়েছে। এসব জমির চার মালিকের মধ্যে খোকার অংশ হিসেবে ৭  কোটি ৩৪ লাখ ৪৮ হাজার টাকা দামের ১০০ দশমিক ১৯ একর জমি বাজেয়াপ্তের নির্দেশ দিয়েছে আদালত। এ ছাড়া বুড়িগঙ্গা ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের নামে হাবিব ব্যাংকে জমা করা টাকা থেকে ২৩ লাখ ১২ হাজার ৯৭৩ টাকাসহ মোট ১০ কোটি ৫ লাখ ২১ হাজার ৮৩২ টাকার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশ  দেয় আদালত। এ প্রসঙ্গে খোকার আইনজীবী অ্যাডভোকেট মহসীন মিয়া বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, ‘নিউইয়র্কে থাকা সাদেক হোসেন খোকার সঙ্গে তার ফোনে কথা হয়েছে। তিনি সেখানে ক্যান্সারের চিকিৎসা করাচ্ছেন। এখন কিছুটা সুস্থবোধ করছেন। পুরোপুরি সুস্থ হলেই দেশে ফিরে সব মামলার আইনিভাবে মোকাবিলা করবেন। বাজেয়াপ্ত সম্পদ নিয়েও উচ্চ আদালতে আপিল করবেন। আশা করছি, শিগগিরই তিনি দেশে ফিরবেন। আর দেশে ফেরা ছাড়া আপিল করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।’ অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের সাবেক এই মেয়রের ব্যক্তিগত সহকারী মনিরুল ইসলাম খান জানান, ‘দুই দিন ধরে স্যারের গুলশানের বাসভবনের সামনে সম্পত্তি বাজেয়াপ্তের সরকারি নোটিস দেখতে পান। এ ছাড়া নারায়ণগঞ্জেও স্যারের সম্পত্তির ওপর লাল নিশানা টানানোর কথা শুনেছি। তবে বাড়িটি এরশাদ আমলে ক্ষতিগ্রস্ত জমির মালিক হিসেবে স্যারকে ওই প্লটটি দেওয়া হয়। আর যেসব কোম্পানির কথা বলা হচ্ছে, সেখানে স্যার অল্প অংশের শেয়ার মাত্র।’

রূপগঞ্জে ৫০ একর জমি বাজেয়াপ্ত : রূপগঞ্জ প্রতিনিধি জাহাঙ্গীর আলম হানিফ জানান, ঢাকার সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার মালিকানাধীন নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার কর্ণগোপ এলাকায় অবস্থিত বুড়িগঙ্গা ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড নামে একটি প্রকল্পের ৫০ একর ৮৯ শতাংশ জমি বাজেয়াপ্ত করেছে স্থানীয় প্রশাসন। সপ্তাহখানেক আগেই বাজেয়াপ্ত জমিতে লাল নিশান সাঁটিয়ে দেওয়া হয়।

বাজেয়াপ্তের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফারহানা ইসলাম ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) সাইদুল ইসলাম।

উপজেলা ভূমি অফিস সূত্র জানায়, ঢাকার বিজ্ঞ বিশেষ জজ আদালত-৩-এ বিশেষ মামলা নং ০২/২০১৫, ঢাকা মেট্রো বিশেষ মামলা নং ৯২/২০০৮, এসিসি জি,আর নং ৪৩/২০০৮, রমনা থানার মামলা নং ০৫ (৪)২০০৮ এর মামলার রায়ের আলোকে রাষ্ট্রের বাজেয়াপ্তকৃত ভূমি দণ্ডিত আসামি সাদেক হোসেন খোকার প্রতিষ্ঠানের নামীয় জোত/খতিয়ান হতে বিভিন্ন মোকদ্দমার মাধ্যমে কর্তন করে সরকারি খাস খতিয়ানভুক্তকরণের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে একটি আদেশ দেওয়া হয়। ওই আদেশ মোতাবেক ও মামলার রায়ের ভিত্তিতে জেলা প্রশাসকের নির্দেশনা মোতাবেক সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা ও সার্ভেয়ার সরেজমিন তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। ওই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে সহকারী কমিশনার (ভূমি) সাইদুল ইসলাম গত ১৫ সেপ্টেম্বর মিস কেস রুজুর মাধ্যমে ৫০ একর ৮৯ শতাংশ জমি ১ নম্বর খাস খতিয়ানভুক্ত নির্দেশনা প্রদান করেন।

