বুধবার, ৫ অক্টোবর, ২০১৬ ০০:০০ টা

কী হবে আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে

কমিটি হবে নির্বাচন সামলানোর সাংগঠনিক দক্ষদের নিয়ে । হাইব্রিড, বিতর্কিত, জামায়াতকে আশ্রয়দানকারী গত নির্বাচনে হেলিকপ্টারে অথবা র‌্যাব প্রহরায় ঢাকা আসা জনবিচ্ছিন্নদের দেখতে চায় না কর্মীরা

রফিকুল ইসলাম রনি

কী হবে আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে

আর ১৮ দিন পরই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের জাতীয় কাউন্সিল। দলটির কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত, এমনকি দেশের সব রাজনৈতিক দল ও নাগরিকের মধ্যে কৌতূহল— কী হতে যাচ্ছে সম্মেলনে অর্থাৎ কাউন্সিলে। নেতৃত্বে কী ধরনের পরিবর্তন আসছে? নাকি পুরনো ও বিতর্কিতরাই বহাল থাকছেন? দুই মেয়াদে ক্ষমতায় থেকে যারা বিত্তবৈভবে পুষ্ট হয়েছেন, বিদেশে বাড়ি কিনেছেন তারা কি এবার থেকে যাচ্ছেন? যারা পৌরসভা ও ইউনিয়ন নির্বাচনে মাঠের জনপ্রিয় নেতাদের উপেক্ষা করে অনৈতিক সুবিধা নিয়ে জামায়াত-বিএনপি নেতাদের হাতে নৌকা তুলে দিয়েছেন তাদের ব্যাপারে কি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে? দলীয় ফোরাম, মন্ত্রিসভা ও সংসদে অধিবেশন বা প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতা চলাকালে যে কোনো অনুষ্ঠানে সামনের সারিতে বসা নির্জীব যেসব নেতা ঘুমিয়ে পড়েন তাদের কি রাখা হবে কেন্দ্রীয় কমিটিতে? নাকি পাঠিয়ে দেওয়া হবে উপদেষ্টা পরিষদে? গত কয়েক বছরে হঠাৎ গজিয়ে ওঠা আলালের ঘরে দুলালদেরও কেন্দ্রীয় কমিটিতে দেখতে চান না আওয়ামী লীগের তৃণমূলের কর্মীরা। দুই মেয়াদে দায়িত্ব পালনে সারা দেশের সংগঠনকে শক্তিশালী করার পরিবর্তে নিজ এলাকার আধিপত্য কায়েমে ব্যস্ত ছিলেন, যে নেতাদের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পুলিশ ও র‌্যাব প্রহরায় নিজ এলাকায় যেতে হয়েছে বা হেলিকপ্টারে ঢাকায় আনতে হয়েছে, তারা থাকবেন? যদি থেকেই যান তবে তাদের দিয়ে কি একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়া সম্ভব? এসব গুঞ্জন ও কৌতূহল এখন মানুষের মুখে মুখে। দলীয় সূত্রমতে, আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখেই ২২ ও ২৩ অক্টোবর অনুষ্ঠেয় আওয়ামী লীগের জাতীয় কাউন্সিলে বড় ধরনের শুদ্ধি অভিযান চালানো হচ্ছে। বিতর্কিত ও সাংগঠনিক দক্ষতারহিতদের বাদ দিয়ে কর্মীবান্ধব, গণমানুষের সঙ্গে সম্পর্ক আছে এমন নেতৃত্ব আনা হবে। কারণ হিসেবে দলটির একাধিক নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতা বলছেন, সম্মেলনের মাধ্যমে গঠিত কমিটির নেতাদের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলকে পুনরায় ক্ষমতায় আনতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। দক্ষ নেতৃত্ব ছাড়া ওই লক্ষ্য অর্জন অসম্ভব। দলটির নীতিনির্ধারকরা বলছেন, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন আর একাদশ সংসদ নির্বাচন একই রকম হবে এমন ভাবার সুযোগ নেই। তা ছাড়া দলীয় হাইকমান্ড চান প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন। যে কারণে দলীয় এমপিদের ইতিমধ্যে মাঠ গোছাতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ৩০০ আসনে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থী নির্ধারণে জরিপ শুরু হয়েছে। সব দিক বিবেচনায় নেতৃত্ব নির্বাচন করা হবে। সে ক্ষেত্রে এবার কপাল পুড়তে পারে চার থেকে পাঁচ ক্যাটাগরির নেতার। এর মধ্যে একটি ক্যাটাগরিতে আছেন উড়ে এসে জুড়ে বসা হাইব্রিড, যারা দুই মেয়াদে ক্ষমতায় থাকতে রাজধানীর মতিঝিল, গুলশান, কারওয়ান বাজার, ধানমন্ডি, বারিধারায় অফিস খুলে সাংগঠনিক কাজের চেয়ে ব্যবসা নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। বাণিজ্যে মেধা খরচ করেছেন, আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়েছেন, পায়রা ও মংলা বন্দর এবং পদ্মার পাড়ে শত শত একর জমি কিনেছেন। এ ছাড়া যারা নিজস্ব বলয় ভারী করতে জামায়াত-শিবিরের নেতাদের আওয়ামী লীগে ভিড়িয়েছেন। বিগত পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে তৃণমূলের মতামত উপেক্ষা করে জেলা নেতাদের সঙ্গে আঁতাত করে বিএনপি-জামায়াত থেকে সদ্য আওয়ামী লীগে যোগদানকারী নেতাদের এবং চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী, রাজাকার ও রাজাকারের সন্তানদের হাতে নৌকা তুলে দিয়েছেন। দশম সংসদ নির্বাচনের আগে কতিপয় নেতাকে পুলিশ ও র‌্যাব প্রহরায় এলাকায় যেতে হয়েছে। কাউকে কাউকে হেলিকপ্টারেও ঢাকায় আসতে হয়েছে। এসব দিক বিবেচনা করে কমিটি গঠন করা হলে কপাল পুড়তে পারে প্রেসিডিয়াম, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, সাংগঠনিক, সম্পাদকমণ্ডলীসহ বেশ কয়েকজন সদস্যের। মাঠের কর্মী পর্যায়ে কথা বলে জানা গেছে, উদ্যমহীন ও নিষ্ক্রিয় নেতাদেরও কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে ছেঁটে ফেলা হবে। গত রমজানে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের ইফতার অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগ সভাপতির বক্তৃতার সময় সামনের সারিতে বসা চারজন মন্ত্রী ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। কিছুক্ষণ পর এক মন্ত্রী আসন ছেড়ে চলে গেলেও অন্যরা ছিলেন ঘুমন্ত। এরা সবাই কিন্তু আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে রয়েছেন। এ ছাড়া সংসদ অধিবেশনে ঘুমিয়ে পড়ার কারণে একজন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা নেতার আসন পরিবর্তন করা হয়েছে। তার পরও অধিবেশন চলাকালে তিনিসহ একাধিক নেতা বার বার ঘুমিয়ে যান আবার কাউকে কাউকে নাক ডাকতেও দেখা গেছে। মাঠকর্মীরা মনে করেন, এসব নেতাকেও উপদেষ্টা পরিষদে ট্রান্সফার করা উচিত। তারা চান দলে ‘নতুন রক্তের’ আবির্ভাব। পাবনা, জয়পুরহাট, নীলফামারী, কিশোরগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, লক্ষ্মীপুর, যশোর, খুলনাসহ প্রায় এক ডজন জেলার প্রবীণ নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আগামী কাউন্সিলে তারা মাঠের দক্ষ নেতৃত্ব দেখতে চান। এদিকে আওয়ামী লীগ ঘরানার সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষাবিদরাও বলছেন, আসন্ন কাউন্সিলে একাদশ জাতীয় নির্বাচন মাথায় রেখে নবীন-প্রবীণের সমন্বয়ে দলের নেতৃত্ব ঢেলে সাজাতে হবে। অভিজ্ঞদের যেমন রাখতে হবে, তেমন নবীন যারা বিগত দিনে ছাত্রলীগের নেতৃত্বে ছিলেন দল ও নেত্রীর প্রতি আস্থাশীল তাদের স্থান দিতে হবে। এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট প্রবীণ সাংবাদিক ও বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ফকির আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘বর্তমান প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল গুরুত্বপূর্ণ। ঐতিহ্যবাহী এ দলটির অর্জন, সংগ্রামের যে ইতিহাস আছে, কাউন্সিলের মাধ্যমে তার যে নেতৃত্ব আসবে তা জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ করবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, ২০০৯-এর কাউন্সিলে যে নতুন নেতৃত্ব আনা হয়েছিল, সে কমিটির একটি বড় অংশই দক্ষতা ও যোগ্যতা দেখাতে পারেনি। কাজেই আগামীর নেতৃত্ব সবকিছু বিবেচনা করেই আওয়ামী লীগ সভানেত্রী উপহার দেবেন বলে প্রত্যাশা করি।’ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান এ কে আজাদ চৌধুরী বলেন, ‘আসন্ন কাউন্সিলে পরীক্ষিত, দলের জন্য ত্যাগ, জনসম্পৃক্ততা আছে এবং মানুষের আস্থা অর্জনে সক্ষম এমন নেতাদের স্থান হবে বলে আশা করি। অতীতে ছাত্রলীগের রাজনীতি করেছেন, নেত্রীর প্রতি আস্থাশীল, সৎ, কর্মঠ, জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য এমন নেতাদের মূল্যায়ন হবে বলে আমি মনে করি, বিশ্বাস করি, প্রত্যাশা করি।’ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান বলেন, ‘আওয়ামী লীগই একমাত্র রাজনৈতিক দল যেখানে নিয়মিত সম্মেলনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কমিটি গঠন করা হয়। সম্মেলনের মাধ্যমে গঠিত কমিটির নেতাদেরই আগামী জাতীয় নির্বাচনের নেতৃত্ব দিতে হবে। কাজেই প্রবীণ-নবীনের সমন্বয় ঘটাতে হবে।’

সর্বশেষ খবর