জানা গেছে, প্রায় ১৫ বছর আগে রূপগঞ্জ উপজেলার তেতলাবো, গোলাকান্দাইল ও কর্ণগোপ মৌজায় বুড়িগঙ্গা ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের নামে প্রায় একশ একর কৃষি জমি ক্রয় করেন সাদেক হোসেন খোকা।  সেখানে জমি পাহারা দেওয়ার জন্য ১৫ থেকে ২০ জন আনসার নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। স্থানীয় বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী প্রকল্পটির দেখাশোনার দায়িত্বে রয়েছে। ওই প্রজেক্টে প্রায় ২০ থেকে ২৫ বিঘা খাস জমি রয়েছে। সরকারি খাস জমি ভুয়া দলিল বানিয়ে বিভিন্নভাবে রেজিস্ট্রি করে নিয়েছেন সাদেক হোসেন খোকা। এ ছাড়া অনেক নিরীহ কৃষকের জমিও জবরদখলসহ জাল দলিল সম্পাদনা করে নেওয়া হয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। উপজেলা নির্বাহী অফিসার ফারহানা ইসলাম জানান, আদালতের নির্দেশে আমরা ৫০ একর ৮৯ শতাংশ জমি বাজেয়াপ্ত করে লাল পতাকা টানিয়ে দিয়েছি। এখন জমি খাস খতিয়ানভুক্ত করার প্রক্রিয়া চলছে।

গাজীপুর প্রতিনিধি খায়রুল ইসলাম জানান, গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার তিনটি ভূমি অফিসে সাদেক হোসেন খোকার নামে জমি রয়েছে। কালিয়াকৈরের শাহাবাজপুর ভূমি অফিসে রয়েছে, মৌজা-উত্তর বক্তারপুর। জমির পরিমাণ ৭ একর ৪৭ শতাংশ। সফিপুর ভূমি অফিসে রয়েছে, মৌজা বাঁশতলী, তালতলী, কাঁচারস ও বাগাম্বরে ৭৪ একর। এ ছাড়া শ্রীফলতলী মৌজা জানের চালায় ৪৭ শতাংশ জমি। এগুলো যে কোনো দিন বাজেয়াপ্ত করা হবে। আইনি প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে। এ প্রসঙ্গে গাজীপুর জেলা প্রশাসক এস এম আলম জানান, সম্পত্তি বাজেয়াপ্তে আদালতের আদেশ পেয়েছি। সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়া শেষে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

কালিমা লেপনেই সরকারের উদ্যোগ : বিএনপি— খোকার সম্পত্তি বাজেয়াপ্তের ঘটনায় গতকাল দলের নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি নিন্দা জানিয়ে বলেছে, সরকার বিচার বিভাগকে কীভাবে প্রভাবিত করছে। বিচার বিভাগের ওপর সরকারের নগ্ন হস্তক্ষেপের বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে আমরা প্রতিবাদ জানিয়ে আসছি। সাদেক হোসেন খোকার যে সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে মূলত তিনি এ বিশাল সম্পত্তির অধিকারী নন। এটি একটি কোম্পানি। এতে ৭ জন শেয়ারহোল্ডার রয়েছেন। তিনি একটি ক্ষুদ্র অংশের মালিক মাত্র। তাছাড়া এ মামলায় তার অনুপস্থিতিতেই একতরফা রায় প্রদান করা হয়েছে। সাদেক হোসেন খোকার বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনে কালিমা লেপনের হীন উদ্দেশ্যেই এ নগ্নতার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে সরকার।

সর্বশেষ খবর